২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, রবিবার, ৬:০৫

গ্রামাঞ্চলেও এডিসের লার্ভা

ডেঙ্গুর বিস্তার রোধ ও সচেতনতার উদ্যোগ নিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন। গতকাল তোলা। ছবি : মঞ্জুরুল করিম
দেশের গ্রামাঞ্চলে যেমন ডেঙ্গু রোগীর সন্ধান মিলেছে, একইভাবে মিলেছে এডিস মশার লার্ভাও। কিন্তু গ্রাম পর্যায়ে মশক নিধনে নেই কোনো কার্যক্রম। জেলা শহরগুলোতে মশক নিধনের কিছু কার্যক্রম থাকলেও কোথাও কীটনাশক সংকট, কোথাও লোকবল সংকট, আবার কোথাও নেই যন্ত্রপাতি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে ডেঙ্গু মশার ঝুঁকি শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি।
এভাবে চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে। আগামী ২০ থকে ৩০ বছর গ্রামের মানুষকে ডেঙ্গু ভোগাতে পারে।

গতকাল শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরো ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দুই হাজার ৮৬৫ জন।

এর মধ্যে দুই হাজার ৫১ জনই ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ৬৭ শতাংশ ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলার। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর স্থানীয়ভাবে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, রাজশাহী, বরিশাল, পটুয়াখালীসহ যেসব জেলা ও উপজেলায় সীমিত আকারে জরিপ চালিয়েছে, তাতে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ডেঙ্গুর যে পরিস্থিতি, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যেভাবে বাধাহীনভাবে বেড়ে চলেছে, তা অত্যন্ত ভাবনার বিষয়।
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা না নিলে আগামী ২০ থেকে ৩০ বছর ডেঙ্গু থাকবে। কখনো কখনো এটি মারাত্মক রূপ নিতে পারে।
তিনি বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোর বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মশক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই। উপজেলা পর্যায়ে মশক নিধন কার্যক্রম অতি সামান্য। ইউনিয়ন পর্যায়ে সামর্থ্যের প্রশ্নেই ওঠে না।

এর মানে, দেশে বেশির ভাগ
জায়গায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য নেই। এমন পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরো বাড়বে।
সরকারি পর্যায়ে দেশের আট উপজেলায় মশক নিধন পরিস্থিতির খোঁজ নিয়েছেন কালের কণ্ঠ প্রতিনিধিরা। এর মধ্যে কোনো উপজেলায়ই ইউনিয়ন পর্যায়ে মশক নিধন কার্যক্রম নেই। এর মধ্যে ছয় উপজেলায় কার্যক্রম থাকলেও কোথাও লোকবল সংকট, কোথাও আবার মশার ওষুধ ছিটানোর মেশিন নষ্ট।

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলা প্রতিনিধি জানান, পৌর শহর থেকে শুরু করে উপজেলার উজানচর, দৌলতদিয়া, দেবগ্রাম ও ছোটভাকলা ইউনিয়ন এলাকায় ডেঙ্গু মশার উপদ্রব দ্রুত বাড়ছে। প্রতিদিন জ্বরে আক্রান্তরা ভিড় করছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কিন্তু উপজেলার কোথাও নেই মশা নিধন কার্যক্রম। উপজেলা শহরে নামমাত্র কার্যক্রম চালানো হলেও ফগার মেশিনসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে ইউনিয়ন এলাকায় মশা নিধন কার্যক্রম শুরু করা যায়নি।

পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি প্রতিনিধি জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ২০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। কিন্তু ডেঙ্গু নিধনে কোনো কার্যক্রম নেই। জেলার বলদিয়া ইউনিয়নে ডেঙ্গু মারাত্মক রূপ নিয়েছে। এই ইউনিয়নের ৭০ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।

মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, মানিকগঞ্জ পৌরসভায় ডেঙ্গু মশা নিধনের মেশিন রয়েছে মাত্র দুটি। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বাড়িঘর এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার বাইরে ব্যবহার করা হয় না।

