২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ১০:৩৭

ব্যবস্থাপনার অভাবেই ডেঙ্গুর ভয়াল রূপ

ডেঙ্গু রোগীর তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সংগ্রহ করে ওই রোগীর আশপাশের অন্তত ৫০টি বাড়িতে এডিস মশা নিধনে অভিযান চালাবে সিটি করপোরেশন বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে ডিসেম্বরের মধ্যে সারাদেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মপরিকল্পনা আসবে। মন্ত্রণালয় সেগুলো যাচাই-বাছাই করে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে মাঠ পর্যায়ে পাঠাবে কেন্দ্রের নির্দেশনা।
এমন অনেক কার্যকর পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে ২০২১ সালে প্রণীত ‘ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে জাতীয় নির্দেশিকা’য়। কিন্তু এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়নি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। মাঠ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা-জনপ্রতিধি জানেনই না এই নির্দেশিকার কথা। ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নেওয়ার পর তাদের তাগিদ দেওয়া হচ্ছে ওই নির্দেশনা বাস্তবায়নে। তবে মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেউই সেই দায়িত্ব পালন করছেন না। ডেঙ্গুর প্রকোপও কমছে না।

‘জানুয়ারি হতে ডিসেম্বর, মশক নিধন বছরভর’ স্লোগানকে প্রতিপাদ্য করে প্রণীত ওই নির্দেশিকা অনুযায়ী ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কমিটি থাকার কথা। প্রতিবছর ডিসেম্বরের মধ্যে কমিটিগুলোর কাছ থেকে পরিকল্পনা নেবে স্থানীয় সরকার বিভাগ। তারপর জানুয়ারির মধ্যে মন্ত্রণালয় মাঠ পর্যায়ে চূড়ান্ত কর্মপরিকল্পনা পাঠাবে। কিন্তু ২০২২ সালে মাঠ পর্যায় থেকে কোনো কর্মপরিকল্পনাই আসেনি। স্থানীয় সরকার বিভাগও মাঠ পর্যায়ে কোনো পরামর্শ-নির্দেশনা পাঠায়নি। কেবল মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত সব সিটি করপোরেশনে পাঠানো হয়।
বছরব্যাপী পরিকল্পনায় যা রয়েছে

জাতীয় নির্দেশিকায় স্থানীয় সরকারের প্রতিটি কমিটি কখন কীভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে এবং মন্ত্রণালয় কখন নির্দেশনা দেবে, তা উল্লেখ রয়েছে। ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পৌরসভা জেলা প্রশাসকের কাছে কর্মপরিকল্পনা জমা দেবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে ইউনিয়নের কর্মপরিকল্পনা ডিসি অফিসে দেবেন। ডিসিরা ওই সব পরিকল্পনা বাছাই করে ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে পাঠাবেন। বিভাগীয় কমিশনারের কাছ থেকে পাওয়া কর্মপরিকল্পনা পর্যালোচনা করে নতুন বছরে মশক নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরি করবে স্থানীয় সরকার বিভাগ। সেগুলো মাঠ পর্যায়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে পাঠিয়ে সে অনুযায়ী কাজ করতে বলা হবে। কিন্তু এসবের কিছুই কখনও করা হয়নি। অথচ প্রতিটি স্থানীয় সরকার পর্যায়ে এ জন্য শক্তিশালী কমিটি রয়েছে। সবচেয়ে বড় কমিটি হলো ‘ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধবিষয়ক জাতীয় কমিটি’। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী এ কমিটির সভাপতি। কমিটির সদস্য ২৪ জন। এ কমিটির দায়িত্ব হলো মশক নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান ও কার্যক্রমের পর্যালোচনা মূল্যায়ন, তদারকি ও সমন্বয় সাধন। কমিটির বছরে চারটি সভা করার কথা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কমিটি নির্ধারিত চারটি সভাই করেছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের কাজের পর্যালোচনা, মূল্যায়ন ও তদারকি করেনি।

