২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, রবিবার, ৬:০৩

মধ্যবিত্তরাও ছুটছেন ওএমএস’র ট্রাকে

বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে বারোটা। ধানমণ্ডির রায়ের বাজার মেরিস্টপ এলাকায় ওএমএস’র ট্রাক সেলের বিক্রয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলছিলেন মধ্যবয়সী এক পুরুষ। কাছে গিয়ে জানা যায়, তার পণ্য কেনার নির্ধারিত কার্ড নেই। তবে ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি দিয়ে ৫ কেজি চাল আর আটা নিতে চান তিনি। কিন্তু নির্ধারিত কার্ড ছাড়া কিছু দিতে নারাজ বিক্রয় কর্মীরা। এটা নিয়েই তাদের এই বচসা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি বলেন, কী করবো ভাই। বাজারে দ্রব্যমূল্যের যে অবস্থা। আমাদের মতো মানুষের যা আয়, তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এরপর বাসা ভাড়া, বাচ্চাদের লেখাপড়ার খরচ টানতে জীবন বেরিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিদিনই মনে হচ্ছে যুদ্ধে নামছি। বাজারে গেলে এক কেজি চাল ৭৫ টাকা দিয়ে কিনতে হয়। তাই ভাবলাম এই ওএমএস’র ট্রাক থেকে যদি কম দামে কিছু চাল নিতে পারি তাহলে অন্তত চালের খরচ কিছুটা লাঘব হবে। কিন্তু এখানেও কার্ড।

ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের সবচেয়ে বেশি সমস্যা। না পারি কোনো নিচু কাজ করতে, না পারি ভালোভাবে বাঁচতে। একবেলা না খেয়ে থাকলেও মুখে হাসি নিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়। কিন্তু আর পারছিনা। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে এখানে এসেছি। কোনো পরিচিত লোক দেখে ফেলে কিনা সেটা ভেবেও খুব লজ্জা পাচ্ছি। তিনি বলেন, আগে একদিন গোপনে শুনে গেছি- কার্ড না থাকলেও ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি, ছবি আর মোবাইল নম্বর দিয়ে ওএমএস’র ট্রাক থেকে পণ্য কেনা যায়। এজন্যই আজকে সেসব জোগাড় করে নিয়ে আসলাম। কিন্তু এরা আটা দিলেও চাল দিতে চাইছে না। বলছে- যোগান কম। অনেক অনুরোধ করার পর অবশেষে চাল দিতে রাজি হয়েছে।

কম দামে চাল কিনতে আসা মিরাজ নামে এক রিকশাচালক বলেন, আসলে বাজারের যেই অবস্থা তাতে করে একজন মানুষের ইনকামে কারোরই সংসার চালানো সম্ভব নয়। আগে ৫শ’ টাকায় একটা সংসারের পুরো বাজার হলেও এখন একটা তরকারি রান্না করতেই সেই টাকা লাগে। তাই যেখানে একটু কমে পাচ্ছে সেখানেই ছুটছে মানুষ। ট্রাক সেলের বিক্রেতা আলাউদ্দিন বলেন, আগে শুধু গরিব মানুষ এখান থেকে জিনিস কিনতো। রিকশাচালক ও বস্তির লোকজন আসতো। এখন নিম্নবিত্ত মানুষের পাশাপাশি অনেক শার্ট-প্যান্ট পরা লোকও ট্রাকে পণ্য কিনতে আসছেন। বাজারে দাম বেশি হওয়ায় ট্রাকে ভিড় বাড়ছে। নম্র-ভদ্র মানুষ এসে অনুরোধ করলে আমাদের কিছু করার থাকে না। তাই বাধ্য হয়ে কার্ড না থাকা এসব মানুষের ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি নিয়ে মাল দিচ্ছি।

এদিকে ধানমণ্ডি জিগাতলা এলাকাতেও বৃহস্পতিবার ওএমএস’র ট্রাক সেলে পণ্য বিক্রি হয়। সকাল থেকে মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পরার মতো। নিম্ন আয়ের মানুষের লাইনে মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরাও। হাবিবুর রহমান নামে এক ব্যক্তি বললেন, প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু সেই হিসাবে আমাদের আয় বাড়ছে না। এই আয় দিয়ে চলাটা খুবই কষ্টকর। উল্টো বিভিন্ন খাতে খরচ বাড়ায় আয়-ব্যয়ের হিসাব দিন দিন জটিল হয়ে পড়ছে। তাই এখানে এসেছি। আমার মতো অনেকেই এসেছেন। মানসম্মানের ভয়ে লজ্জা পাচ্ছেন। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির বাজারে সকলেই নাজেহাল। পরিবারের দিকে তাকিয়ে কেউ কোনো কথা বলছেন না। কিন্তু হাতেগোনা কিছু মানুষ ছাড়া বেশির ভাগেরই বেহাল দশা।

এসব বিষয়ে ওএমএস’র ট্রাক সেল বিতরণের তদারকির দায়িত্বে থাকা উপ-খাদ্য পরিদর্শক আতাউর রহমান বলেন, বাজারে দাম বেশি হওয়ায় আগের চেয়ে ট্রাক সেলে ভিড় বেড়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরাও ট্রাকে পণ্য কিনতে আসছেন। সকলেই চান কমদামে পণ্য কিনতে। এদের মধ্যে ৩০ টাকা কেজি দরে চালের চাহিদা বেশি। কিন্তু আমাদের ২ টন আটা বরাদ্দ থাকলে চালের বরাদ্দ থাকে ১ টন। যতক্ষণ পণ্য থাকে ততক্ষণ আমরা মানুষের মাঝে ভর্তুকি মূল্যে বিতরণ করি। মজুত শেষ হয়ে গেলে আমাদের কিছুই করার থাকে না।

https://mzamin.com/news.php?news=75486