২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, রবিবার, ৪:২১

নির্বাচন: লক্ষ্য একটাই, বিজয়ী হবে গণতন্ত্র

-সালাহউদ্দিন বাবর

সূর্যাস্তের পর রাত্রি যাপন শেষে আর এক সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষায় থাকে সবাই। প্রতিটি পুরনো দিন সাঙ্গ হয়ে রাত এলে একটি শুভ্র সুন্দর প্রভাতের প্রত্যাশায় থাকাটাই স্বাভাবিক। আশাবাদ শেষ হয়ে গেলে জীবন অর্থহীন ও মানুষ জীবন্মৃত হয়ে থাকে। আজ এ জনপদের সব মানুষ অনিবার্য মনে করে নতুন সম্ভাবনার এক প্রভাতের। যে প্রভাতে সূর্যের সাত রঙের বর্ণচ্ছটা সাতেরও বেশি দিক নিয়ে মানুষের বুকের ভেতর আশাবাদের বীজ বপণ করতে পারবে। অনেকে হয়তো এ কথাও ভাবতে পারেন বা বলতে পারেন, পুরনো জানিয়া কাউকে করো না হেলা। সবসময় পুরনোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াও ঠিক নয়। তাদের বোধ হয়তো এই, ‘যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন’। এ ভূ-ভাগের কোটি মানুষ যত্রতত্র বহু কিছু উড়িয়ে দেখেছে। সেখানে অমূল্য রতনের সন্ধান মেলেনি। কেবলই দেখা গেছে ভষ্ম আর হাজারও ব্যত্যয়। শোনা যায়, দুঃস্বপ্নের যত বেদনাবিধূর রাগিণী। স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ। আর দুর্ভোগ দুর্দশা।
এই সুন্দর শুভ্র প্রভাবের প্রকৃত ব্যাখ্যাটা আসলে কেমন! বিষয়টি পরিষ্কার করা অবশ্যই জরুরি। এর একটি ছোট্ট জবাব রয়েছে। চলতে থাকা ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে ‘গুড গভর্নেন্স’এর প্রত্যাশা। গুড গভর্নেন্স অর্থাৎ সুশাসনের কামনা। যার অভাব এই মুহূর্তে গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে। সুশাসনের ব্যাপ্তি-পরিধি ও বিস্তৃতি অনেক দীর্ঘ। এর হাত অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত। সেই হাতের ছোয়ায় সোনা ফলে। যেমন একটি বরফখণ্ডের ভেতর হাজার লিটার পানি জমাটবদ্ধ থাকে। তেমনি সুশাসন বলতে ব্যাপকভিত্তিক একটা ইতিবাচক ধারণা তৈরি করে। চিন্তায় কর্মে সর্বত্র যোগ্যতা সক্ষমতা ও জনমুখিতার স্ফূরণ লক্ষ করা যায়। বর্তমান শাসনব্যবস্থা বা প্রশাসনিক ব্যবস্থার যে চিত্র। দীর্ঘ সময় থেকে মানুষ দেখে আসছে, সেটা বৈশিষ্ট্যহীন আর বিবর্ণ। কোথাও তার কল্যাণ স্পর্শ নেই। তারপরও তা নিয়ে প্রচুর ঢাক-ঢোল পেটানো হয়। সেটা আসলে ‘সুগার কোটিন’ দেয়া ‘কুইনাইন’-এর গুলি। মানুষ সেটা চেয়ে দেখে মুহূর্তেই তার বিস্বাদটা টের পেয়ে যায়। তারপরও এ নিয়ে কত গুণগান আর বাগাড়ম্বর।

