২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, সোমবার, ১০:১২

দশ বছরে পণ্য আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি প্রায় তিনগুণ

গত দশ বছরের ব্যবধানে দেশে পণ্য আমদানি ব্যয় প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে এই তথ্য পাওয় যায়। এটি কেবল ডলারের মূল্য বৃদ্ধির ফলে ঘটেছে বলে মনে করছেন না সংশ্লিষ্টরা। দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন হিসাবে শুভঙ্করের ফাঁকি এবং পণ্যমূল্যের কৃত্রিম বৃদ্ধিজনিত ঘটনাও রয়েছে বলে বিশ্লেষকদের সন্দেহ।

বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় সংক্রান্ত হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যেসব দেশ থেকে বাংলাদেশ পণ্য আমদানি করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ভারত, চীন, সিঙ্গাপুর, জাপান, হংকং, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া ও অন্যান্য দেশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে মোট আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য ছিল ৩৪ হাজার ৮৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৯ হাজার ১৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পার্থক্য দাঁড়ায় ৫৫ হাজার মিলিয়ন ডলারের বেশি। উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশ তার বৈদেশিক বাণিজ্যের সিংহভাগই করে থাকে চীন ও ভারতের সঙ্গে। তবে এর মূল অনুষঙ্গই হলো পণ্য আমদানি। চীন ও ভারত বাংলাদেশের পণ্য ক্রয় করে খুবই কম পরিমাণে। আলোচ্য সময়ে মোট আমদানি ব্যয়ের শতকরা ২৭ দশমিক ২৮ ভাগ ছিল চীনের এবং ভারতের ছিল শতকরা ১২ দশমিক ৪৮ ভাগ।

তথ্যে দেখা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য ছিল ৪ হাজার ৭৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ হাজার ১৭৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বৃদ্ধির পরমিাণ ১০ হাজার ৪০২ মিলিয়ন ডলার। আর চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য ২০১২-১৩ অর্থবছরে ছিল ৬ হাজার ৩২৮ মিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪ হাজার ২৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বৃদ্ধির পরিমাণ ১৭ হাজার ৯২৭ মিলিয়ন ডলার। একই হিসাবে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য ছিল ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫৩৮ মিলিয়ন ডলার। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ১৯৩ মিলিয়ন ডলার। বৃদ্ধির পরিমাণ ২ হাজার ৬৫৫ মিলিয়ন ডলার।

খাদ্য আমদানি নিয়ে প্রশ্ন
সময়ের ব্যবধানে বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যয় বৃদ্ধি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে মনে করা হলেও বাংলাদেশের খাদ্য আমদানি বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। ‘বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ’Ñএই বিষয়টি প্রচারের জোরে মানুষের মনে গেঁথে গেছে বলে মনে হয়। সরকারের প্রায় সব মহল থেকেই এটি প্রচার করা হয়ে আসছে।

কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে, বাংলাদেশকে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ কোটি ৫ লাখ ৩৩ হাজার টন খাদ্য আমদানি করতে হয়। পরের অর্থবছরে এই আমদানির পরিমাণ কিছুটা কমে ১ কোটি ৪ লাখ ৪৯ হাজার টন হতে পারে। এই কমে যাওয়ার কারণ দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়ে যাওয়া নয়, বরং দেশে ডলার-সংকট, বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়াসহ নানা কারণে খাদ্যসহ সব ধরনের পণ্যেরই আমদানি কমার কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ শুধু চাল আমদানি করেছে ৮৫ কোটি ৯ লাখ ডলার। গম ১৮২ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। আমদানির তালিকায় আছে গুঁড়া দুধ, মসলা, ডালের মতো খাদ্যপণ্যও। এই আমদানির পরিমাণ বছর বছর বেড়েই চলেছে।

খাদ্যশস্য আমদানি সংক্রান্ত তথ্যে দেখা যায়, চাল আমদানি করা হয় ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ১১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের, ২০১৯-২০ বছরে ২২ মিলিয়ন ডলারের, ২০২০-২১ বছরে ৮৫১ মিলিয়ন ডলারের এবং ২০২১-২২ বছরে ৪২৭ মিলিয়ন ডলারের।

অন্যদিকে গম আমদানি করা হয় ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ১ হাজার ৪৩৭ মিলিয়ন ডলারের, ২০১৯-২০ বছরে ১ হাজার ৬৫১ মিলিয়ন ডলারের, ২০২০-২১ বছরে ১ হাজার ৮৩০ মিলিয়ন ডলারের এবং ২০২১-২২ বছরে ২ হাজার ১৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের।
তৈলবীজ আমদানি করা হয় ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৭৯৬ মিলিয়ন ডলারের, ২০১৯-২০ বছরে ১ হাজার ১৮৩ মিলিয়ন ডলারের, ২০২০-২১ বছরে ১ হাজার ৪০৬ মিলিয়ন ডলারের এবং ২০২১-২২ বছরে ১ হাজার ৭৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের। ভোজ্যতেল আমদানি করা হয় ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ১ হাজার ৬৫৬ মিলিয়ন ডলারের, ২০১৯-২০ বছরে ১ হাজার ৬১৭ মিলিয়ন ডলারের, ২০২০-২১ বছরে ১ হাজার ৯২৬ মিলিয়ন ডলারের এবং ২০২১-২২ বছরে ২ হাজার ৮৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের।
শুভঙ্করের ফাঁকি!

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেশে চাল-গম আমদানির যে তথ্য দীর্ঘদিন ধরে প্রচারিত হয়ে আসছে তাতে অন্তত কোনোভাবেই বলা যায় নাÑ বাংলাদেশ চাল-গমে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কারণ, প্রতিবছরই বাংলাদেশ কমবেশি চাল-গম আমদানি করেছে। খাদ্যপণ্যের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েই চলেছে। বলা হচ্ছে: সরকারের দেশীয় চাহিদা অনুযায়ী বছরের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয় না। ফলে প্রতিবছরই দেশে উৎপাদনের পরেও চালের মতো আবশ্যিক খাদ্যশস্যের একটি অংশ আমদানি করতে হয়। এবার টানা চতুর্থ বছরের মতো অপর্যাপ্ত স্থানীয় উৎপাদনের কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানিতে বেশি অর্থ খরচ করছে বাংলাদেশ।

বিশেষজ্ঞরা বরাবরই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে উৎপাদন বহুমুখী করার পরামর্শ দিয়ে আসছেন। এতে যেমন উৎপাদন বাড়বে তেমনই আমদানি কমাতে সহায়তা করবে। উল্লেখ্য, ৮টি প্রধান পণ্যের মধ্যে ভোজ্যতেল ও তেলবীজ আমদানি করতে একটি বড় অংশ ব্যয় হয়। কৃষি বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের ৮৮ দশমিক ২৯ লাখ হেক্টর চাষযোগ্য জমি পরিকল্পিত ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনে বৈচিত্র্য আনতে নীতিনির্ধারকদের মনোযোগের অভাব রয়েছে। ফলে, আমদানিনির্ভরতা এতো বেশি। দেশে বর্তমানে বছরে প্রায় ১ কোটি টন আলু হয়। এর মধ্যে ২০ থেকে ৩০ লাখ টন আলু সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়। বাংলাদেশে যে ধরনের ও জাতের আলু হয়, বৈদেশিক বাজারে এর চাহিদা কম। ফলে তা রপ্তানি করা যায় না। আবার ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিলে সরকারের টনক নড়ে। এখন বলা হচ্ছে, আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে দেশকে পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হবে।

https://www.dailysangram.info/post/536369