২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ৯:৪৫

ফের আগুন সন্ত্রাস শুরু করলো সরকার

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, সরকারের বিরোধীদল দমনের নানা ধরনের কৌশল ততই সুখ প্যাদান করে প্রকাশিত হয়ে পড়ছে। কিন্তু কৌশল হলো সেই পুরনো ধারারই। প্রথম ধাপ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। বিরোধীদলের প্রায় পঞ্চাশ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে। যার অধিকাংশই আবার গায়েবি মামলা। এই মামলার ঘটনা নিয়ে সারা পৃথিবীতে ছিঃ ছিঃ ডি ডি পড়ে গেছে। বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন পত্রিকায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে। গায়েবি মামলা হলো যে অপরাধ মূলত ঘটেইনি সেটা ঘটেছে বলে মামলাগুলো দায়ের করেছে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। মামলায় যাদের আসামী করা হয়েছে তাদের কেউ কেউ মৃত, কেউ কেউ ঐ সময়ে কারাগারে বন্দি, কেউ বা হজ্বব্রত পালন করতে ছিলেন মক্কা শরীফে। নিউইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায় বিএনপির কোনো কোনো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে প্রায় অর্ধ সহ¯্রাধিক করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। সে মামলায় হাজিরা দিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ঘোরেন। এখনও প্রতিদিন মামলা দায়ের করা হচ্ছে। সে মামলায় কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে আরো শত শত বিএনপির নেতাকর্মীকে অজ্ঞাতনামা আসামী করা হচ্ছে। এর সুবিধা হচ্ছে যখন তখন যাকে তাকে আটক করে বলা যাবে যে, সে এই সে ওই অজ্ঞাতনামা আসামীদের একজন। সেটা খুনের মামলাই হোক কিংবা ময়লার গাড়িকে আগুন দেয়াই হোক। আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির যেসব নেতাকর্মী প্রার্থী হতে পারে বা সামান্যতম ভূমিকা রাখতে পারে তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। কিংবা তাদের নামেই মামলা দেয়া হচ্ছে। ২০১৪ সাল ও ২০১৮ সালের ভুয়া নির্বাচনের সময়ও সরকার একই ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছিল। এখন পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতসহ আন্দেলনরত সব দল এই মর্মে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে যে, এই সরকার ও এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যাবে না। তারা যদি এই সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তাহলে সরকারের গ্রেফতার কৌশল ও গায়েবি মামলা শেষ পর্যন্ত কাজে দেবে না।

দ্বিতীয় কৌশল সরকারের আগুন সন্ত্রাসের ধুয়া তোলা। গত দশ বছর ধরে আওয়ামী লীগাররা সমস্বরে একটি কথা প্রচার করছে যে, বিএনপি-জামায়াত আগুন সন্ত্রাসী। অর্থাৎ এরা নির্বাচন প- করতে বিভিন্ন যানবাহনে ও স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করে ত্রাসের সৃষ্টি করছে। সে বিবেচনায় বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসী দল। কিন্তু এই অভিযোগ তারা কখনো প্রমাণ করতে পারেনি। ঐ সময়ে লক্ষণীয় ছিল যে, সে সময়ে যেসব বাসে আগুন লাগানো হয়েছিল তার অনেকগুলোই ছিল বিহঙ্গ পরিবহনের ভাঙাচোরা বাস। বিএনপির আন্দোলনের সময় অন্যান্য বাস সাবধানে চললেও বেপরোয়া গতিতে চলতো বিহঙ্গ। এই কোম্পানির মালিক আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতা পঙ্কজ দেবনাথ। শোনা যায়, এসব বাস জ্বালিয়ে পঙ্কজ দেবনাথ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সরকারি দলের সমর্থক বা এজেন্টরাই এই বাসগুলোতে আগুন দেয় বলে অভিযোগ আছে। এই এজেন্টরাই হোটেল শেরাটনের সামনে দোতলা বাসে গান পাউডার ছড়িয়ে আগুন দিয়েছিল বলে অভিযোগ উঠে। ঐ উপজেলার আওয়ামী লীগ সভাপতি সাংবাদিক সম্মেলন করে জানান যে, প্রধানমন্ত্রীর প্রিয়ভাজন হওয়ার জন্য পঙ্কজ দেবনাথ গানপাউডার ছড়িয়ে বাসে আগুন দিয়েছিল। এ নিয়ে তখন পক্ষ-বিপক্ষ হয়েছিল।

কিন্তু কার্যকারণ বিশ্লেষণ করে শেষ পর্যন্ত এ কথার সত্যতা পাওয়া যায় যে, সরকারি দলের লোকরা বা এজেন্টরা যানবাহন ও স্থাপনায় আগুন দিয়ে অগ্নিসন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। একথা বলেছিলেন মেহেন্দিগঞ্জ আওয়ামী লীগ নেতা ও বরিশাল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঈদুল ইসলাম। মঈদুলই বলেছিলেন যে, পংকজই বাসে আগুন দিয়ে এগার জন মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে।

