২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৫:০৩

ডেঙ্গু প্রতিরোধ না হওয়ার কারণে এত মৃত্যু

ডেঙ্গুর ছোবলে মৃত্যু। এ বছর প্রায় ৯০০ জনের প্রাণহানি হয়েছে ডেঙ্গুতে। প্রতিদিনই ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে দিন যত যাচ্ছে, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির ততই অবনতি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগী বাড়লেই মৃত্যু বাড়বে। আর এতে ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে নারীরা। হাসপাতালে ভর্তি এবং আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। কোনোমতেই থামানো যাচ্ছে না ডেঙ্গুর ভয়াবহ অগ্রযাত্রা।
ডেঙ্গুতে এতো মৃত্যুর কারণ কী? জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধ না হওয়ার কারণে দেশে এতো প্রাণহানি হয়েছে। এছাড়া রোগীরা চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে দেরিতে আসছেন। মৃত্যুর আরেকটি কারণ হিসেবে বাংলাদেশের আবহাওয়াকেও দায়ী করেছেন তারা। বাংলাদেশে ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ বিস্তারের জন্য জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী মনে করছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বিশেষজ্ঞরাও।

বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৬৫ সালে।
তখন এই রোগটি ঢাকা ফিভার নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে রোগটির সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। ২০২২ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ ছিল। সেই বছরে দেশে সর্বোচ্চ মারা যায় ২৮১ জন। তখন এটাই ছিল সর্বোচ্চ প্রাণহানি। এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু খুবই দ্রুত বাড়ছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৯০০ প্রাণহানি হয়েছে। আক্রান্ত প্রায় দুই লাখ। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ অনেক ডেঙ্গু রোগী বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন, তাদের হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের খাতায় নেই। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দিতে সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য বিভাগের পরিকল্পনায় ঘাটতি ছিল। তাদের অভিমত, এক সময় বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগটিকে ‘মৌসুমি রোগ’- বলে মনে করা হতো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বছরজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

ডেঙ্গুতে মৃত্যু কেন বেশি জানতে চাইলে দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা নেই। ফলে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। মৃত্যু বাড়ছে। রোগীরাও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে দেরিতে আসছেন। ফলে হাসপাতালে মৃত্যুর হার বেড়ে যাচ্ছে। তবে হাসপাতালগুলো মৃত্যুর প্রতিটি কারণ বিশ্লেষণ করলে বৈজ্ঞানিক তথ্য পাওয়া যাবে। এখনও আমরা বৈজ্ঞানিক কোনো তথ্য পাইনি। মশা দমনে দেশজুড়ে বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এমনকি এখন মশা দমনে ব্যবহৃত ওষুধের কার্যকারিতা আছে কি না, তা কারও জানা নেই। আর স্বাস্থ্য বিভাগ এখন পর্যন্ত ভাইরাসজনিত রোগ ডেঙ্গু নিয়ে কোনো কার্যকর গবেষণা করতে পারেনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়নসহ বিভিন্ন কারণে এখন সারা বছরই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট(আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা এবং সংস্থাটির সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি সিরিয়াস না হয় তাহলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের কাজটি সফল করা খুবই কষ্টকর। ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে জনসম্পৃক্ততার বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন এই জনস্বাস্থ্যবিদ। তিনি বলেন, আমাদের কমিউনিটি এনগেজমেন্টের ব্যাপারটা হচ্ছে না। ডেঙ্গুর সোর্স হচ্ছে এডিস মশা এবং রোগী। ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে দু’টো সোর্সকেই আটকাতে হয়। এটা কমিউনিটি এনগেজমেন্ট ছাড়া অসম্ভব।

কীটতত্ত্ববিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেছেন, ডেঙ্গু এবং এর বাহক মশা সম্বন্ধে আমরা সবাই অবগত এবং এর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও আমাদের জানা। তারপরেও আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কেন ব্যর্থ হচ্ছি। তিনি বলেন, ডেঙ্গু সংক্রমণ কম বা বেশি হওয়া নির্ভর করে, ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকার জনসাধারণের জ্ঞান, মনোভাব এবং এডিস মশার প্রজনন রোধে তাদের কার্যক্রম। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সঠিক ও সময়োপযোগী কার্যক্রম। তাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম আরও বেগবান করার পরামর্শ দেন তিনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরও প্রস্তুত থাকতে হবে অধিক ডেঙ্গু রোগী ব্যবস্থাপনার।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী তার এক প্রবন্ধে বলেছেন, যেকোনো শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার কতগুলো মৌলিক নীতি রয়েছে। তার অন্যতম হচ্ছে- শত্রুর সামর্থ্য, বিস্তৃতি, স্বভাব চরিত্র, আঘাত হানার ক্ষমতা ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করা। বিষয়টি ডেঙ্গু প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ। ডেঙ্গুর বাহক হলো এডিস মশা। তিনি বলেন, মশা নির্মূলের বেশ কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। আমাদের মতো দেশের জন্য রাসায়নিক, পরিবেশগত ও জিনগত নিয়ন্ত্রণের সমন্বয়ে গঠিত একটি কর্মকৌশল গ্রহণ করা উত্তম। রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ হলো ওষুধ দিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক বা উড়ন্ত মশা এবং মশার লার্ভা বা শূককীট মেরে ফেলা। এখন রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মশা মারার কার্যকর কর্মসূচি নির্ধারণ করা দরকার বলে তিনি মনে করেন। এই কর্মসূচিতে রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণও যুক্ত রাখতে হবে। এই লক্ষ্যে জনপ্রতিনিধি ছাত্র, যুবক, স্বেচ্ছাসেবী, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সর্বস্তরের জনসাধারণকে যুক্ত করে পাড়া- মহল্লা এলাকাভিত্তিক ‘মহামারি প্রতিরোধ কমিটি’- গঠন করা জরুরি। ডেঙ্গু প্রতিরোধের আরেকটি দিক হলো, আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করা। এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, শুধুমাত্র চিকিৎসা দিয়ে ডেঙ্গুর হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। এটা শুধু আমাদের দেশ কেন পৃথিবীর কোনো দেশেই সম্ভব নয়। কারণ কোনো দেশের হাসপাতালে অগণিত সংখ্যার শয্যা থাকে না। কেবলমাত্র এডিস মশার দ্বারাই মানুষের শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাস প্রবেশ করে। এজন্য ডেঙ্গু প্রতিরোধের কার্যকর উপায় হচ্ছে এডিস মশা নির্মূল করা।

https://mzamin.com/news.php?news=75360