২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ৯:৫৯

টাকা ছাপিয়ে সরকারের ঋণ গ্রহণ মাশুল গুনছে দেশের জনগণ

এইচ এম আকতার: আমদানি বিল পরিশোধ করতে গিয়ে কমছে রিজার্ভ। ডলার সংকটের কারণে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। আর এ সংকট কাটিয়ে উঠতে নতুনভাবে টাকা ছাপিয়ে সরকার ঋণ নিচ্ছে। এতে করে বাজারে পণ্যের দাম আরও বাড়ছে। বাজারে সৃষ্টি হচ্ছে নেতিবাচক প্রভাব আর তার মাশুল গুনছে দেশের জনগণ। টাকা ছাপিয়ে ঋণ না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ।

জানা গেছে, সরকার বাজেটের ঘাটতি মেটাতে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ করছে। চলতি বছর সরকার নির্বাচনী বাজেট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অযাচিত অনেক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এতে করে নতুন টাকা চাপিয়ে ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ গ্রহণ করছে। আর এ টাকা বাজারে দশগুণ বেশি ইফেক্ট তৈরি করছে। এতে করে বাজারে তারল্য প্রবাহ বেড়ে গেছে। ফলে হু হু করে বাজারে পণ্যের দাম বাড়ছে। কোনভাবেই সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

ডলার কেনার কারণে বেশির ভাগ ব্যাংকের হাতে এখন টাকা নেই, সেই টাকা চলে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে। তাই সরকারকেও চাহিদা মতো ঋণ দিতে পারছে না বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া মানে টাকা ছাপানো, বাজারে নতুন টাকা সরবরাহ করা। মাত্রাতিরিক্ত টাকা ছাপালে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। তবে সরকারের টাকা ধার নেওয়া এখনো লক্ষ্যমাত্রা ছাড়ায়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংক কী পরিমাণ টাকার জোগান দেয়, তা বোঝা যায় রিজার্ভ মানি বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রার হিসাব থেকে। বাজারে যে অর্থপ্রবাহ রয়েছে, সেটিই রিজার্ভ মানি হিসেবে পরিচিত। গত মে মাস পর্যন্ত রিজার্ভ মানির পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪৮ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে যা ৩ লাখ ৮০ হাজার ১১ কোটি টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। ব্যাংকগুলো থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে যে পরিমাণ টাকা গেছে, সরকার ঋণ নিয়েছে তার চেয়ে কম। কিন্তু ব্যাংকব্যবস্থা থেকে বেশি অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে আসায় বাজারে রিজার্ভ মানির প্রবাহ কমে গেছে।

বাজেট ঘাটতি পূরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নেয়। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ের ১৮ দিনে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। যদিও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি এ সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকেও টাকা ধার করেছে সরকার, যার পরিমাণ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ করার পাশাপাশি পুরোনো ঋণের অর্থও পরিশোধ করেছে সরকার। চলতি বছরের ১৮ দিনে ৭ হাজার ৪৪ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেছে সরকার। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে।

বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের নিট ব্যাংকঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকা। যার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিয়েছিল ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। আর বাকি ঋণ নেয় বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট এবং মূল্যস্ফিতিতে নাকাল দেশবাসী। এই মূল্যস্ফিতিতে নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে। সম্প্রতি দেশের অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও সাংবাদিকদের সঙ্গে পরামর্শের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ লক্ষ্যে গতকাল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই অর্থনৈতিক উপদেষ্টার সঙ্গে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার গবর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বৈঠক করেন। বৈঠকে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে তিনি এ পরামর্শ দেন তিনি। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক।

মেজবাউল হক বলেন, দেশের অর্থনৈতিক সংকট নিরশনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি। তাই আমরা অর্থনীতির বিভিন্ন সেক্টরের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যেসব পরামর্শ আসবে সে অনুযায়ী আগামী মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হবে। বৈশ্বিক সংকটের মধ্যেও অন্যান্য দেশের তুলনায় আমারা ভালভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখেছি।

তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি এবং সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় আমাদের দেশও তার মাশুল গুনছে। আজ ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বর্তমান মুদ্রানীতির যথাযথ বাস্তবায়ন এবং নতুন করে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ না দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