এই ঘটনার পর বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিল, আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। দোষ চাপিয়েছে বিএনপির ওপর। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরওয়ার বলেছিলেন যে, বিরোধীদলের আন্দোলন দমন করার জন্য ২০১৩ সালে সরকারি মদদে গাড়িতে যে অগ্নিসংযোগ এবং মানুষ পুড়িয়ে মারা হয়েছে মাইদুলের বক্তব্যে তা প্রমাণ হয়।

২০১৩ সালে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের আরো ঘটনা প্রমাণ করে এর পেছনে ছিল সরকারি দলের মদদ ও সরকারি লোকেরাই সেসব কাজ করেছিল। সেসময় বিএনপির আন্দোলনের ফলে দেশে প্রায় অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়। সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখার জন্য যাত্রীবাহী যানবাহন ও পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল নির্বিঘœ করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়। সামনে চার-পাঁচ গাড়ি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, মাঝখানে কিছু বাস-ট্রাক এবং পেছনে আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ি। এ রকম সশস্ত্র পাহারার মধ্যে অবস্থিত বাসেও আগুন দেয়া হয়। যে আগুন দিল, সে কোথা থেকে এল, আগুন দিয়ে কোথায় চলে গেল, তার হদিস পাওয়া যায়নি। বলতে গেলে সরকারি পাহারায়ই আওয়ামী লীগ ও তাদের এজেন্টরা ধারাবাহিকভাবে এসব অগ্নিসংযোগের জন্য দায়ী। সে বিবেচনায় বড় আগুন সন্ত্রাসী তো হওয়ার কথা সরকারেরই। কিন্তু সরকার গোয়েবলসীয় কায়দায় অবিরাম বলতে থাকল যে, এসব অগ্নিসন্ত্রাস বিএনপি-জামায়াতের কা-। অতএব তারাই আগুন সন্ত্রাসী। এই কথাটা প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের পথের কর্মীরাও গলা ফাঁপিয়ে অবিরাম বলতে থাকেন। এমনকি এও বলা হয় যে, বিএনপির সঙ্গে কিসের আলাপ। তারা তো মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করে। তাদের নাম শুনলে নাকি পোড়া মানুষের গন্ধ ভেসে আসে।

এবারের বাসে আগুনের প্রথম ঘটনাটি ঘটেছে যাত্রাবাড়ি পেরিয়ে। বিএনপির পদযাত্রা ছিল সেদিন। একটি বাস আসছিল উত্তরার দিক থেকে। সেটি এসে যাত্রাবাড়িতে যাত্রী নামিয়ে দিয়ে গাড়ি ঘোরানোর চেষ্ট করছিল। রাস্তার দু’পাশে সারি করে দাঁড়িয়েছিলেন পুলিশ সদস্যরা তখন তিন-চারটি মোটরসাইকেলে করে কয়েকজন যুবক গাড়িতে উঠে পড়ে এবং যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। বাসের চালককেও নামিয়ে দিয়ে বাসে ঝটপট আগুন দেয়। পুলিশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এর মধ্যে অগ্নিসংযোগকারীরা আবার মোটরসাইকেল চালিয়ে চলে যায়। আমি ভেবেছিলাম বাসে অগ্নিসংযোগের জন্য আবার নাকি হুকুমের আসামী হিসেবে বিএনপি নেতাদের নামে অগ্নিসংযোগের মামলা দেয়। দিয়েছে কিনা বলতে পারি না।

দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছে নাটোরে, গত রোববার। তারুণ্যের রোডমার্চ উপলক্ষে বিএনপির নেতাকর্মীরা নাটোর থেকে বগুড়া যাচ্ছিলেন। পথে কিছু যুবক গাড়িটি থামিয়ে এর যাত্রীদের মারধর করে এবং পরে গাড়িটি ভাঙাচোরা করে তাতে আগুন দেয়। গাড়িতে হামলাকারীরা বিএনপি নেতাকর্মীদের চাইনিজ কুড়ালসহ বিভিন্ন ধারাল অস্ত্র দিয়ে কোপায়। হামলাকারীরা সকাল ৬টার দিকে সদরের তেম্বাভিষা হাট এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়ে গাড়িটি ভাঙচুর করে। তাদের হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন লালপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়কসহ আরো ৩০-৩৫ জন নেতাকর্মী। এ বিষয়ে নাটোর জেলার আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সোনা বলেছেন, হামলার সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কারো ওপর কোনো হামলা করেনি। নাটোর সদর থানার ওসি নাছিম আহমেদ বলেন, গাড়িতে আগুন লেগেছে শুনে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। গাড়ির আগুন নেভানো হয়েছে তবে কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে জানা নেই। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এবার আগুন সন্ত্রাসী কে হবে?

https://www.dailysangram.info/post/536083