মানিকগঞ্জ পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা বিভাগের কর্মকর্তা তাপস সরকার জানান, ২০ বছর আগের পুরনো মেশিন মেরামত করে কোনো রকমে কাজ করা হচ্ছে। জনবল সংকটও রয়েছে। ফলে জেলা প্রশাসক, জেলা জজ, পুলিশ সুপারসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বাসভবন, হাসপাতাল, সার্কিট হাউস, স্কুল-কলেজ ছাড়া সাধারণ মানুষের বাড়িঘরে মশার ওষুধ ছিটানো সম্ভব হচ্ছে না।

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, হবিগঞ্জ ২৫০ শয্যা আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে ১৬১ রোগী। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন পৌরসভার উদ্যোগে বিভিন্ন এলাকায় ওষুধ ছিটানো হচ্ছে; কিন্তু মশা কমছে না।
ভোলার চরফ্যাশন প্রতিনিধি জানান, চরফ্যাশনে ডেঙ্গুর প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। মৃত্যুর হারও বাড়ছে। কিন্তু ইউনিয়ন পর্যায়ে মশক নিধনের কোনো কার্যক্রম নেই। তবে পৌরসভায় মশা নিধনের কার্যক্রম রয়েছে।

পাবনার ভাঙ্গুড়া প্রতিনিধি জানান, ভাঙ্গুড়া পৌরসভা ছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়ে মশা নিধনের কার্যক্রম নেই। সরকারি সহায়তা না পাওয়ায় ইউনিয়ন পর্যায়ে মশা নিধনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া যায়নি। ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে পৌর শহরের ৯ ওয়ার্ডে মশা নিধনে নিয়মিত দুটি ফগার মেশিন, তিনটি অটোমেশিন ও ১৭টি সাধারণ মেশিন দিয়ে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর মশক নিধনে স্থানীয় সরকার বিভাগ পাঁচটি নির্দেশনা দিয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল, ইউনিয়ন ও পৌরসভায় বা উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে মশক নিধনসংক্রান্ত সব তথ্য জানাতে হবে বিভাগীয় কমিশনারকে। সংশ্লিষ্ট জেলা পর্যায়ের সমন্বয়ক প্রতি মাসে এসংক্রান্ত প্রতিবেদন বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন। কিন্তু সে কার্যক্রমের কোনো অগ্রগতি নেই।

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মশক নিধন করতে হলে কীটতত্ত্ববিদ, কীটতাত্ত্বিক টেকনিশিয়ান, কীটতাত্ত্বিক সহকারী দরকার; যা স্থানীয় সরকারের নেই। দুই. সাধারণ মশক নিধন কর্মী, যাঁরা ড্রেন, নর্দমা, খালের মশক নিধন করে অভ্যস্ত, তাঁদের দিয়ে এডিস মশা নিধন সম্ভব না। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও আমাদের নেই। তিন. ডেঙ্গু নিধনে জনগণের সম্পৃক্ততা দরকার। সেটি স্থানীয় সরকারের করার কথা; কিন্তু তারা করতে পারছে না।

কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের তো বড় শহরগুলোতেই সঠিকভাবে মশক নিধন কার্যক্রম নেই। মফস্বল শহরগুলোতেও খুবই দুর্বল ব্যবস্থা। লোকবল নেই, থাকলেও প্রশিক্ষণ নেই। বর্তমানে যেভাবে চলছে, তাতে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা কষ্টকর।’

তিনি বলেন, ‘সারা দেশে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আমাদের আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। যাঁরা গবেষণা করবেন, তাঁরা মশক নিধনের নতুন নতুন প্রযুক্তি যুক্ত করবেন। যে লোকবল আছে, তাদের প্রশিক্ষণ দেবে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার কালের কণ্ঠকে বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সব অঙ্গপ্রতিষ্ঠান, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদকে মশক নিধনে সক্ষমতা অর্জন করতে জনবল প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় লজিস্টিক, কীটনাশক সরবরাহ করতে হবে। এ জন্য বাজেট জরুরি। বাজেট পাওয়া গেলে মশক নিধন সম্ভব হবে। তা না হলে প্রতিবছর ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকবে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/09/24/1320880