২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ৫:৪৭

প্রভাবশালীদেরই শেষ হাসি

অনেকটা তড়িঘড়ি করে আবার সংশোধন করা হলো বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ ২০২০-৩৫)। গত বছরে ড্যাপের গেজেট প্রকাশের পর থেকে প্রভাবশালী অনেক জমির মালিক, ভূমি ও আবাসন ব্যবসায়ীরা ড্যাপ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন। তাদের চাপের মুখে অনেকটা নতিস্বীকার করতে বাধ্য হলো সরকার। গত বুধবার সরকার সংশোধিত ড্যাপের গেজেট তৈরি করে। গতকাল সোমবার ওয়েবসাইটে গেজেটটি প্রকাশ করা হয়। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে সিনিয়র সহকারী সচিব তারিক হাসান গেজেটে সই করেন।

সংশোধিত ড্যাপে ভবনের উচ্চতা বাড়াতে ছাড় দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি জমিও কম ছাড়ার বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া আগের ড্যাপে জমির প্রকৃতি পরিবর্তন করে যেসব জমিকে আবাসিক করা হয়েছিল, সেটাকে পুরোনো আঙ্গিকে ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়েছিল। ২০২২ সাল পর্যন্ত যেসব জমি আবাসিকে রূপান্তর করা হয়েছে, সংশোধিত ড্যাপে তার বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এতে অনেক জলাশয় ভরাটকারীও সুবিধা পেয়েছেন।

গত বছরের ২৩ আগস্ট গেজেট হওয়ার পর থেকেই ড্যাপ নিয়ে অভিযোগ শুরু হয়। অভিযোগকারীরা বলছিলেন, আগে যেভাবে বহুতল ভবন তৈরির সুযোগ ছিল, সংশোধিত ড্যাপে সে বিষয়ে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া আগে একজন ভবন মালিক যে পরিমাণ ফ্লোর স্পেস পেতেন, সেখানেও অনেক কাটছাঁট করা হয়েছে। ফলে অনেক জমির মালিকই এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এতে একদিকে রাজধানীর জমির দাম যেমন কমবে, তেমনি জমির মালিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাদের যুক্তি ছিল, একই আকারের প্লটে ৯ তলা ভবন হতে পারলে পাশের আরেকটি প্লটে কেন ছয়তলা ভবন হবে? পাশাপাশি ফ্লোর স্পেস কেন কমবে?

আবাসন ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের তরফ থেকে এ বিষয়ে রাজউক, পূর্ত মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একাধিক অভিযোগও দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২২ মার্চ স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে বেশ কিছু সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়। এর মধ্যে বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের ভবনের ক্ষেত্রে ফ্লোর এরিয়া র‍্যাশিও (এফএআর-ফার) বাড়ানোর প্রস্তাব আসে। এ ব্যাপারে ইনস্টিটিউট ফর প্লানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান সমকালকে বলেন, গত বছর গেজেট হওয়া ড্যাপটি পরিকল্পিত নগরায়ণ ও বাসযোগ্য রাজধানী তৈরির ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু এতে স্বার্থান্বেষী মহলের অসুবিধা হয়। এ জন্য তারা চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে এবারের সংশোধনের জন্য অংশীজন নিয়ে একটি সভা করা যেত। সেটা না করেই চাপের মুখে ড্যাপ সংশোধন করা হলো। এতে বাসযোগ্যতায় ঢাকা শহরকে ফিরিয়ে আনার আলো নিভে গেল। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও আমরা প্রভাবশালীদের কাছে নত হলাম।

এ ব্যাপারে ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহসভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, আগের ড্যাপের মাধ্যমে সরকারকে ডোবানোর ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। নগরবাসীকে সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। সেটা সংশোধন হওয়ায় কিছুটা হলেও মানুষ স্বস্তি পাবে। সংশোধিত ড্যাপে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এলাকায় ১২ ফুট প্রশস্ত রাস্তা হলে এখন আটতলা ভবন তৈরি করা যাবে। আগে এ ধরনের এলাকায় ১৬ ফুট প্রশস্ত রাস্তা থাকলে ছয়তলা উচ্চতার ভবন করার সুযোগ রাখা হয়েছিল।

পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা যেমন উত্তরা, বসুন্ধরা এলাকায় এখন ২৫ ফুট চওড়া রাস্তা থাকলে ১০তলা ভবন বানানো যাবে। আগে এটা ছিল নয়তলা। আর রাস্তা ৬০ ফুট হলে ১২তলা ভবনও করা যাবে। একইভাবে ব্লকভিত্তিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ১ থেকে ৬ বিঘা পর্যন্ত আয়তনের ব্লকে ২০ শতাংশ, আর ১৫ বিঘার বেশি আয়তনের ব্লকে ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত ফ্লোর স্পেস পাবেন ভূমিমালিক। সে ক্ষেত্রে ভবনের উচ্চতা ও প্রশস্ততা বাড়বে। আগে ব্লকভিত্তিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ জমি উন্মুক্ত রেখে ভবন নির্মাণের নিয়ম ছিল। এখন ২০ শতাংশ জমি উন্মুক্ত রাখলেই হবে।

জানা যায়, ঢাকা শহরে জনসংখ্যার ঘনত্ব বিশ্বের অন্য যে কোনো শহরের চেয়ে বেশি। এ কারণে নগরবাসীকে প্রয়োজনীয় সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয় সেবা সংস্থাগুলোকে। ২০ ফুট প্রশস্ত সড়কের পাশে ৯তলা ভবনের সারি থাকলে গাড়ির জট তৈরি হয় সামনের সড়কে। একইভাবে পানি-বিদ্যুৎ, স্যুয়ারেজ, ড্রেন সুবিধা নিশ্চিত করাও সম্ভব হয় না। এ জন্য রাজধানীর ওপর জনসংখ্যার চাপ কমাতে ড্যাপে বহুতল ভবনের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে ড্যাপ প্রণয়ন কমিটি। এ ছাড়া উন্মুক্ত স্থানের পরিমাণও বাড়ানো হয়েছিল। এ জন্যই জমিমালিক, আবাসন ও ভূমি ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ ছিলেন। এ নিয়ে তারা আদালতের শরণাপন্নও হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের আবেদন আদালত খারিজ করে দেন। তারপরও তাদের চাপেই ড্যাপ সংশোধন করা হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য রাখতে ১৯৯৬ সালে ড্যাপ প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১২ সালে একটি ভুলে ভরা ড্যাপ প্রণয়ন করে রাজউক। সেটা নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে একটি ড্যাপ রিভিউ কমিটি করা হয়। এরপর থেকে ড্যাপ প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। ২০২১ সালে ড্যাপের অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা কমিটি। গত বছরের আগস্টে ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই আবার সেই ড্যাপও সংশোধন করা হলো।

https://samakal.com/capital/article/2309198150