২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৪:১৩

স্টেশন ও ট্রেনে নাকে রুমাল চেপে ভ্রমণ

ট্রেনে পরিচ্ছন্নতার ৭ কোটি টাকা কোথায় যায়

আন্তঃনগর কয়েকটি ট্রেন পরিচ্ছন্ন থাকলেও অধিকাংশ ট্রেনে জঞ্জাল

রেলপথে যাত্রা নিরাপদ মনে করা হয়। দেশের জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ ট্রেনযাত্রী। বছরে প্রায় ১০ কোটিরও বেশি মানুষ রেলপথে যাতায়াত করেন। রেলপথে যাত্রীসেবার মান বাড়াতে সরকার ট্রেনের সংখ্যা বাড়ায়। সংযোগ বাড়ায়। বগি বা কোচ বাড়ানো হয়। এর পেছনে বছরে শত শত কোটি টাকা ব্যয় হয়। পাশাপাশি যাত্রীদের নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণের জন্য ট্রেনের কামরা, আসন, কেবিন, টয়লেট, দরজা-জানালাসহ নিরাপত্তামূলক সমুদয় কাজ করানোর জন্য মোটা অঙ্কের বরাদ্দ করা হয়। এর মধ্যে শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বাবদই বছরে ৭ কোটি টাকার বেশি বিল করা হয়। কিন্তু যাত্রীদের দুর্ভাগ্য, তাদের সেবার নামে টাকা বরাদ্দ বা ঠিকাদারি বিল তুলে নিলেও ন্যূনতম সেবা নেই যাত্রাপথে।

ট্রেনের কামরা, টয়লেট, সিটের উপরে-নিচে, স্টেশন চত্বরে ময়লা-আবর্জনায় খরা থাকে। আন্তঃনগর ট্রেন যৎসামান্য পরিচ্ছন্ন থাকলেও অধিকাংশ ট্রেনের জঞ্জালের চিত্রটা একই রকমের। ট্রেনের কোথাও দরজা-জানালা ভাঙা, কোথাও তালাবদ্ধ। কিছু ট্রেনে বাতি ও পানির ব্যবস্থা একেবারেই নেই। দুর্গন্ধে কোনো কোনো যাত্রী বমি করে দেন। কেউ নাক চেপে এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশন পর্যন্ত কোনোমতে পৌঁছান। ট্রেনের পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব বেসরকারি খাতের ওপর ছেড়ে দিয়েছে রেলওয়ে। কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিল তুলে নেয়। রেলে পরিচ্ছন্নতার নামে অনেকটা ভাঁওতাবাজি করেই বছরে অন্তত ৭ কোটি টাকা নিয়ে নেয়। এর জন্য কাগজে-কলমে দেখানো হয় ৫০০ দিনমজুর কাজ করে। বাস্তুবে ৪০-৫০ জন নেশাখোর টাইপের যুবকদের দিয়ে দায়সারা পরিচ্ছন্নতার মহড়া দেওয়া হয়।

ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে প্রায়ই ট্রেনে ভ্রমণ করেন ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম সবুজ। সম্প্রতি ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে চলা ওয়ানআপ ট্রেন যাত্রার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, দেখলাম কিছু কামরায় বৈদ্যুতিক বাতিই নেই। কোনোটায় বাতি থাকলেও মিটমিট করে জ্বলছে। টয়লেটের ভাঙা দরজা সুতা-গুনা দিয়ে আটকিয়ে রাখা। জানালার শাটার নেই। ফ্যান থাকলেও অধিকাংশ নষ্ট।

ময়মনসিংহগামী ট্রেনযাত্রী সাইফুল ইসলাম হিরণ বলেন, আন্তঃনগর ট্রেনের এসি কেবিন ও কোচগুলো কিছুটা পরিষ্কার থাকলেও বাকি কোচগুলোতে বাদামের খোসা, ফলের খোসা, খাবারের টুকরো, পানি পড়েই থাকে। আর লোকাল, মেইল ট্রেনগুলোতে জঞ্জালের স্তূপ সব সময় থাকেই। ময়লা-আবর্জনা পচে দুর্গন্ধ ছাড়ায়। যাত্রীদের নাকে রুমাল দিয়ে বসে থাকতে হয়। আরেক যাত্রী সুমন হাওলাদার বলেন, টয়লেটগুলো একেবারেই ব্যবহার অনুপযোগী। মেইল, লোকাল, কমিউটারসহ অধিকাংশ আন্তঃনগর ট্রেনের টয়লেটে পানির পাত্র বা বদনা নেই। লোকাল ও মেইল ট্রেনগুলোতে পানি থাকে না। অনেক সময় নিজেরাই পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের খুঁজে নিয়ে টয়লেট, সিটের নিচ পরিষ্কার করিয়েছেন। কমলাপুর, বিমানবন্দর, আখাউড়া, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ অন্তত ১০টি স্টেশন ঘুরে এই প্রতিবেদকও যাত্রীদের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন।