এর পরে রয়েছে ‘ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধবিষয়ক সমন্বয় কমিটি’। স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) এই কমিটির সভাপতি। সদস্য সচিব হলেন স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব (সিটি করপোরেশন-১)। আরও ছয়জন এই কমিটির সদস্য। প্রতি মাসে তাদের একটি সভা করার কথা। ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত কমিটিগুলোরও এমন সভার বিধান রয়েছে। তারা সভা করে বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা করবে। সভাগুলোও ঠিকমতো হয়নি। তারা কোনো মূল্যায়নও উপস্থাপন করেনি।

এমনভাবে প্রতিটি সিটি করপোরেশনে মেয়রের সভাপতিত্বে ১৪ সদস্যের, ওয়ার্ড পর্যায়ে কাউন্সিলরের সভাপতিত্বে ১০ সদস্যের, পৌরসভায় মেয়রের সভাপতিত্বে ১৬ সদস্যের, ওয়ার্ড পর্যায়ে কাউন্সিলরের সভাপতিত্বে সাত সদস্যের, ইউনিয়নে চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে ১৬ সদস্যের, ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে ইউপি সদস্যের

সভাপতিত্বে ১১ সদস্যের এবং জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে ২৬ সদস্যের কমিটি রয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদেরও মশক নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু এসব কমিটি মশা নিয়ে কোনো সভাই করেনি। তারা কর্মপরিকল্পনাও পাঠায়নি।

কী বলছে স্থানীয় সরকার বিভাগ
স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নগর উন্নয়ন অনুবিভাগ) ড. মলয় চৌধুরী শুধু বলেন, ‘জাতীয় নির্দেশিকা অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কর্মপরিকল্পনা পাঠানো হয়েছে।’ এ বিষয়ে তিনি স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব (নগর উন্নয়ন অনুবিভাগ) শামীম বেপারীর সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।

শামীম বেপারী জানান, গত ৫ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকের নির্দেশনা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠানো হয়েছে। তাতে কী নির্দেশনা রয়েছে, তা বলতে পারেননি তিনি। এ পদে নতুন এসেছেন বলে উল্লেখ করেন।

শামীম বেপারীর পূর্বতন কর্মকর্তা মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী সমকালকে বলেন, ‘বছরের শুরু থেকেই বৈঠক করে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমি এখন ওই বিভাগে নেই। তাই এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে তাদের সঙ্গে কথা বলেন।’

মাঠ প্রশাসন কী বলে
এবার ডেঙ্গু রোগী বেশি এমন ১০টি জেলা চিহ্নিত করেছে সরকার। ঢাকার কাছাকাছি তেমন একটি জেলার উপপরিচালক (স্থানীয় সরকার শাখা) নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে জানান, জাতীয় নির্দেশিকা অনুযায়ী গত বছর যে কর্মপরিকল্পনা বিভাগীয় কমিশনার অফিসে পাঠানোর কথা, সেটা তারা পাঠাননি; মন্ত্রণালয় থেকেও তাগিদ আসেনি। মাস দুয়েক আগে ডেঙ্গু পরিস্থিতি যখন ভয়াল রূপ নেওয়ার আশঙ্কার কথা গণমাধ্যমে আসে, তখন মন্ত্রণালয় থেকে কর্মপরিকল্পনার জন্য তাগিদ আসে। তখন তারা আগস্ট-ডিসেম্বরের জন্য কর্মপরিকল্পনা করে বিভাগীয় কমিশনারের অফিসে পাঠান।

দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, তারাও নির্দেশিকা অনুযায়ী কোনো কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেননি। ডেঙ্গু ভয়াবহ অবস্থায় যাওয়ার পর নির্দেশিকার বিষয়টি তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে কয়েকটি জেলা থেকে কর্মপরিকল্পনা এসেছে। কিন্তু তারা এখনও মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে পারেননি।

ময়মনসিংহ বিভাগের একটি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, ডেঙ্গু নিয়ে জাতীয় নির্দেশিকার বিষয়ে তিনি জানেন না, কোনো কপিও পাননি। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ডেঙ্গু-সংক্রান্ত কিছু নির্দেশনা পেয়েছেন বলে জানান।

