২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, রবিবার, ৬:০৪

পানি সরাতে প্রয়োজনের চেয়ে অর্ধেক নালা-নর্দমা

জলাবদ্ধতার ভোগান্তি থেকে রাজধানীবাসীর মুক্তি মিলছে না কিছুতেই। এ থেকে মুক্তি পেতে দায়িত্বশীলরা মহাপরিকল্পনার পর মহাপরিকল্পনা করলেও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে মধ্যরাত ১২টা পর্যন্ত টানা ছয় ঘণ্টার ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিতে রাজধানীর অনেক এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যায়। কয়েকটি এলাকার পানি ২৪ ঘণ্টায়ও সরানো যায়নি।

এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রধান কারণ হিসেবে নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত নদীতে পানি সরে যেতে প্রয়োজনীয় নালা-নর্দমার অভাব। নেই দ্রুত পানি সরানোর প্রধান কোনো লাইন। রাজধানীতে প্রয়োজনের চেয়ে অর্ধেকেরও কম নালা-নর্দমা রয়েছে। এসব নালা-নর্দমার বেশির ভাগ আবার নগরবাসীর অসচেতনতায় বন্ধ থাকে।

ফলে বৃষ্টির পানি দ্রুত সরতে পারছে না।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন প্রতিবছর নালা-নর্দমার উন্নয়নকাজে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, যে পথ দিয়ে (নালা) পানি নদীতে গিয়ে পড়বে, তার উন্নয়ন না করে বিভিন্ন এলাকার পানির সংযোগ লাইনের কাজে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। ফলে সুফল মিলছে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক এবং ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাজধানীতে জলাবদ্ধতার ভোগান্তি দীর্ঘদিনের। পানি কোন পথ দিয়ে নদীতে নামবে, সে কাজ আগে করা উচিত। তা না করে শুধু সংযোগ লাইনের কাজ করলে অবস্থার পরিবর্তন হবে না। প্রথমে পানি নামানোর জায়গা তো চাই। পানি নামানোর ব্যবস্থা না করে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করলে তাতে শুধু টাকার অপচয়ই হবে।
টাকার এই অপচয় বন্ধে দ্রুত মহাপরিকল্পনা নিয়ে সে অনুযায়ী কাজ করা উচিত।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে রাজধানীতে প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেকেরও কম নালা-নর্দমা রয়েছে। তাহলে পানি নামবে কোন পথ দিয়ে? আবার পানি ধীরে নামলেও তা জমার জন্য জলাশয়ের প্রয়োজন। দিনে দিনে জলাশয় নাই হয়ে যাচ্ছে। যেখানে শহরের মোট ভূমির অন্তত ১২ শতাংশ জলাধার থাকা প্রয়োজন, সেখানে রাজধানীতে আছে মাত্র ২ শতাংশ। ফলে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জায়গাও নেই।’
ডিএনসিসি সূত্র জানায়, গত তিন বছরে ডিএনসিসি ৫১৩.৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ১৯৫.২৯ কিলোমিটার রাস্তা, ১৮১.২৭ কিলোমিটার নর্দমা এবং ৩৫.৭৬ কিলোমিটার ফুটপাত নির্মাণ ও উন্নয়নের কাজ করেছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্ষা শুরুর আগেই ডিএনসিসির বিভিন্ন ওয়ার্ডে ড্রেন পরিষ্কার করা হয়েছে। তার পরও অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে কিছু এলাকায় পানি জমেছে। তবে ডিএনসিসির রেসপন্স টিম দ্রুত ওই সব এলাকা থেকে পানি সরিয়ে নিয়েছে। নালা-নর্দমা কম থাকায় তিন বছর ধরে নতুন ১৮টি ওয়ার্ডসহ বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় উন্নয়নকাজ চলমান রয়েছে।’

এদিকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে দুই বছর ধরে নালা সংস্কারের কাজ করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। কিন্তু সুফল মিলছে না। সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবে যাচ্ছে সড়ক। ভারি বৃষ্টিতে পানি সরতে অনেক সময় লাগছে। বৃহস্পতিবারের বৃষ্টিতে পুরান ঢাকার কাজী আলাউদ্দীন রোডসহ বিভিন্ন সড়কে পানি জমে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়।

ডিএসসিসির প্রকৌশলীরা বলছেন, কাজী আলাউদ্দীন সড়ক, আগা সাদেক সড়কসহ আশপাশের সড়কের পানি সরাতে নতুন করে আরেকটি সংযোগ লাইন তৈরির পরিকল্পনা করছেন তাঁরা। ওই সংযোগ লাইনের কাজ শেষ হলে এসব এলাকার পানি সহজে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়বে। এতে পুরান ঢাকার বাসিন্দারা জলাবদ্ধতার ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির পরিবেশ সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খায়রুল বাকের কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বৃষ্টি হলে পানি জমবে, সেই পানি কত দ্রুত সরছে, এটি হচ্ছে বিষয়। আজিমপুর, পলাশী, বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ মার্কেটসহ আশপাশে পানি জমার অন্যতম কারণ, বিজিবির সদর দপ্তরের ভেতর দিয়ে পানি নামার যে নালা ছিল তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে ভারি বৃষ্টি হলে এসব এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়।’

তিনি বলেন, ‘চারপাশের পানি সরার পথ বন্ধ করে দেওয়ায় পানি জমছে। সবাই যদি নিজেদের প্রয়োজনে নালা বন্ধ করে দেয় তাহলে পানি সরবে কিভাবে! আমরা স্থানীয় পর্যায়ে ১৩৬টি পয়েন্ট থেকে ১০৩টির সমাধান করেছি। এখন মাস্টারপ্ল্যান করে এগোতে হবে। কারণ রাজধানী থেকে নদী-খালে পানি সরার প্রধান কোনো লাইন নেই। এটি করা গেলে দ্রুত পানি নেমে যাবে। সঙ্গে মানুষকেও সচেতন হতে হবে। পরিষ্কার করতে গিয়ে আমরা ড্রেনের মধ্যে জাজিম, লেপ-তোশক, কম্বল, মরা গরুসহ অনেক কিছু পাই। এসব ফেলে ড্রেন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।’

দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, যেখানে পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে সেখানকার পানি সরাতে নেওয়া হয় প্রকল্প। এভাবে গত তিন বছরে পানি জমে থাকা ১৩৬টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব স্থানে নর্দমাসহ অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। এ কাজে সংস্থাটির ব্যয় ২২৫ কোটি টাকা।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/09/24/1320885