সুশাসনের অন্বেষণ তখনই শেষ হতে পারে যখন এই ভূ-ভাগের মানুষের অনুভব-অভিব্যক্তির প্রতি সম্মান দেখানো হবে। তাদের ভাগ্য বিনির্মাণের দায়িত্ব তাদের হাতে তুলে দেয়া হবে। অর্থাৎ তাদের পছন্দের যোগ্য, দক্ষ ও আস্থাভাজনদের বেছে নেয়ার মতো একটা ভোট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা যাবে। সেই ‘ভোট ব্যবস্থা’ সব মহলের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করবে। প্রশ্নমুক্ত প্রতিযোগিতামূলক ও গ্রহণযোগ্য ভোট অনুষ্ঠানের পূর্ব শর্ত হচ্ছে এমন এক প্রশাসনের অধীনে ভোট হতে হবে, যাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে কারো কোনো কথা থাকবে না। ইতিপূর্বে দেশের মানুষ দেখেছে, বর্তমান ক্ষমতাসীন প্রশাসনের অধীনে যত নির্বাচন হয়েছে, তার একটিতেও ভোটাররা ভোট দিতে পারেনি বা ভোট দিতেই আসেনি। ঘরে-বাইরে ওই সব নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। সব নির্বাচনের পূর্বনির্ধারিত একটি লক্ষ্য ছিল। সে লক্ষ্য নির্ধারণ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ। সুনির্দিষ্ট সে লক্ষ্য অর্জনের জন্য ভোটের নামে যথেচ্ছাচার করা হয়েছে। নির্বাচন শেষে দেখা যায়, সর্বত্রই ক্ষমতাসীনদের একচেটিয়া বিজয়। এভাবেই তাদের বারবার ‘নির্বাচিত’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। গত ১৫ বছর থেকে এমনটাই ছিল নির্বাচনের চেহারা।

২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে যে নির্বাচন হওয়ার কথা। সেখানে ইসি ও সরকার যৌথভাবে একই নিয়মে অতীতের মতো নির্বাচনের নামে এক প্রহসন মঞ্চস্থ করতে চাচ্ছে। সেই প্রহসনের লক্ষ্য হচ্ছে পূর্বেরই মতো। বিজয় অর্জনের নিমিত্ত মাত্র। এমন নির্বাচন কেমন করে নির্বাচন হতে পারে, যার ফলাফল পূর্বেই ঠিক করে রাখা হয়? এমন যৌথ প্রযোজনার নির্বাচনে দেশে কস্মিনকালেও প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের বিজয়ী হয়ে আসা সম্ভব নয়। এমন নির্বাচনে বারবার দেশের মানুষের আর গণতন্ত্রের পরাজয় ঘটেছে। এখন এমন ‘ভোটের আসর’ জমানোর জন্য নানা কথা বলা হচ্ছে। জনগণ ভোট দিতে এলেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়ে যাবে। কোনো খেলায় প্রতিপক্ষ দল না থাকলে সেটা আর খেলা হয় না। মাঠ ফাঁকা শিশুদের নিয়ে খেলার চেষ্টাকে পুতুল খেলাই বলা যায়। সেখানে কোনো দর্শকই থাকে না। নির্বাচনে প্রকৃত রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে বাদ রেখে যদি ‘শিশু দল’ গুলো নিয়ে ভোট-ভোট খেলা হয়, সেই পুতুল খেলার মতো নির্বাচনকে নির্বাচন বলা হয় না। সেটি কেবল তামাশা হতে পারে। এমন নির্বাচনী তামাশায় এ দেশের সচেতন মানুষ কখনো মেতে উঠবে না। যেমন অতীতে মাতেনি। বহুবার লক্ষ করা গেছে, এমন তামাশার নির্বাচনে দশ ভাগ ভোটারও কেন্দ্রে যায়নি।
এবার একটু অতীতের দিকে তাকানো যেতে পারে। নিকট অতীতে নয়। বছর ২৫ আগে যারা ক্ষমতার চর্চা করেছে। তারা ক্ষমতা চর্চার মেয়াদ শেষ হলেই ছুটে যেত জনগণের দুয়ারে। তাদের কাজের একটা মূল্যায়ন জানতে। অনুমোদন না পেলে নিজেদের বিচ্যুতিগুলো নিয়ে ভাবত। দেয়ালের লেখন পাঠ করত। সুধীজনের ধরিয়ে দেয়া ভুলগুলো বুঝতে চেষ্টা করত। সংবাদপত্রের সমালোচনাকে গ্রাহ্য করা হতো, বিবেচনায় নেয়ার চেষ্টাও হয়েছে।