মশা নিয়ন্ত্রণে প্রণীত জাতীয় নির্দেশিকা তৈরিতে স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং ঢাকার দুই সিটির আট কর্মকর্তাকে নিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছিল। কমিটিতে চারজন অতিরিক্ত সচিব, একজন যুগ্ম সচিব, দুই সিটি করপোরেশনে দু’জন প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও একজন অতিরিক্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ছিলেন। সেই কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, ‘নির্দেশিকাতে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে যেভাবে কাজ করতে বলা হয়েছে, তা পালন করা হলে কোনোভাবেই ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।’ আরেক সদস্য বলেন, ‘নির্দেশিকাটি সম্পর্কে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা-জনপ্রতিনিধিরা অনেকে জানেন না। সুন্দর আইন-নীতি তৈরি করে সঠিক বাস্তবায়ন না হলে যা হওয়ার, তাই হয়েছে!’ তাঁর মতে, ডেঙ্গু মোকাবিলায় জাতীয় নির্দেশিকার সঠিক প্রতিপালনই যথেষ্ট। স্থানীয় সরকার বিভাগ সেটি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু ব্যর্থতা স্বীকারের সংস্কৃতি দেশে নেই।

সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাহারুল আলম বাহার মশক নিয়ন্ত্রণবিষয়ক জাতীয় নির্দেশনার বিষয়ে আগে জানতেন না। দিন ১৫ আগে মন্ত্রণালয় থেকে একটি কপি তাঁর কাছে পাঠানো হয়েছে। আগে ডেঙ্গু নিয়ে কোনো সুপারিশ তিনি পাঠাননি।

যশোর পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাহিদ হোসেন মিলনও মশা নিয়ে জাতীয় নির্দেশিকার কথা জানেন না। এ বিষয়ে কিছু শোনেনওনি। তবে ডেঙ্গু ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে মাইকিং করে ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালিয়ে মানুষকে সচেতন করেন তিনি।

বরিশালের গৌরনদী উপজেলার চেয়ারম্যান সৈয়দা মনিরুন নাহার মেরি সমকালকে বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে জাতীয় নির্দেশিকা সম্পর্কে কিছু জানি না। তবে ডিসি অফিস থেকে কিছু লিফলেট পাঠানো হয়েছিল। সেগুলো বিতরণ করেছি।’
স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব যা জানালেন

ডেঙ্গুর সার্বিক অবস্থা নিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মুহম্মদ ইব্‌রাহিমের সঙ্গে তাঁর দপ্তরে কথা হয় গত সোমবার। তিনি সমকালের কাছে স্বীকার করেন, জাতীয় নির্দেশিকাটি প্রণয়নের পর যেভাবে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন ছিল, সেভাবে দেওয়া হয়নি। তবে এখন তারা সংশ্লিষ্ট সবাইকে তাগাদা দিচ্ছেন। ২৬ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীজন নিয়ে বৈঠক হবে। সেখানে সব পর্যায়ের বিশেষজ্ঞকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।

মুহম্মদ ইব্‌রাহিম বলেন, ‘এবার ডেঙ্গুর ধরন একটু ভিন্ন। এর আগে দুই বছর করোনার প্রকোপ ছিল, ডেঙ্গুর তেমন সমস্যা হয়নি। এবার অন্যান্য দেশেও ডেঙ্গু বেড়েছে। এখন সবাইকে নির্দেশিকা অনুযায়ী কাজ করতে বলা হচ্ছে।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মত

মন্ত্রণালয় থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কোনো গুরুত্বই দেওয়া হচ্ছে না বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোসতাজ হোসেন। তিনি সমকালকে বলেন, ‘জাতীয় নির্দেশিকাটি চমৎকার। কিন্তু সে অনুযায়ী ব্যবস্থা না নিলে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমবে না। বোঝাই যাচ্ছে, মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। নির্দেশিকা অনুযায়ী কাজ শুরু করলে এর কোথায় কী সমস্যা হচ্ছে, সেটা বোঝা যেত; কিন্তু কাজ শুরু না করলে আপডেট কীভাবে হবে?’ রাজনৈতিক পর্যায় থেকে এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

https://samakal.com/bangladesh/article/2309197392