২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, সোমবার, ১০:১৪

হায়েনার দল থেকে বাঁচানো যাচ্ছে না নদী

- ‘চাঁদপুরের নদী দখলে সহায়তা করেন এক মন্ত্রী’

দেশে এখন পর্যন্ত এক হাজার আটটি নদীর তালিকা পেয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। সরকারি এই সংস্থাটি বলছে, এটি চূড়ান্ত নয়। সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। দেশের প্রতি চার-পাঁচ কিলোমিটার হাঁটলেই একটি নদীর দেখা মিলবে। প্রতি জেলায় গড়ে ২০টি নদী রয়েছে। সর্বোচ্চ ৯৭টি নদী পাওয়া গেছে সুনামগঞ্জ জেলায়। বাংলাদেশে স্বর্ণ বা হীরার খনি না থাকলেও নদীগুলো অমূল্য সম্পদ। কিন্তু বালুখেকোদের কারণে নদী ধ্বংস হচ্ছে। পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। মাছের প্রজনন কমছে। বিশেষ করে এ বছর দেশে ইলিশ উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে নদীতে বালু সন্ত্রাসের কারণে। দেশের নদী দখলের পেছনে রাঘব বোয়ালদের হাত আছে। এই হায়েনার দল থেকে নদীকে বাঁচানো যাচ্ছে না।

গতকাল রোববার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে ‘বাংলাদেশের নদ-নদী : সংজ্ঞা ও সংখ্যা’ শিরোনামে এক সেমিনারে এসব কথা বলেন বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা। সভায় সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় নদী কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী অনেকটা বোমা ফাটিয়েছেন। নদী দখলদারদের সহায়তাকারী তকমা দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনির নাম না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চাঁদপুরের এক নারী মন্ত্রী নদী দখলে সহায়তা করেন’। মেঘনা নদীতে বালু উত্তোলন বন্ধ করায় সরকারি কর্মকর্তাদের ওই মন্ত্রী শাস্তি দিয়েছেন বলেও জানান কমিশনের চেয়ারম্যান।

মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘আবার সেখানে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন শুরু হয়েছে। ভূমিকা রয়েছে একজন নারী মন্ত্রীর। এই হায়েনার দল থেকে নদীকে বাঁচানো যাচ্ছে না। এই হায়েনার দলের পেছনে আছে রাজনৈতিক শক্তি। চাঁদপুরের ওই নারী মন্ত্রী তাদের সহায়তা করেন।’ তিনি বলেন, ‘মেঘনায় এর আগে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করা হয়েছে। যাদের নেতৃত্বে এই কাজ বন্ধ করা হয়েছে, তাদের (সরকারি কর্মকর্তাদের) পরে পানিশমেন্ট (শাস্তি) হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো (বদলি করা) হয়েছে। স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে।’

এর আগে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক হাইড্রোলজিস্ট মো: আখতারুজ্জামান তালুকদার। তিনি দেশের নদ-নদীর সংখ্যা ও সংজ্ঞা নির্ধারণ করার ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। আখতারুজ্জামান বলেন, ‘সারা দেশে জেলা-উপজেলা, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন মানুষের সাথে যোগাযোগ করে দেশের নদীর সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশে এখন এক হাজার আটটি নদী আছে, যার দৈর্ঘ্য ২২ হাজার কিলোমিটার। নদীর সংখ্যা নির্ধারণে কোনো ব্যয় হয়নি।’

গত ১০ আগস্ট নদী রক্ষা কমিশনের প্রকাশিত খসড়া তালিকায় দেশে নদ-নদীর সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ৯০৭টি। ওই তালিকা প্রকাশের পর পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন আপত্তি জানায়।

আখতারুজ্জামান বলেন, দেশের প্রতিটি জেলার উপর দিয়ে ২০টি নদী প্রবাহিত হয়। আর সর্বোচ্চ ৯৭টি নদী সুনামগঞ্জ জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। দেশে তেল-গ্যাস-স্বর্ণ বা সম্পদ না-ই থাকতে পারে। তবে নদীর মতো বড় সম্পদ আছে, যেটা কখনো গোনায় ধরা হচ্ছে না।

