২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৫:১৬

ভুলে ভরা নদীর তালিকা

দেশে নদীর সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের যেন শেষ নেই। একেকজন একেক রকম সংখ্যা বলছেন। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নদনদীর যে খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে, সেটিও ভুলে ভরা। অনেক নদীর ক্ষেত্রে উৎসমুখ, উৎপত্তিস্থল, গতিপথ, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা উল্লেখ করা হয়নি। একই নদীর নাম এসেছে একাধিকবার। আবার কোথাও কোথাও এলাকার নামকে নদীর নাম বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র জলাশয়কেও নদী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্তত ৫৫টি নদীর ক্ষেত্রে উৎসমুখ ও দৈর্ঘ্য ভুল লেখা হয়েছে। আবার তালিকা থেকে বাদ পড়েছে অসংখ্য নদী। তালিকা পর্যালোচনা করে এ রকম ভুল ও অসংগতি তুলে ধরেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)।

নদী গবেষকরা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন প্রকাশিত নদীর সংখ্যার সঙ্গেও একমত নন। তবে নদী কমিশন বলছে, এটি চূড়ান্ত তালিকা নয়। খসড়া তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশের পর যেসব মত, আপত্তি এসেছে, তা গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনার পর চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা হবে।

খসড়া তালিকা গত ১০ আগস্ট জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। ২০১৯ সালে সংস্থাটি নদনদীর তালিকা তৈরির কাজ হাতে নেয়। খসড়া তালিকায় নদী ৯০৭টি। তালিকায় অনেক স্থানে উপজেলার নাম ভুল রয়েছে। একই উপজেলার নামে একাধিক বানান লেখা হয়েছে।

আরডিআরসি তাদের পর্যালোচনায় জানিয়েছে, হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী নদী চিহ্নিত করতে হবে সিএস অনুসারে। অথচ কোন জরিপ রেকর্ডের ভিত্তিতে নদী কমিশন খসড়া তালিকা তৈরি করেছে, তা উল্লেখ নেই। নদী কমিশনের তালিকায় থাকা অন্তত ৬২টি নদীর দৈর্ঘ্য উল্লেখ করা হয়েছে এক কিলোমিটার বা তার চেয়ে কম। তালিকায় ৩ কিলোমিটারের কম দৈর্ঘ্যের নদী রয়েছে কমবেশি ২০৭টি। কম দৈর্ঘ্যের কারণে এগুলোর প্রবাহ নেই। উৎসে প্রবাহ সৃষ্টি না হলে কোনো জলাধারকে নদী বলা যাবে না। চরগাঙ নদীর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ দেওয়া হয়নি। নদীর আয়তন মাত্র দশমিক ৭ একর, এ ধরনের জলাধারের প্রস্থ ৩০ মিটার ধরা হলেও দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ৯৪ দশমিক ৪৬ মিটার, যা নদী হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। এ বিবেচনায় প্রকাশিত তালিকা থেকে ৩০০ নদী বাদ দিলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তালিকায় থাকবে ৬০৭টি নদী।

৬৩৩টি নদীর উৎসমুখ ও ৬৩২টি নদীর পতনমুখের তথ্য উল্লেখ নেই। ৩৩টি নদীর দৈর্ঘ্যের কলামে আয়তন বা একর লেখা রয়েছে। ফলে নদীর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ অনুমান করা যাচ্ছে না। ১৫টি নদীর দৈর্ঘ্য উল্লেখই করা হয়নি।

তালিকায় একাধিকবার এসেছে চারটি নদীর নাম। স্থানের নামকে নদীর নাম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিজনা-গুন্দাইজরী (বানিয়াচং) নদী নামে কোনো নদী নেই। গোলাপগঞ্জকে সব স্থানে গোপালগঞ্জ বলা হয়েছে। যেমন কুশিয়ারা নদী সিলেটের গোলাপগঞ্জে, কিন্তু লেখা হয়েছে গোপালগঞ্জ। বিশ্বনাথ উপজেলায় মাকুন্দা নদী ৮৫ কিলোমিটার দেখানো হয়েছে। বাস্তবে বিশ্বনাথে এর অবস্থান নেই। মহানন্দা নদীর উৎসমুখ কলামে লেখা হয়েছে ‘ভারত (ভোলাহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ)’। এতে উপজেলাগুলো ভারতভুক্ত বলে মনে হবে। এ রকম ভুল রয়েছে অন্তত ৫৫টি নদীর ক্ষেত্রে। যমুনা দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদীর একটি হলেও এর উৎসমুখ বা পতনমুখ কিংবা জেলা-উপজেলার উল্লেখ নেই। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ দেখানো হয়েছে হিমালয় ও দেওয়ানগঞ্জের উজানে।

