২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৪:৫৯

কেন এই বিপর্যয়?

সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা। টানা ৬ ঘণ্টায় ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টি। আর এতেই তলিয়ে গেছে রাজধানী ঢাকা। পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে শহরের ব্যস্ত এলাকাগুলোতেও তৈরি হয়েছিল জলাবদ্ধতা। কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও কোমর পানিতে নাস্তানাবুদ হয়েছে নগরবাসী। জলাবদ্ধতার কারণে সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হয়েছে মানুষকে। সড়কে নষ্ট হয়েছে অনেক যানবাহন। ঘটেছে মৃত্যুর মতো হৃদয়বিদারক ঘটনাও। ঢাকার জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনাই এর প্রধান কারণ। শহরের ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত অবকাঠামো তৈরি হয়েছে।

দখল হয়েছে অসংখ্য পুকুর, খাল, ঝিল। অপরিকল্পিতভাবে সাজানো হয়েছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা। এতে সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাব্ধতা সৃষ্টি হয়।
ঢাকা শহর প্রকৃতিগতভাবে জলাবদ্ধ হওয়ার কথা না বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ঢাকা কচ্ছপের গতির মতো একটি শহর। দুই পাশে বন্যা প্রবাহ। সেভাবে পরিকল্পনা করে যদি শহর গোছানো যেতো তাহলে অবশ্যই বৃষ্টির পানি গড়িয়ে গড়িয়ে খালের মাধ্যমে চার পাশের নদীতে চলে যেতো। কিন্তু সেভাবে পরিকল্পনা হয়নি। তিনি বলেন, আমাদের ভরা বর্ষায় ৮০ থেকে ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হবে না সেটা অস্বাভাবিক ব্যাপার।

১৯৮৮ সালের বন্যাতেও এই নগরীর এমন ভয়বহ প্রকোপ আমরা দেখিনি। ৮৮’ এর ঘটনা ছিল এমন যে, আমাদের ঢলের পানি নেমে নদীর পানির উচ্চতা বেড়ে গিয়ে চারদিকে আটকে গিয়েছিল। কিন্তু শহরের ভেতরে এই অবস্থা কখনো ছিল না। এখন নদীর পানির উচ্চতা নিচে থাকা সত্ত্বেও শহরের পানি ৬-৮ ঘণ্টার জন্য আটকে যাচ্ছে। কারণ এখন অসংখ্য ঝিল, বিল, খাল বিলীন হয়েছে। পশ্চিমদিকে বাঁধ দিয়ে শহরকে নদীর সঙ্গে সংযোগহীন করে ফেলেছি। পূর্বদিকে যদিও একটা সুযোগ ছিল কিন্তু মাফিয়া, রিয়েলিস্টিক গোষ্ঠী, ব্যবসায়ীরা সমানে সমস্ত খাল, জলাধারগুলোকে খেয়ে তন্ন তন্ন করেছে। আমরা যদি শহরের ভেতরে পুকুরগুলো রাখতে পারতাম তাহলে এই ঘটনা ঘটার কোনো সুযোগই ছিল না।

জলাবদ্ধতার ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের উদাহরণ টানতেও নারাজ এই পরিকল্পনাবিদ। কেননা ঢাকা শহরের সঙ্গে সেসব দেশের পরিবেশগত অনেক পার্থক্য রয়েছে। তিনি বলেন, মেয়ররা মনে করেন শহরের পানি চুইয়ে চুইয়ে ৬-৮ ঘণ্টা পর চলে যায়। এটাকে কেনো গ্রহণ করা হয়। মাঝারি বৃষ্টির জন্য কেনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা করতে পারবো না। তারা জার্মানি, বম্বের উদাহরণ দিতে পারেন কিন্তু ওই শহর আর আমাদের শহরের অনেক পার্থক্য। আমাদের চারদিকে নদী রয়েছে। অসংখ্য খাল তার সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু আমাদের পানি যাওয়ার পথ রুদ্ধ করা হলো। এসবের জন্য যারা দায়ী তাদের দায়ী করতে পারছি না। আজকে হাতিরঝিল ছিল বলে গুলশানে পানি ওঠে নাই। তাই এখন প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করে হলেও প্রত্যেকটা অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পিত নেটওয়ার্ক তৈরি করে নদীর সঙ্গে কানেক্ট করে দেয়া উচিত।