মূল প্রবন্ধে আখতারুজ্জামান তালুকদার নদীর তালিকা প্রণয়নের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম নদী আমাজন। আর তৃতীয় বৃহত্তম নদী গঙ্গা বা পদ্মা। নবম বৃহত্তম নদী হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র তথা যমুনা। আর দু’টি নদীর (পদ্মা ও যমুনা) মিলতধারা যোগ করলে মেঘনা দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী। আমরা ছোট একটা দেশ এ রকম বড় বড় নদী ধারণ করছি। কিন্তু নদীর সংখ্যা অসংখ্য। একেবারে জালের মতো বিস্তৃত নদী আমাদের এখানে। যেকোনো এলাকায় চার-পাঁচ কিলোমিটার হাঁটলে একটা নদী পাওয়া যাবে। এরপর রয়েছে খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়। কী অপূর্ব এক দেশ। পৃথিবীতে অনেক দেশই মরুময়। এরকম সবুজ দেশ পাওয়া যায় না।

প্রবন্ধে তিনি আরো উল্লেখ করেন, আমরা নদীর প্রাথমিক তালিকা দিয়েছি। সংখ্যা কম বা বেশি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। দু’টি সোর্স থেকে আমরা তথ্য নিয়েছি। একটি প্রাইমারি সোর্স যেটা, জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন বা ইউনিয়ন ভূমি অফিস। নদীর রেকর্ড আছে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। ২০১৯ সালে নদীর পাশাপাশি খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়ের তালিকা চাওয়া হয়। তিন বছর চেষ্টা করে এই তালিকা এনেছি। সেকেন্ডারি সোর্স পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদ-নদীর তালিকা ছয় খণ্ডের। ৪০৫টি নদী ছিল তাদের তালিকায়। সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে নদীর তালিকা করেছি। এখন পর্যন্ত এক হাজার আটটি নদীর তালিকা পেয়েছি। ৩০০ কিলোমিটারের উপর নদী পেয়েছি দু’টি, পদ্মা এবং ইছামতি নদী। দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ নদী পদ্মা, ৩৪১ কিলোমিটার। ১২টি জেলার উপর দিয়ে এই নদী প্রবাহিত। ইছামতির ৩৩৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য, এই নামে ১১টি নদী আছে। একটা নদী যেটা ২০ মিটার হোক ৩০ মিটার হোক, এটা তালিকাবদ্ধ আছে। সেটির নাম আছে। সুতরাং সেটি নদী। আমাদের দেশের নদীগুলো হীরা, তেল বা স্বর্ণের খনির মতো মূল্যবান।

১৯৮০ সাল থেকে নদী দিবস পালিত হচ্ছে উল্লেখ করে স্বাগত বক্তব্যে জাতীয় নদী কমিশনের সচিব মো: রফিকুল ইসলাম বলেন, নদীতে বালু সন্ত্রাস ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এ জন্য এ বছর ইলিশ উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে। মাছ বংশবৃদ্ধিতে (প্রজনন) এগিয়ে আসছে না। হাইড্রোগ্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিভিন্ন টেকনোলজি ব্যবহার করে সরকার বালুমহাল ঘোষণা করে। কিন্তু তারা (যারা বরাদ্দ পান) নির্ধারিত জায়গা থেকে এক-দুই কিলোমিটার দূরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। এই অবৈধ বালু উত্তোলন যে কত বড় সর্বনাশ করছে আমাদের নদ-নদী, জলরাশির- বলে শেষ করা যাবে না।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক সচিব সৈয়দ মার্গুব মোর্শেদ বলেন, কমিশনের পক্ষ থেকে যা তৈরি করা হয়েছে তা চূড়ান্ত নয়। আরো সম্প্রসারিত হবে। আরো তথ্য আসবে। সেমিনারে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মনিরুজ্জামান, জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউটের উপ পরিচালক ড. খ কবিরুল ইসলামসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের শীর্ষ কর্তাবৃন্দ এবং বিশেষজ্ঞরা বক্তব্য রাখেন।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/779742