২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ১০:২০

ভোটের বিশ্বাসযোগ্যতায় হোঁচটের শঙ্কা

বাজেট স্বল্পতায় পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর কথা চিঠিতে জানিয়েছে ইইউ

ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর ঘোষণায় আগামী সংসদ নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা-দুই-ই হোঁচট খেতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, আগামী নির্বাচনে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল অংশ নেবে না-এমন আভাস পেয়েই হয়তো এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা বলেন, ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি আগেই এ ধরনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না ইইউ।

নির্বাচনি পরিবেশ-পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় ওই ইঙ্গিতের প্রতিফলন দেখা গেল। এছাড়া গত জুলাইয়ে ঢাকা ঘুরে যাওয়া প্রাকনির্বাচন পর্যবেক্ষক মিশন তাদের প্রতিবেদনেও পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সুপারিশ করেছে। তার ভিত্তিতেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইইউ। ইইউর এ সিদ্ধান্তের ফলে পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশগুলো থেকে পর্যবেক্ষক আসবে কিনা তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে।

অবশ্য নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে, বাজেট স্বল্পতার কারণ দেখিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক টিম পাঠাবে না বলে তাদের চিঠিতে জানিয়েছে। ওই চিঠিতে নির্বাচনি পরিবেশ নিয়ে কিছু উল্লেখ নেই। এদিকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেছেন, আগামী নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক আসা না আসায় বাংলাদেশের নির্বাচন আয়োজন ও নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতায় কোনো প্রভাব পড়বে না। অপরদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত প্রমাণ করেছে দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিস্থিতি নেই। এখানে অবজারভার টিম পাঠানোরও পরিবেশ নেই।

ইইউ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর ঘোষণা হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হুমায়ুন কবীর। তিনি যুগান্তরকে বলেন, তাদের এ সিদ্ধান্ত বলে দিচ্ছে আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ও প্রস্তুতি নিয়ে তারা এখনো যথেষ্ট আশ্বস্ত হতে পারছে না। তারা কী কারণে আসবে না ও তাদের কী প্রত্যাশা-তা জেনে নিয়ে তাদের আসার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারি। সেটা করতে পারলে আমাদের জন্য ভালো হবে। তিনি বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন আন্তর্জাতিক মানের হয়েছে কিনা-সেই বিশ্বাসযোগ্যতা আসবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের দেওয়া রিপোর্টের ওপর। তারা পর্যবেক্ষণ করলে আমাদের নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য করার ক্ষেত্রে আমরা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকব।

ইইউ পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত আগামী নির্বাচনের প্রতি তাদের অনাস্থার প্রতিফলন বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি যুগান্তরকে বলেন, গত দুই নির্বাচনের মতো এটিও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য হবে না-তার আলামত এখনই স্পষ্ট। তাদের এ সিদ্ধান্ত জানান দিল বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি।

আগামী ডিসেম্বরের শেষ বা জানুয়ারির শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। তফশিল ঘোষণা হবে আগামী নভেম্বর মাসে। নির্বাচনের ওই সময়ের আগেই ইইউ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর বিষয়ে তাদের অবস্থান জানাল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ইইউর ই-মেইল বার্তায় গতকাল ওই তথ্য পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম।

বৃহস্পতিবার নিজ কার্যালয়ে সিইসির পক্ষে ইসি সচিব বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) মেইলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে একটি চিঠি পেয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড অব ডেলিগেশন একটি ই-মেইল পাঠিয়েছেন। সেই মেইলে তিনি উল্লেখ করেছেন, তাদের হেড অফিস সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তাদের পূর্ণাঙ্গ একটি মিশন নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানোর সঙ্গে আর্থিক বিষয় ছিল। বাজেট স্বল্পতার কারণে তা নামঞ্জুর করেছেন বা আপাতত না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

