২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, সোমবার, ৭:২৪

শিক্ষার সঙ্কট

অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম

(পর্ব-০১)
গত দুই বছরে বন্ধ হয়েছে ১৮ হাজার স্কুল, (দৈনিক নয়া দিগন্ত ২৪ আগস্ট ২৩)। খবরে বলা হয়েছে- এগুলোর সব বেসরকারি প্রাথমিক স্কুল। করোনাকালীন সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব স্কুল করোনা-পরবর্তী সময়ে ছাত্র এবং অর্থসঙ্কটে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের করা এপিএসসি শুমারিতে এ তথ্য উঠে এসেছে। একই সাথে প্রাথমিকে বেড়েছে প্রায় সাড়ে চার লাখ শিক্ষার্থী। যদিও অধিদফতরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুলগুলো মানহীন। অথচ এ মানহীন স্কুলগুলোর নিবন্ধন এবং অনুমতিপত্র কারা এবং কিভাবে দিয়েছিলেন তার কোনো সদুত্তর মেলেনি। ‘কলেজে ভর্তির আগেই ঝরে পড়ছে সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থী’ শিরোনামে দৈনিকটি ২২ আগস্ট আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পত্রিকাটি জানায়, প্রথম ধাপে ভর্তিচ্ছু প্রায় ১৩ লাখ শিক্ষার্থী আবেদন করেছেন। তিন লাখ ৫২ হাজার ৭৫৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য আবেদনই করেননি। এ বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১৫ লাখ ৪১ হাজার ১৪০ জন। দেশের কলেজগুলোর ধারণক্ষমতা ২৬ লাখের বেশি। এ হিসাবে যখন কলেজগুলোর ছাত্রসঙ্কটে ভোগার কথা, তখন সারা দেশের গুটিকয়েক কলেজ ছাড়া বাকিগুলোতে ছাত্রছাত্রীরা কেন ভর্তি হতে ইচ্ছুক নন এটি নিয়ে অভিসন্দর্ভ রচনা করা যেতে পারে।

২২ আগস্ট দৈনিক প্রথম আলো ‘অনাহারে ৩৩ হাজার শিক্ষক, ছাত্র পড়াবেন কিভাবে’ শিরোনামে একটি উপসম্পাদকীয় প্রকাশ করে। উপসম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে- বর্তমান দুর্মূল্য অর্থনীতির বাজারে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা যা সম্মানী পান তাতে সংসারের সাকুল্য ব্যয় নির্বাহ হয় না। এমপিওভুক্ত নন এবং যাদের গড় বেতন ১০ হাজার টাকার নিচে তারা কিভাবে বেঁচে আছেন কিভাবে সংসার চালাচ্ছেন তা ভাববার কেউ নেই। এরা বলতে গেলে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অর্ধাহারে থাকা ৩৩ হাজার শিক্ষক ছাত্রদের কী পড়াবেন কী শেখাবেন তা ভাববার বিষয় বৈকি! এসব স্কুল থেকে যেসব শিক্ষার্থী পাস করেন তাদের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার যথেষ্ট অবকাশ আছে।

প্রতি বছরের এসএসসি ও সমমান এবং এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল ঘোষণার পর পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ দেয়া হয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। পুনর্মূল্যায়ন শেষে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী ‘এ’ এবং ‘এ প্লাস’ গ্রেডে উত্তীর্ণ হন। এর ফলে পরীক্ষার খাতা পরীক্ষণের দায়িত্বে যারা আছেন তাদের যোগ্যতা নিয়ে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে। এসব পরীক্ষক পরবর্তীতে আবারো পরীক্ষার খাতা পরীক্ষণের দায়িত্ব পান (সঠিক নাও হতে পারে); যে কারণে প্রতি বছর একই চিত্রের পুনরাবৃত্তি ঘটে। এতে বোর্ড কর্তৃপক্ষের দক্ষতা, সদিচ্ছা, দায়বদ্ধতা সব কিছু নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হওয়ার অবকাশ থেকে যায়। এ সবের জন্য কারোর বিরুদ্ধে কোনো শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে শোনা যায়নি।

প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য মৌলিক শিক্ষা প্রদান এবং মাধ্যমিকের জন্য প্রস্তুত করা। মৌলিক শিক্ষার মধ্যে রয়েছে ব্যবহারিক স্বাক্ষরতা ও জীবনদক্ষতা। জীবনদক্ষতার উদাহরণ হচ্ছে সাঁতার জানা। আগুন লাগলে তা নেভানোর প্রাথমিক উপায় উপকরণ সম্পর্কে জানা। কুকুর বা বিড়ালের কামড়ে কী করতে হবে জানা। অথচ প্রাথমিক শিক্ষাকার্যক্রমে এর কোনটি শেখানো হয় না। সারা দেশের প্রায় ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। কতটিতে খেলার মাঠ, সাঁতার কাটার পুকুর আছে তার হিসাব কেউ দিতে পারবেন না। প্রতি ৩০ শিক্ষার্থীর জন্য দু’জন শিক্ষকের বৈশ্বিক মানদণ্ড এখনো ‘দিল্লি দূরঅস্ত’। প্রশিক্ষিত শিক্ষকের পরিবর্তে এবং শিক্ষকস্বল্পতার কারণে একজন শিক্ষককে নিতে হচ্ছে অনেকগুলো বিষয়ের ক্লাস। ফলে শিশুরা শুধু কাগজে-কলমে পড়ছে, জীবনদক্ষতা তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে না।

অন্যদিকে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের ব্যাপ্তি এখন গ্রাম পর্যায়ে। এসব স্কুলে বইয়ের বোঝায় একদিকে যেমন শিশুর হাঁসফাঁস অবস্থা, তেমনি এসব স্কুলের বেতন এবং অন্যান্য ব্যয় ভারে অভিভাবকদের নাভিশ্বাস। একই সাথে মাদরাসাগুলো স্বাভাবিক সামাজিক জীবনাচারের বাইরে ঠেলে দেয়া হয়েছে। একেবারে লেজেগোবরে অবস্থা। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েও একই চিত্র। শিক্ষকস্বল্পতা, প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব, শিক্ষকদের ওপর রাজনৈতিক চাপ, সব মিলিয়ে লেখাপড়ার ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। যে স্কুলে বিজ্ঞানের শিক্ষক নেই সেই স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয়েছে। পরীক্ষার্থীরা পাস করে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ভালো ফল করছেন!

সর্বোপরি আমাদের শিশুরা কী পড়ছে, কেন পড়ছে, তাদের জীবনের ভবিষ্যৎ নির্মাণে এ শিক্ষার কোনো ভূমিকা আছে কিনা তা কখনো পর্যালোচনা করা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। লক্ষ্যহীন অভিযাত্রার মতো শিশুরা লেখাপড়া নামক স্রোতে ভেসে চলেছে। এ অবস্থার আশু পরিবর্তন প্রয়োজন।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/779647