২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ১০:২৩

বিপুল ব্যয়ে নির্বাচন অ্যাপ সুফল নিয়ে সংশয়

এক অ্যাপেই প্রার্থী পরিচিতি, ভোটকেন্দ্রের অবস্থান, ভোটের ফলাফল পাওয়া যাবে

জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিপুল ব্যয়ে ‘বাংলাদেশ ইলেকশন অ্যাপ’ তৈরি করছে ইসি। ওই অ্যাপে ভোটার তথ্য, প্রার্থী পরিচিতি ও প্রতীক, প্রার্থীর হলফনামা, ভোটকেন্দ্রের অবস্থান, দলভিত্তিক পাওয়া আসন সংখ্যা ও ফলাফলসহ বিভিন্ন ধরনের তথ্য মিলবে।

ভোটার, রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের ওই অ্যাপে প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে। নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা আনা এবং স্মার্ট ভোট ব্যবস্থাপনার অংশ হিসাবে এ অ্যাপ চালু করা হচ্ছে। ২৭ সেপ্টেম্বর এই অ্যাপ উদ্বোধনের পরিকল্পনা রয়েছে ইসির।

এই অ্যাপ তৈরি ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২১ কোটি টাকা। যদিও তিনশ আসনের নির্বাচনি মালামাল কিনতে ব্যয় হচ্ছে ২২ কোটি ২১ লাখ টাকা। প্রথমবারের মতো এই ধরনের অ্যাপ তৈরি করছে কমিশন। যদিও ওই অ্যাপের সুফল নিয়ে সন্দেহে রয়েছেন স্বয়ং নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। ইসি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এই অ্যাপ থেকে প্রার্থী, ভোটার, রাজনৈতিক দলসহ নির্বাচনসংশ্লিষ্টরা সুফল পাবেন বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম। বুধবার যুগান্তরকে তিনি বলেন, সেপ্টেম্বরের শেষদিকে অ্যাপটি উদ্বোধন করার লক্ষ্য রয়েছে। এই অ্যাপে অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিল, ভোটকেন্দ্রের অবস্থান, কত ভোট পড়েছে-এসব তথ্য প্রতি ২ ঘণ্টা পরপর জানাসহ কয়েক ধরনের ফিচার থাকবে। মোবাইল ফোনে এই অ্যাপ ডাউনলোড করে তার প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে পারবেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র আরও জানায়, অ্যাপ চালু করতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। যদিও ওই অ্যাপ থেকে কতটা সুফল পাওয়া যাবে তা নিয়ে সন্দিহান তারা। অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ গত নির্বাচনে থাকলেও তা থেকে সুফল মেলেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানো বন্ধসহ বিভিন্ন কারণে বিগত নির্বাচনে ভোটের দিন ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে রাখা হয়। এবার নির্বাচনে ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে রাখলে ওই অ্যাপের পুরোপুরি সুফল পাওয়া যাবে না। একই ধরনের আশঙ্কা আইটি বিশেষজ্ঞদেরও।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে স্মার্টফোনে যে ভার্সনের অপারেটিং সিস্টেম চলে সেখানে অ্যাপ্লিকেশন চলার জন্য অন্তত ৩জি প্রযুক্তির ইন্টারনেট গতি প্রয়োজন হয়। তাও খুব ভালো সেবা পাওয়ার জন্য ৪জি গতি লাগে। নির্বাচনের দিন ইন্টারনেটের যথাযথ গতি না থাকলে অ্যাপ কাজ করবে না।

জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের কর্মপরিকল্পনায় নির্বাচনে তথ্যপ্রযুক্তি প্রয়োগের কথা উল্লেখ রয়েছে। ওই কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী এই অ্যাপ তৈরি করা হচ্ছে। এর সম্ভাব্য নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশ ইলেকশন অ্যাপ’। এই অ্যাপে স্তরভিত্তিক প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে। ভোটার, রাজনৈতিক দল, প্রার্থীসহ সংশ্লিষ্টরা ৯ ধরনের তথ্য জানা ও অ্যাকসেস পাবেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-নির্বাচনি এলাকার নাম, নম্বর ও ভোটার সংখ্যা এবং ম্যাপ। প্রার্থীর নাম, পরিচিতি, ছবি, দলীয় পরিচয় ও প্রতীক এবং হলফনামার তথ্য।

ভোটকেন্দ্রের নাম, নম্বর ও অবস্থান। কেন্দ্র ও আসনভিত্তিক পুরুষ ও মহিলা ভোটার তথ্য। দলভিত্তিক প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ও নিকটতম প্রার্থীর পরিচিতি ও প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা।