এই শহরে যে পরিবমাণ ভবন ও অবকাঠামো ধারণ করতে পারে তার কয়েকগুণ বেশি ভবন, অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। ন্যাচারাল ড্রেনেজ সিস্টেম যার বলি হয়েছে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ঢাকার প্রকৃতিক ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। কৃত্রিম যে ড্রেনেজগুলো বানানো হয়েছে তা এই সংখ্যক পপুলেশনের ভার বহন করার মতো অবস্থায় নেই। তাই আইডিয়াল বৃষ্টিপাতেই নগরের ড্রেনেজ চ্যানেলের উপর ৫০ ভাগ চাপ পড়ে। আমাদের বৃষ্টিপাতের ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ পানির চাপ সরাসরি যে ড্রেনেজ দিয়ে যায় তা এই পরিমাণ পানি ধারণ করার জন্য সক্ষম না।

তিনি আরও বলেন, সিটি করপোরেশন যতই বলুক বর্ষায় জলবদ্ধতা থাকবে না কিন্তু অনেক জায়গায় অল্প বৃষ্টিতেও জলাবদ্ধতা হয়। এটা ঢাকার নগর পরিকল্পনার বিদ্যমান অবস্থার ফল। শহরে প্রাকৃতিক যত খাল, পুকুর ছিল তার সবগুলো ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। আগুন নেভাতে যেমন পানি পাই না, তেমন এই ধরনের বৃষ্টিপাত ধারণ করার মতো এই ধরনের পুকুরগুলোর সক্ষমতা নাই। এটার মূল দায়িত্ব যারা নগর সাজাচ্ছে। এসবের জন্য সিটি করপোরেশন আর সরকারের মধ্যে গলদ রয়েছে।

শহরের যতগুলো খাল, বিল, পুকুর ধ্বংস হচ্ছে অধিকাংশের জন্যই সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রসাশন এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রত্যেকের দায়িত্ব ছিল বলেও মনে করেন এই নগর পরিকল্পনাবিদ। তিনি বলেন, বিশেষ করে সিটি করপোরশনের নাগরিকদের হয়ে জলাধার, জলাশয় দখলের বিরুদ্ধে অবস্থান দুর্বল। অধিক সময় রাজনীতিবিদরা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকাতে তারা ভূমিকা নেয় না। আমাদের লোকাল ড্রেনগুলোর ব্যবস্থাপনার অধিকাংশই কয়েক বছর ধরে ময়লা পরিষ্কারের ব্যবস্থা নাই। সিটি করপোরেশন অন্তত এই জায়গায় কাজ করতে পারে।

ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ও নগরবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে জানিয়েছেন, অতিবৃষ্টি হলে ঢাকায় জলবদ্ধতার সমস্যা সব সময় হয়। চেষ্টা করা হচ্ছে এটা কমানোর। খাল পুনঃখনন, উদ্ধার ও সেগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করার। তবে যটতা বলা হচ্ছে ততটা কাজ করা হচ্ছে না। খাল কার্যকর রাখার জন্য যা যা করা দরকার সেই সক্ষমতার অভাব আছে। তিনি বলেন, হংকং এর মতো উন্নত শহরে ১৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে কয়েকদিন আগে। সমস্ত শহর লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। তাদের মতো আমাদেরও হতে পারে। কিন্তু আমরা ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত দুর্বল। এবং যতকথা শুনি সেই তুলনায় কাজ ততটা দেখি না।

ড্রেনেজ নিষ্কাষণের জন্য সিটি করপোরেশনের কাজ কার্যকর হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, খালগুলো পুনরুদ্ধার করা, খনন করা ও সচল রাখার জন্য সর্বাত্মক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সিটি করপোরেশন ওয়াসার থেকে দায়িত্ব নিয়েছে ড্রেনেজের নিষ্কাষণের। এই দায়িত্ব নেয়ার পর যতটা কার্যকর হওয়ার কথা তা হচ্ছে না। এসবে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা যে পরামর্শ দেন সেগুলো কানে নিতে হবে। আর জনবল সংকট থাকলে বাড়াতে হবে। কিন্তু যারা আছে তাদের যে কাজ সেগুলো করাতে হবে।

https://mzamin.com/news.php?news=75364