২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৩:৫৬

ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যু একশ ছাড়াল

শিশু হাসপাতালেই মারা গেছে ১৭ জন

ডেঙ্গুতে অসংখ্য শিশু আক্রান্ত হচ্ছে। সরকারি হিসাবে চলতি বছর ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক থেকে ১৫ বছর বয়সি ৩৩ হাজার ৯৯৩ শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১০২ জন শিশু মারা গেছে। ডেঙ্গুর কাছে হেরে যাওয়া এসব শিশুর অনেকেরই আগে কোনো ধরনের রোগের ইতিহাস ছিল না। তিলে তিলে গড়ে তোলা শিশুসন্তানদের ডেঙ্গুতে এমন অকালমৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না বাবা, মা ও স্বজনরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাসপাতালগুলোতে অন্যান্য রোগীর তুলনায় শিশুদের শয্যা সংখ্যা কম থাকায় চিকিৎসা পেতেও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ফলে গুরুতর অসুস্থ শিশুরা না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া শিশুদের ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে এক থেকে পাঁচ বছর বয়সি শিশু আক্রান্ত হয়েছেন ১০ হাজার ২৮২ জন (৬ শতাংশ)। এরপর ছয় থেকে ১০ বছর বয়সি শিশু আক্রান্ত হয়েছে ১০ হাজার ৩৩১ জন (৬ শতাংশ), ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সি শিশু আক্রান্ত হয়েছে ১৩ হাজার ৩৮০ জন (৭ শতাংশ)। অর্থাৎ, এক থেকে ১৫ বছর বয়সি শিশুদের আক্রান্ত হার ১৯ শতাংশ। যা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত অন্য বয়সিদের মধ্যে সর্বোচ্চ। ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ২১ থেকে ২৫ বছর বয়সিরা। এই বয়সি ২৭ হাজার ৪৫৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। যা মোট আক্রান্তের ১৫ শতাংশ।

অপর দিকে ডেঙ্গুতে এ বছর এক থেকে ১৫ বছর বয়সি শিশু মারা গেছে ১০২ জন। এর মধ্যে এক থেকে পাঁচ বছর বয়সি শিশু রয়েছে ৩৪ জন (৪ শতাংশ)। ছয় থেকে ১০ বছর বয়সি শিশু মারা গেছে ৪৪ জন (৫ শতাংশ)। ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সি শিশু মারা গেছে ২৪ জন (৩ শতাংশ)। আক্রান্তের ১২ শতাংশ শিশু মারা গেছে। এ বছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সিরা। যা মোট মৃতের ১৮ শতাংশ।

জানা গেছে, চলতি বছর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে এক হাজার ৪৩৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১০০ জনের বেশি শিশুর আইসিইউ সাপোর্টের প্রয়োজন হয়েছে। শুক্রবার হাসপাতালটিতে ১৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু ভর্তি হয়। এখন পর্যন্ত শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে ১০৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু ভর্তি রয়েছে।
শিশু হাসপাতালের পরিচালক ডা. জাহাঙ্গীর আলম যুগান্তরকে বলেন, ডেঙ্গুসহ যে কোনো রোগে শিশুরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। বিশেষ করে এক বছরের কম বয়সি শিশুদের ডেঙ্গু হলেই পরিস্থিতি ভয়ংকর হতে পারে। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের পালমোনারি হেমারেজ বেশি হয়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করতে না পারলে মাল্টি-অর্গান ফেইলিউর হয়ে শিশু মারা যেতে পারে। এছাড়া তাদের ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে নরমাল স্যালাইন দেওয়া যায় না। তিন মাসের নিচের বাচ্চাদের বেবি স্যালাইন লাগে। শিশুদের ফ্লুইড প্রয়োগের হিসাব একটু কঠিন। রোগের ধরন বুঝে সঠিক মাত্রায় ফ্লুইড দিতে না পারলে, ওভার ডোজ পড়লে পরিস্থিতি মারাÍক হতে পারে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) শিশু বিভাগের অধ্যাপক ডা. মাহবুব মোতানাব্বি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের শরীরে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা স্পষ্ট করে বলতে পারে না। ফলে বাইরে থেকে স্বাভাবিক মনে হলেও যে কোনো সময় শিশুরা ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে চলে যেতে পারে। তাই ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের যথাযথ মনিটরিং করতে হবে।

বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ডেঙ্গুজ্বরের গুরুত্বপূর্ণ সময় যখন রোগীর জ্বর ছেড়ে যায়। জ্বর ছাড়ার পরবর্তী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা ডেঙ্গু রোগীর ক্রিটিক্যাল সময়। এটি ডেঙ্গুজ্বরের গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ সময় রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। ডেঙ্গুজ্বরের বিপজ্জনক উপসর্গ হলো- অনবরত বমি হওয়া, রক্তক্ষরণ হওয়া, তীব্র দুর্বলতা অনুভব করা, তীব্র পেটব্যথা, ফুসফুসে পানি জমা, তীব্র শ্বাসকষ্ট হওয়া। এবার শিশুদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর জটিলতা বেশি দেখা যাচ্ছে। তাই ডেঙ্গু চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা শুধু যে মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকরা করবে এমন নয়। বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকদের এতে সম্পৃক্ত হতে হবে।

২১৫৩ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে, ৪ মৃত্যু : এদিকে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এক দিনে আরও দুই হাজার ১৫৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ সময়ে মৃত্যু হয়েছে আরও ৪ জনের। তাতে এ বছর সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮১ হাজার ৮৫২ জনে, যাদের মধ্যে ৮৭৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ১৪৮৬ জন ভর্তি হয়েছেন, ঢাকায় এই সংখ্যা ৬৬৭। ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া চারজনের ঢাকায় মৃত্যু হয়েছে একজনের, বাকি তিনজন মারা গেছেন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায়। হাসপাতালে ভর্তি রোগী এবং মৃত্যুর এই সংখ্যা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে এমন আশঙ্কা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। বর্তমানে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ৭১ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ৩৬৫৮ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ৬ হাজার ৪১৩ জন। এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েই চলেছে। জুন মাসে পাঁচ হাজার ৯৫৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, জুলাই মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩ হাজার ৮৭৬ জন, আগস্ট মাসে ৭১ হাজার ৯৭৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আর সেপ্টেম্বরের ২২ দিনে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৫৮ হাজার ৪৪ জন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/721019