অপরদিকে নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তারা এই অ্যাপে প্রবেশ করে নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী ডিসি, এসপি, ওসিসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পরিচয় ও ফোন নম্বর সংগ্রহ করতে পারবেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ওই অ্যাপের মাধ্যমে দ্রুত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগও করার সুযোগ থাকবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এই অ্যাপে যাতে একইসঙ্গে তিন কোটি মানুষ হিট করতে পারেন-এমন সক্ষমতা রাখা হচ্ছে। এই অ্যাপের অংশ হিসাবে অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের নতুন ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। ওই পদ্ধতি চালু করার লক্ষ্যে নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালার কয়েকটি ধারাতেও সংশোধনী আনছে নির্বাচন কমিশন। শিগগিরই সংশোধিত এ বিধিমালার এসআরও জারি হতে যাচ্ছে।

ওই বিধিমালায় সম্ভাব্য প্রার্থীদের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, ভোটার নম্বর, মোবাইল নম্বর, ই-মেইল আইডি, নির্বাচনি এলাকার নম্বর ও নাম এন্ট্রি করে অনলাইন পোর্টালে প্রবেশের বিধান যুক্ত করা হচ্ছে। এমনকি মনোনয়নপত্র দাখিলকারী, প্রস্তাবকারী ও সমর্থনকারীর মুখাবয়ব দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকছে। ইসির আইটি বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিল করা হলে সেই তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্বাচন কমিশনের প্রার্থীর তথ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেমে চলে যাবে। এতে নির্বাচনি কার্যক্রমে প্রার্থী ব্যবস্থাপনা সহজ হবে।

এছাড়া ভোটকেন্দ্রের তথ্যও অ্যাপে আপলোড করার লক্ষ্যে অন্যান্য বারের তুলনায় এবার আগেভাগেই খসড়া তালিকা তৈরি করেছে ইসি। এজন্য নতুন নীতিমালাও তৈরি করেছে। এ নীতিমালায় ভোটকেন্দ্র নির্ধারণে ডিসি, এসপি, ওসি ও ইউএনওদেরও যুক্ত করা হয়। নির্বাচনি অ্যাপে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের তথ্য সংযোজনের জন্য আগাম তালিকা সংগ্রহেরও উদ্যোগ নেয় কমিশন।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও)’র ৯ ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক একটি খসড়া নীতিমালাও তৈরি করে। ওই খসড়া নীতিমালায় ডিসি, এসপি, ওসি ও ইউএনওদের যুক্ত করে সম্ভাব্য ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরির কথা ছিল। যদিও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর সেই পদক্ষেপ থেকে সরে আসে কমিশন।

নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, অ্যাপ তৈরির জন্য এতে প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের হার্ডওয়্যার কিনতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। আর সফটওয়্যার তৈরিতে ব্যয় হবে ৯ কোটি ৯ লাখ টাকা। সফটওয়্যার সরবরাহ করবে সরকারের তালিকাভুক্ত ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফেসিলিশন কোম্পানি। এছাড়া বছর বছর রক্ষণাবেক্ষণ খাতেও টাকা ব্যয় হবে।
যদিও অর্থ ও জনবল সংকটের কথা জানিয়ে ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা ও ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার থেকে সরে এসেছে নির্বাচন কমিশন। গাইবান্ধা-৫ আসনে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে ভোটকেন্দ্রে জালভোট দেওয়ার দৃশ্য দেখে ওই নির্বাচন বন্ধ করেছিল ইসি। ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা বসানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন বিশিষ্টজনরাও। তবে নির্বাচনি অ্যাপ নিয়ে তখন খুব একটা আলোচনা হয়নি।

নির্বাচন কমিশনের অ্যাপে অনেক ধরনের ফিচার থাকলেও প্রান্তিক ভোটাররা খুব একটা সুফল পাবেন না বলে মনে করেন মোবাইল ফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের এই অ্যাপ্লিকেশন চালানোর মতো ডিভাইস আছে কিনা-সেটা বিবেচনায় নেওয়ার দরকার ছিল। তার থেকে বড় কথা হচ্ছে, বিগত দিনের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি ভোটের দিন নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া বা ইন্টারনেট স্পিড কমিয়ে দেওয়া হয়।

সেক্ষেত্রে ইন্টারনেট না থাকলে কীভাবে মানুষ অ্যাপস থেকে সেবা নেবে? এছাড়া নির্বাচন কমিশন যদি মানুষের সুবিধার কথা বিবেচনায় এই অ্যাপ তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে থাকত তাহলে সাধারণ মানুষকে ইভিএম ব্যবহারে যেভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, অ্যাপ চালানোরও প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। নইলে এ কার্যক্রমে যে টাকা ব্যয় হবে তা অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/720709