ওই সব শৈলীকে এখন ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। এখন ক্ষমতাসীনরা মনে করে তাদের কাজের মূল্যায়নের জন্য তারাই যথেষ্ট। তাদের বরকন্দাজ, পাইক-পেয়াদা, তোষামোদকারীদের বাক্যবচন অমৃত্যের সমান। ভিন্নজনের কথা শোনাকে কর্ণদূষণের সমতুল্য মনে করা হয়। তাদের এমন বোধকে ঘরে-বাইরের কেউ ধর্তব্যে না নিলেও তাতে তাদের কোনো পরোয়া নেই। এই ভিন্নমত পোষণকারীদের ব্যাপারে তাদের ধারণা হচ্ছে, ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’। এসব ধ্যান ধারণা থেকে ক্ষমতাসীনদের অহমিকা আত্মম্ভরিতাই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এখন রাজনৈতিক প্রশাসন থেকে বারবার জোর গলায় বলা হচ্ছে, তারা সুষ্ঠু নির্বাচন চান। তবে তাদের শর্ত অবশ্যই সে নির্বাচন তাদের অধীনেই হতে হবে। এমন উচ্চারণকে কেউ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছেন না। কেননা অতীতে অন্তত কয়েকবার ভালো নির্বাচন হয়েছে, নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের অধীনে। সেটাই এখন সবাই চাচ্ছে। অথচ বর্তমান ক্ষমতাসীনদের অধীনে দুটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। তার একটাও ঘরে-বাইরে কোথাও বৈধতা বা গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে পারেনি। সেজন্য ভালো নির্বাচনের আকাক্সক্ষা প্রকাশ ও তাদের অধীনে ভোটের দাবি তোলা পরস্পর সাংঘর্ষিক এবং সেই উদ্দেশ্য ঘিরে একটা দুর্গন্ধ পাচ্ছে ওয়াকিবহাল মহল। এই মহলের আশঙ্কা এমন নির্বাচনের ফল হবে অতীতের মতো অভিন্ন। বিজয়ী হবে ক্ষমতাসীন দল আর পরাজিত হবে কোনো দল নয়। জনগণের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র। হেরে যাবে মানুষের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ঐতিহ্য।

পূর্বে যত ব্যত্যয়ের কথা বলা হয়েছে, তাকেই ক্ষমতাসীনরা এখন নিজেদের সাফল্যের তোরণ হিসেবে বিবেচনা করছেন। সেই সাথে গর্বভরে বলা হয়, এখন সুষ্ঠু সুন্দর ও সচ্ছন্দ গতিতে দেশ চলছে এবং চলবে। এই প্রেক্ষিতে কারো কারো মনে হঠাৎ করে, পুরনো দিনের দূরাগত একটি সঙ্গীতের কলি ভেসে আসতে পারে- ‘হায়রে কপাল মন্দ/চোখ থাকিতে অন্ধ।’ যাই হোক, মানুষ এখন নানা ব্যত্যয়ের মধ্যে দিন যাপন করছে। তবে সেই ব্যত্যয়ের কথা ও রহস্য নিয়ে কথা বলা যাবে না। কেননা ভয় আছে। কথা বললে, রহস্য ভেদ করলেই এনালগ নয় ডিজিটাল আইন আছে। তাতে যে কেউ ফেঁসে যেতে পারেন। তার আশঙ্কা অনেকখানি। সেজন্য শুধু প্রার্থনা নয়। এসবের প্রতিস্থাপনের লক্ষ্যে মাঠে ময়দানে সবাইকে তৎপর ও তদবির করতে হবে। অতীতে বারবার বহুবার গণতন্ত্রের লড়াইয়ে দেশের মানুষ মরিয়া হয়ে লড়েছে। প্রতিপক্ষের পরাজয় না দেখে তারা ময়দান থেকে হটে আসেননি। এখনো সেই উদাহরণ দেখা যাচ্ছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে লড়াই চলমান তা থেকে কেউ হটছে না। রাজপথে লাখো জনতার পদভারে প্রকম্পিত হয়ে উঠছে চারিধার।
ndigantababar@gmail.com

 

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/779380