দুটি উপজেলা এবং একটি জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ধনু নদীর দৈর্ঘ্য উল্লেখ করা হয়েছে ৩০৩ কিলোমিটার। রাজধানীর উত্তরখান, খিলক্ষেত, গুলশান, তেজগাঁও, ডেমরাকে এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, বাকলিয়া ও পতেঙ্গাকে বলা হয়েছে উপজেলা। ডাকাতিয়া নদী চট্টগ্রাম জেলার বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

তালিকার ৭৮১ ও ৮১২ ক্রমিকে গড়াই নদীর নাম দুইবার উল্লেখ করা হয়েছে। নদী দুটির উৎসমুখ, পতনমুখ ও দৈর্ঘ্য একই। উপজেলা কলামে উপজেলার নামও একই। হরিহর নদীর পতনমুখ ‘হাপরখালী’ নদী দেখানো হয়েছে। কিন্তু ৯০৭ নদীর তালিকায় ‘হাপরখালী’ নদী নামে কোনো নদী রাখা হয়নি। আড়পাঙ্গাশিয়া শুধু কয়রা উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অথচ এর দৈর্ঘ্য ৬০ কিলোমিটার বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট এক রায়ে বলেছেন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন দেশের সব নদনদীর অভিভাবক। নদীর সঠিক সংখ্যা ঠিক করার দায়িত্বও তাদের। এই রায়ে আদালত দেশের সব নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবেও উল্লেখ করেছিলেন।
তালিকা থেকে বাদ অসংখ্য নদী।

আরডিআরসি পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা তথ্য বাতায়ন এবং বিভিন্ন লেখক ও গবেষকের লেখা থেকে ১৬৫০-এর বেশি নদীর নাম পেয়েছে, যা নদী কমিশনের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকাভুক্ত ৪০৫টি নদীর মধ্যে ১৩৯টির নদীর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের খসড়া তালিকায় রংপুর বিভাগে বাদ পড়া ১০৫টি নদীর তালিকা ‘রিভারাইন পিপল’ সম্প্রতি কমিশনের চেয়ারম্যানের হাতে তুলে দিয়েছে। এ ছাড়া বেশকিছু জেলা থেকে বাদ পড়া নদীর তালিকা জমা পড়েছে নদী কমিশনে।
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, নির্ভুলভাবে নদীর তালিকা প্রণয়ন জরুরি। বাদ পড়া নদীর নাম জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে যাচাই করে পূর্ণাঙ্গ তালিকা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

এ বিষয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘রংপুরের ১০৫টি নদীর তালিকা আমরা দেখেছি। সেখানে অনেক খাল। চাকিরপশাকে নদী বলে দাবি করা হচ্ছে। আসলে এটি বিল। তারপরও বাদ পড়া বেশ কয়েকটি নদীর তালিকা আমরা জেলা প্রশাসককে যাচাই-বাচাইয়ের জন্য পাঠিয়েছি। এ রকম অনেক নদী আছে, যেগুলো খাল। ফলে তালিকায় আসেনি। শুধু পানি দেখলেই নদী বলা যাবে না।’

তিনি বলেন, ‘নদীর সংখ্যার তালিকা খসড়া। এতে ভুল-ভ্রান্তি থাকতে পারে। সবার মতামতের জন্য দেওয়া হয়েছে। যত দিন যাবে তত নদীর সংখ্যা বাড়বে, কিছু বাদ পড়বে, ভুল সংশোধন হবে। আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে তালিকাটি বই আকারে প্রকাশ করা হবে। বইয়ের পেছনে একটি ফরম দেওয়া হবে। বইটি সবার হাতে তুলে দেওয়া হবে। ভুলগুলো ওই ফরমে লেখা হবে। সেটি আমরা যাচাই-বাছাই করে জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠিয়ে দেব। পরবর্তী সংস্করণে এ তালিকা আরও সমৃদ্ধ হবে।’

https://samakal.com/bangladesh/article/2309197565