২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৯:৫৫

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি বাস্তবায়ন শুরু উদ্বেগে দুর্নীতিবাজরা

এম এ খালেক

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারিদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নতুন ভিসানীতি বাস্তবায়ন শুরু করেছে। নতুন এই ভিসা নীতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যে বা যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে, নির্বাচনকালীন সময় অথবা তার আগে বা পরে সহিংসতায় যুক্ত হবে তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা প্রদান করবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার গত ২২ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে এ কথা জানান। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যারা বাধা সৃষ্টি করবে মূলত তারাই এই ভিসা নিষেধাজ্ঞার কবলে পতিত হবেন। যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে তারা হচ্ছেন, রাজনীতিবিদ, আইন প্রয়োগকারি সংস্থার সদস্য এবং অন্যান্য ব্যক্তি যারা সন্ত্রাসের মাধ্যমে বিত্ত-বৈভব অর্জন করছেন। এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা যে শুধু সরকারদলীয় রাজনীতিবিদদের উপরই প্রয়োগ করা হবে তা নয়। বিরোধীদলীয় সদস্যগণও যদি গণতন্ত্র বিঘ্নকারি কোনো কার্যক্রমে নিজেদের যুক্ত করেন তাহলে তাদের উপরও এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। শুধু দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই যে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে তা নয়, তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেও একই ধরনের পদক্ষেপ গৃহীত হবে। যাদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হবে তারা আর কখনোই বৈধভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবে না। উল্লেখ্য, গত ২৪ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে। তখন থেকেই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানামুখি আলোচনা চলছে। কারা এই ভিসা নতুন নীতির ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মূলত তা নিয়েই আলোচনা চলছে। তবে সাধারণভাবে মনে করা হচ্ছিল যে, সরকারকে সুষ্ঠু এবং আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য করার জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন এই ভিসানীতি বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। নতুন ভিসানীতি বাস্তবায়ন শুরুর ঘোষণা দিলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই মুহূর্তে ঠিক কতজনকে ভিসা প্রদান না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা উল্লেখ করা হয়নি। ফলে ইস্যুটি বেশ কিছুটা রহস্যে ঘেরা রয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা সাধারণত এসব ক্ষেত্রে আগে থেকেই তালিকা প্রকাশ করেন না। যাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিঘিœত করার সুস্পষ্ট এবং গ্রহণযোগ্য প্রমাণ রয়েছে তাদের সবার বিরুদ্ধেই ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। এরা যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গমনের জন্য ভিসার আবেদন করবেন তখনই তারা বুঝতে পারবেন তাদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। কারণ তাদের ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হবে।