ওই চিঠিতে নির্বাচন নিয়ে কোনো শঙ্কার কথা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, না। এ চিঠির ভাষায় এ জাতীয় কিছুর উল্লেখ নেই। শুধু তারা অবহিত করেছেন পূর্ণাঙ্গ টিম পাঠাবেন না। কাজেই ছোট দল পাঠাবেন নাকি এই দেশে যারা আছেন তারাই করবেন সেটি বলেননি। তবে তারা সিইসির সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছেন।

ইইউএ’র এ সিদ্ধান্ত আগামী নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করবে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সিইসি ভালো বলতে পারবেন। যেহেতু উনাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। আমেরিকার প্রাকনির্বাচন পর্যবেক্ষণ টিমের সঙ্গে আগামী ১০ অক্টোবর ইসির বৈঠক নির্ধারিত রয়েছে। ওই বৈঠকের তারিখ এখনো ঠিক আছে।

ইইউ নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, সিইসির কাছ থেকে যে চিঠি পেয়েছি, সেখানে এ জাতীয় কোনো শব্দের উল্লেখ নেই। এর বাইরে কেউ যদি কথার সঙ্গে ডালপালা মিলিয়ে অন্য কিছু বলে তাহলে ভিন্নকথা। সিইসিকে যে মেইল করা হয়েছে, তার সারমর্ম হচ্ছে ইইউ বাজেট স্বল্পতার কারণে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না। নির্বাচনে ইইউ পর্যবেক্ষণ না করার সিদ্ধান্ত কমিশন কীভাবে মূল্যায়ন করছে এমন প্রশ্নের জবাবে মো. জাহাংগীর আলম বলেন, এটা কমিশন বলতে পারবে, সচিব কীভাবে বলবে?

জানা গেছে, সিইসিকে দেওয়া চিঠিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যবেক্ষক না পাঠানোর দুটি কারণ উল্লেখ করেছে। একটি হচ্ছে-গত ৬-২২ জুলাই ঢাকা আসা প্রাকনির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিনিধিদলের সুপারিশ এবং আরেকটি হচ্ছে বাজেট স্বল্পতা। ওই চিঠিতে ইইউ আরও উল্লেখ করেছে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনকে তারা ক্রমাগত উৎসাহিত করে যাবে।

এদিকে ইইউ পর্যবেক্ষক দল না আসার ঘোষণায় পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা। গতকাল এক অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানো নিয়ে ইইউর সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে বলেন, বরাবরই বলে আসছি আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচনই সম্ভব নয়। এটা পরীক্ষিত। পরপর দুটি নির্বাচন অতীতে করেছি। তাদের অধীনে যে কখনো কোনো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না, জনগণ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারে না-এ ব্যাপারে কারোরই সন্দেহ থাকার কথা নয়। তবে এবার যখন প্রধানমন্ত্রী বিদেশে গিয়ে তাদের কাছে কথা দেন, খুব সুন্দর, অবাধ নির্বাচন হবে, কোনো চিন্তার কারণ নেই। তখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন টপ অবজারভেটরি টিম পাঠিয়েছিল। এই টিম সব দলের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলেছে। তারা পরিষ্কার করে বলেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ নেই। এখানে অবজারভার টিম পাঠানোর পরিবেশ নেই।
এতেই সবকিছু প্রমাণিত হয়ে গেল। নির্বাচনের পরিবেশ ভালো থাকায় ইইউ পর্যবেক্ষক দল পাঠাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ। তিনি বলেন, ঠিক কী কারণে তারা পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে। তবে আমাদের দল আওয়ামী লীগ থেকে বলা আছে স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচন হোক। আমরা চাই সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক।

আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন হয়তো তার ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের আস্থা রয়েছে। তাদের প্রাকনির্বাচন পর্যবেক্ষক দল সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসেছে তাদের কনফিডেন্স হয়েছে যে, বাংলাদেশে ভালো ভোট হবে। হয়তো ওই কারণে পর্যবেক্ষক পাঠাচ্ছে না। তারা যদি পর্যবেক্ষক পাঠায় আমরা অবশ্যই স্বাগত জানাব।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/720698