জানা গেছে, রেলে এখন মঞ্জুরির চেয়ে লোকবল অর্ধেক। যাত্রীসেবা ও নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত ট্রেন ও স্টেশনগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি খাতে। কিন্তু ঠিকাদাররা নামমাত্র পরিচ্ছন্নতার কাজটি করে। ফলে ট্রেনের ভেতর, ট্রেনের টয়লেট, স্টেশন, স্টেশন টয়লেট, প্ল্যাটফরম, প্ল্যাটফরমে থাকা লাইন কখনই যথাযথ পরিষ্কার আর হয় না। বর্তমানে ৪৯৩টি স্টেশন এবং ৩৬৭টি যাত্রীবাহী ট্রেন সচল রয়েছে।

নিয়মিত সব ট্রেনের দরজা-জানালার গ্লাস পরিষ্কার থেকে শুরু করে ট্রেনের ভেতর-বাহির পরিষ্কারের দায়িত্বও ঠিকাদারদের। নিয়মিত ট্রেনে চড়েন এমন যাত্রীদের অভিযোগ, আজকাল ট্রেনের গ্লাস দিয়ে ভেতর-বাহির দেখা যায় না। ময়লায় গ্লাসের রং পালটে যাচ্ছে। অথচ চুক্তি অনুযায়ী, ট্রেনের গ্লাসগুলো সব সময় পরিচ্ছন্ন রাখার কথা। ট্রেনের বাহির-ভেতরের অংশ কালচে ধোঁয়া-ময়লায় বিবর্ণ হয়ে থাকে মাসের পর মাস।

যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধু ট্রেনে নয়, স্টেশন টয়লেটগুলোও ব্যবহারের অনুপযোগী। স্টেশনে থাকা শৌচাগার ব্যবহার করতে হলে রেলকর্মী কিংবা পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাছ থেকে চাবি চাইতে হয়। চাবি কখনও মেলে কখনও মেলে না। কেউ আবার সংকোচ করে চাবি চাইতে যান না। একাধিক স্টেশন মাস্টার জানান, বড় বড় স্টেশনগুলোতে ইজারা দেওয়া শৌচাগার রয়েছে। যা ব্যবহার করতে হলে ৫ থেকে ১৫ টাকা পরিশোধ করতে হয়। স্বল্প দূরত্বের ট্রেনগুলোর অবস্থা আরও শোচনীয়। ট্রেনের মধ্যেই খাওয়া-দাওয়া করেন। এমনকি হাত ধোয়া হয় সেখানেই। তবে কামরা নিয়মিত পরিষ্কার হয় না, সেটা ঠিক। অবশ্য রেলের এক বড় কর্তা বললেন, ট্রেন প্রতিদিন পরিষ্কার করা সম্ভব নয়। লোকবল নেই। সেজন্য যাত্রীদের শুভবুদ্ধির ওপরেই কিছুটা ছাড়তে হচ্ছে।

কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সরওয়ার যুগান্তরকে বলেন, ট্রেনের ভেতর-বাহির পরিচ্ছন্ন করতে ঠিকাদার কর্তৃক শ্রমিক রয়েছেন। শ্রমিকরাই পরিচ্ছন্নতার কাজটুকু করেন। হাজার হাজার যাত্রী স্টেশন হয়ে ট্রেনে চলাচল করছেন। অসচেতনতার কারণে তা নোংরা করা হচ্ছে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদা বলেন, পরিচ্ছন্নতা কাজে প্রায় সাড়ে তিন শতাধিক শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছেন। এরা বেসরকারি ঠিকাদার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কাজ ও শ্রম বুঝে মাসিক টাকা প্রদান করেন। এ অঞ্চলে বছরে ৪ কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করা হয়।

পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী তাপস কুমার দাশ বলেন, ট্রেন ও স্টেশন পরিচ্ছন্নতায় যাত্রীদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। যাত্রীরা সচেতন হলে এ খাতে কোটি কোটি টাকা খরচেরও দরকার পড়ত না। পরিচ্ছন্নতা কাজের বিল হিসাবে প্রতিবছর আড়াই কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করতে হয়।

রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী বলেন, পরিচ্ছন্নতা নিয়ে অনেক অভিযোগ আসে। আসলে পুরো বিষয়টি অন্য দপ্তর দেখে, আমরা নই। পরিচ্ছন্নতার কোনো বিকল্প নেই। ট্রেন কিছুটা বিলম্ব হলেও ট্রেন-স্টেশনগুলো পরিচ্ছন্ন থাকলে যাত্রীরা খুশি মনে ভ্রমণ করতে পারেন।

এ প্রসঙ্গে রেলপথ সচিব ড. হুমায়ুন কবির যুগান্তরকে বলেন, বিষয়গুলো মাঠপর্যায়ে থাকা কর্মকর্তারা নিশ্চিত করবেন। আমি বিষয়টি জেনেছি, মাঠপর্যায়ে খোঁজখবর নিয়ে দেখব।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/721024