মুখপাত্র বলেন, আমরা সংকটের মধ্যে আছি তা সত্য। আমদানি নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানি বৃদ্ধি ও রেমিট্যান্স সংগ্রহ বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিয়ে আমরা সংকট মোকাবেলার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে আরো অর্থনীতিবিদ, ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম, চেম্বার অব কমার্স এবং অর্থনৈতিক খাতের বিভিন্ন ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা পর্যায়ক্রমে চলতে থাকবে বলেও জানান তিনি।

গত জুন ও জুলাই মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমার পর আগস্ট মাসে তা আবার বেড়েছে। গত মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে। এই সময় দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হঠাৎ অনেকটা বেড়ে গেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার উঠেছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে।

এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৪ দিনের ব্যবধানে কমল ১৭৩ কোটি ডলার। এর ফলে রিজার্ভ কমে ২ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ৫ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৩১৮ কোটি ডলার। এরপর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় পরিশোধ করা হয়। জুলাই-আগস্ট সময়ের আমদানির বিলে ব্যয় করা হয়। এছাড়া ডলার সংকটের কারণে বাজারে ডলার ছেড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ কমে গিয়েছিল। ওই অর্থবছরে আমদানিতে খরচ হয় ৭ হাজার ৫০৬ কোটি ডলার। তার আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানিতে খরচ হয়েছিল ৮ হাজার ৯১৬ কোটি ডলার। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এতে আমদানি খরচ বেড়ে যায় এবং ডলারের সংকট দেখা দেয়।

এরপর আমদানি কমাতে নানা শর্ত ও কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক বসায়। এরপর কমতে শুরু করে আমদানি ব্যয়। এর আগে মে-জুন সময়ের জন্য ১১০ কোটি ডলারের আকু বিল পরিশোধ করা হয়েছিলো। এরপরের জুলাই-আগস্টে আমদানি কিছুটা বেশি হয়। এ দায়ের জন্য ৫ শতাংশের বেশি হারে সুদ পরিশোধ করতে হয়।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার-সংকট থাকায় জ্বালানি ও নিত্যপণ্য আমদানি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে।

রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রাখায় বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৩৩ কোটি ডলার। গত বছর একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল প্রায় ৩ হাজার ৬৯৬ কোটি ডলার। এর আগে ২০২১ সালের আগস্টে রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল রিজার্ভ। বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ১ হাজার ৩৫৮ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে জানা যাচ্ছে, অগাস্ট মাস শেষে প্রায় ১৬০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অথচ গত বছর এই মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ২০৩ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় অগাস্ট মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ২১.৪৮ শতাংশ।
এমন সময়ে রেমিট্যান্স কমছে, যখন বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ নিয়ে সংকটের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশে ডলার সংকট চরম আকার ধারণ করেছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে।

এর আগে এপ্রিল এবং মে মাসেও রেমিট্যান্স অনেক কম এসেছিল। তবে ঈদের মাস হওয়ায় জুন মাসে ২.২০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে। এরপর আবার কমতে শুরু করেছে।

হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোই বাংলাদেশে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার বড় কারণ হিসেবে মনে করছেন ব্যাংক খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা। যদিও এর কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই।

এভাবে টাকা পাঠানোর কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত রেমিট্যান্স বা প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ আসলে বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবে দেশে আসে না বা সরকারি হিসাবে যোগ হয় না।

বৈধ চ্যানেলের বাইরে প্রবাসীরা তাদের আয় করা অর্থ দেশে পাঠিয়েছিলেন বলে বিশ্বাস করলেও আসলে ডলার, রিয়েল, দিনার বা রিঙ্গিত আসলে সেই দেশেই থেকে যায়।

প্রবাসী বাংলাদেশী যে দেশে রয়েছে, তিনি সেদেশের মুদ্রায় পেমেন্ট করেন। অন্যদিকে বাংলাদেশী টাকায় এখানে তার স্বজনদের বিনিময় 

মূল্য দিয়ে দেয়া হয়। https://www.dailysangram.info/post/536123