গত মে মাসে যখন প্রথমবারের মতো এমন একটি উদ্যোগ গ্রহণের খবর প্রচারিত হয় তখন থেকেই বিষয়টি রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। বিরোধীদলীয় লোকজন মনে করছেন, এইবার সরকারি দলের দুর্নীতিবাজদের বারটা বেজে যাবে। তাদের মধ্যে যারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বিঘিœত করার কাজে যুক্ত ছিলেন বা আছেন তারা আর কখনোই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন না। আবার সরকারি দলের লোকজন বলছেন, তারা একা বিপদে পড়বেন না। বিরোধী দলের যেসব সদস্য রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপে যুক্ত ছিলেন বা আছেন তারাই সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বেন। সরকারের কোনো কোনো পর্যায় থেকে এমন কথাও বলা হয়েছে যে, সাত সাগর পাড়ি দিয়ে আমরা কেনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাবো? আমাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে না গেলেও চলবে। এটা সেই ‘আঙ্গুর ফল টক, এর মতোই শোনা যায়। আমাদের একশ্রেণির নেতা-নেত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কর্তাব্যক্তির একটু আশীর্বাদ পেলে বর্তে যান। সেলফি তোলার জন্য মুখিয়ে থাকেন তাদের মুখে এমন কথা মানায় না। এখন আবার বলা হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি আমাদের উপর স্যাংশন দেয় তাহলে আমরাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর স্যাংশন দেবো। এই কথার কী অর্থ দাঁড়ায় তা কি আমরা একবারও ভেবে দেখেছি? বাংলাদেশ যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর স্যাংশন দেয় তাহলে দেশটির সামান্যতম ক্ষতিও হবে না। কিন্তু তারা যদি বাংলাদেশের উপর স্যাংশন আরোপ করে তাহলে আমাদের তৈরি পোশাক শিল্প স্থবির হয়ে পড়তে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক সামগ্রীর দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক। ইউরোপীয় ইউনিয়ন হচ্ছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র। একক দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক আমদানি করে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০৫ সাল পর্যন্ত তৈরি পোশাক আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কোটা সুবিধা প্রদান করে আসছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেয়া কোটা সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়। পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো বাংলাদেশকে জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স (জিএসপি) সুবিধা প্রদান করছিল। কিন্তু একপর্যায়ে শ্রম অধিকার বাস্তবায়ন এবং অন্যান্য কয়েকটি ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেয়া জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে দেয়। বাংলাদেশ নানাভাবে চেষ্টা করেও জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল করতে পারেনি। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা অনেক ভেবে-চিন্তেই করে এবং চাইলেই সেই সিদ্ধান্ত থেকে দেশটিকে সরানো যায় না।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে মার্কিন ভিসানীতি নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরেই আলোচনা চলছে। অনেকেই মনে করছেন, নতুন মার্কিন ভিসানীতি বাস্তবায়িত হলে রাজনীতিবিদদের মধ্যে যারা সন্ত্রাস ও মাস্তানির মাধ্যমে ক্ষমতায় গমন এবং তা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন তারাই বিপদে পড়বেন। আরো সুস্পষ্ট করে বলতে হয় এই নতুন ভিসা নীতির ফলে সরকারি দলের লোকজনই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কিন্তু ব্যাপারটি আসলে তা নয়। যারাই সন্ত্রাস বা অনৈতিক কর্মকা-ের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়া বিঘিœত করার চেষ্টা করবেন তারাই বিপদে পড়বেন। সেখানে সরকারি দল বা বিরোধী দল বলে কাউকে ছেড়ে দেয়া হবে না। এখন প্রশ্ন হলো, একজন রাজনীতিবিদ বা ব্যবসায়ি যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে না যেতে পারেন তাহলে কী ক্ষতি হবে? পৃথিবীতে তো আরো অনেক দেশ আছে। প্রথম কথা হচ্ছে, নতুন ভিসা নীতির মাধ্যমে কোনো বাংলাদেশী নাগরিককে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকার না দেয়া হয় তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের জন্য তা হবে খুবই লজ্জার ব্যাপার। আমাদের একশ্রেণির রাজনীতিবিদের অস্বাভাবিক ক্ষমতার লিপ্সার কারণে জাতি হিসেবে আমাদেরকে এমন একটি লজ্জাজনক ঘটনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যারা সন্ত্রাসের মাধ্যমে অর্থ-বিত্ত অর্জনের জন্য রাজনীতি করেন তাদের এ জন্য লজ্জাবোধ হবে কিনা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির আসল মোজেজা অন্যত্র নিহিত। এটা শুধু রাজনৈতিক কারণে তাৎপর্যপূর্ণ নয়। এর আর্থিক গুরুত্ব রাজনৈতিক গুরুত্বের চেয়েও অনেক বেশি। মুখে যাই বলুক না কেনো, মার্কিন নতুন ভিসানীতি দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের একশ্রেণির নেতা ও ব্যবসায়িদের মাঝে উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছে। দেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দল যারা অতীতে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন ছিল বা এখন আছে তাদের একশ্রেণির নেতার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় নানা উপায়ে অর্থ-বিত্ত অর্জন করে তারা বিদেশে পাচার করেছেন। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। দেশের ব্যবসায়িদের একটি বড় অংশ নানা প্রক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচার করেছেন। তারা সবচেয়ে আতঙ্কে রয়েছেন। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় যদি তারা পড়ে যান তাহলে আগামীতে আর কখনোই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারবেন না। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে না পারলে তাদের পাচারকৃত অর্থ কে দেখাশুনা করবে। কারা তাদের বাড়ি বা ফ্লাট দেখভাল করবেন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে যাদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে তাদের পরিবারের কোনো সদস্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারবেন না। তাহলে পাচারকৃত অর্থ-সম্পদ কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে? আর কোনো ব্যাংক হিসাব যদি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ইন অপারেটিভ থাকে তাহলে তা ফ্রিজ হয়ে যেতে পারে। এমনকি সিজ করাও হতে পারে। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি যদি অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তাহলে কী উপায় হবে? উল্লেখ্য, কানাডা কিছুদিন আগে একটি আইন প্রণয়ন করেছে। আইনটি হলো এই রকম- একজন বিদেশী নাগরিক যদি কানাডার ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ ছাড়াই বাড়ি বা ফ্লাট ক্রয় করেন তাহলে তাকে তার অর্থের উৎস সম্পর্কে ঘোষণা দিতে হবে। যদি তিনি তা না পারেন তাহলে তার ক্রয়কৃত বাড়ি বা ফ্লাট বাজেয়াপ্ত করা হবে। মার্কন যুক্তরাষ্ট্রও যদি তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে তাহলে তা হবে আরো ভয়ঙ্কর।

এদিকে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে এই নতুন ভিসানীতি আমাদের জন্য কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না। আরো বলা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি স্যাংশন দেয় তাহলে বাংলাদেশের জনগণও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর স্যাংশন দেবে। কী হাস্যকর উক্তি! আমরা কিভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর স্যাংশন দেবো? আমরা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর স্যাংশন দেই তাহলে তারা আমাদের দেশ থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ করে দিতে পারে। যদি সত্যি সেটা করা হয় তাহলে বাংলাদেশের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? উন্নত যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত অবস্থা রয়েছে মার্কিন যুুক্তরাষ্ট্র তাদের মধ্যে সবার শীর্ষে রয়েছে। এই অবস্থায় কোনো ধরনের বাগাড়ম্বর না করে কিভাবে এই নতুন ভিসানীতি থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেছেন, মার্কিন ভিসানীতি প্রয়োগ নিশ্চিতভাবেই সরকারের উপর একটি চাপ। তাদের এই পদক্ষেপটিকে বাংলাদেশে অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অব্যাহত চাপ হিসেবেই দেখতে হবে। যারা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকবেন মূলত এই চাপ তাদের উপরই পড়বে। কারণ আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রায় সবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্বার্থ জড়িত রয়েছে। তাদের ছেলেমেয়েরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশুনা করছে অথবা চাকরি করছে। কাজেই তারা যদি কোনো কারণে ভিসা নীতির আওতায় নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত হন তাহলে সমূহ ক্ষতি হয়ে যাবে।

https://www.dailysangram.info/post/536551