২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:৫৪

পদোন্নতিতে ধীরগতি, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের শঙ্কা

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মচারী নিয়োগের নতুন বিধিমালায় এমন কিছু বিধি রাখা হয়েছে, যা শিক্ষক ও প্রশিক্ষকদের পদোন্নতি-পদায়নে ধীরগতির পাশাপাশি জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের আশঙ্কা তৈরি করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এতে কর্মক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর ‘প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা-২০২৩’-এর গ্যাজেট প্রকাশ করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিধিতে বলা হয়, সহকারী উপজেলা বা থানা শিক্ষা কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিভাগীয় প্রার্থীদের জন্য ৮০ শতাংশ পদ সংরক্ষিত থাকবে।

প্রার্থীদের বয়সসীমা হবে ৪৫ বছর। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের সহকারী উপজেলা বা থানা শিক্ষা অফিসার পদে পদায়নের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১০ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিধিমালায় বলা হয়, প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষক (পিটিআই ইনস্ট্রাক্টর) পদে ৩৫ শতাংশ পদ পিটিআই শিক্ষক ও সহকারী ইনস্ট্রাক্টর (উপজেলা বা থানা রিসোর্স সেন্টার) এবং সহকারী গবেষণা পদ থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হবে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে সমন্বিত পদ্ধতির পরিবর্তে আনুপাতিক পদ্ধতি নির্ধারণ করেছে মন্ত্রণালয়।

এতে হতাশা প্রকাশ করেছেন সহকারী শিক্ষক ও পিটিআই প্রশিক্ষকরা।
তাঁরা বলছেন, এমন সিদ্ধান্তের কারণে সহকারী শিক্ষকদের উচ্চতর গ্রেডে পদায়নে ধীরগতি ও পিটিআই প্রশিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েকজন সহকারী শিক্ষক কালের কণ্ঠকে জানান, একজন শিক্ষক ৩০ বছর বয়সে চাকরিতে যোগদানের ১০ বছর পর উচ্চতর পদে আবেদন করতে পারবেন। এতে পরবর্তী ধাপগুলোতে পদায়নের রাস্তা অনেকটাই মন্থর হবে।

পদায়নে এই ধীরগতি থাকলে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। এতে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা হুমকিতে পড়বে।

প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক ১০ম গ্রেড বাস্তবায়ন সমন্বয় পরিষদের সমন্বয়ক মু. মাহবুবর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, সহকারী উপজেলা বা থানা শিক্ষা অফিসার পদে পদায়নের ক্ষেত্রে সহকারী শিক্ষকদের জন্য তিন বছরের অভিজ্ঞতা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এতে নতুন ও পুরনো সব শিক্ষক বিভাগীয় পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন।

মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, নতুন বিধিমালার অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে পিটিআই ইনস্ট্রাক্টরদের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘন হবে।

সমন্বিত পদোন্নতির পরিবর্তে আনুপাতিক হারে পদোন্নতির শর্তের কারণে অনেক কর্মচারীকে জুনিয়রের অধীনে কাজ করতে হতে পারে, যা মানহানিকর।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পিটিআই প্রশিক্ষক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পিটিআই সুপারিনটেনডেন্ট পদে পদোন্নতির জন্য ন্যূনতম দুই বছর। সমন্বিত পদ্ধতিতে পদোন্নতি না হয়ে আনুপাতিক হারে পদোন্নতি হলে দুই বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জুনিয়র পিটিআই সুপারিনটেনডেন্ট পদে পদোন্নতি পেতে পারেন। তখন দুজন একই স্থানে কর্মরত থাকলে আমার জুনিয়রের অধীনে আমাকে কাজ করতে হবে। চাকরির ক্ষেত্রে এটা বেশ অসম্মানজনক। আবার দুজনের পদোন্নতি হলেও একই পদমর্যাদায় কাজ করতে হবে, যা জনপ্রশাসন থেকে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ বিধিমালার পরিপন্থী।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন হবে মাদরাসা সুপারদের ক্ষেত্রেও। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা সুপারদের ১৫ বছরের জুনিয়র। অথচ উভয় পদ থেকেই উপপরিচালক পদে আনুপাতিক হারে পদোন্নতি দেওয়া হবে। ১৫ বছরের জুনিয়র শিক্ষা কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে সুপারের চেয়ে জ্যেষ্ঠতা অর্জন করবেন। যেসব সুপার পদোন্নতি পাবেন না, তাঁদের এসব জুনিয়র শিক্ষা কর্মকর্তার অধীনে কাজ করতে হবে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রায় ২৩ ধরনের স্টেকহোল্ডার (অংশীজন) থাকার কারণে বিধিমালা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকা খুব স্বাভাবিক। প্রত্যেক স্টেকহোল্ডার কেবল নিজের স্বার্থ দেখবেন। সরকার সবার স্বার্থ রক্ষায় যেভাবে ভারসাম্য রক্ষা করা যায় সেভাবে বিধিমালা করেছে। যৌক্তিক ও সরকারি বিধি-বিধান অনুযায়ী ভারসাম্য রক্ষা করে বিধি করা হয়েছে। এখানে কারো প্রতি বৈষম্য বা পক্ষপাত করা হয়নি।

সচিব বলেন, বিধিমালাটি জনপ্রশাসন, অর্থ মন্ত্রণালয়, কেবিনেট ও আইন মন্ত্রণাল—মোট চারটি মন্ত্রণালয়ের যাচাইয়ের মাধ্যমে বিধিমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে। পরে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা এখনো স্বাধীন হয়নি। দেশে যত মন্ত্রণালয় আছে, সব মন্ত্রণালয়ে ক্যাডার সার্ভিস আছে, শুধু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নেই।

ক্যাডার সার্ভিস না থাকার কারণে অসুবিধা উল্লেখ করে তিনি জানান, তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যায়ে কেউ যেতে না পারার কারণে দক্ষতার সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালিত হচ্ছে না। অভিজ্ঞতা ছাড়াই প্রশাসনিক কর্মকর্তারা শীর্ষ পদে এসে প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনা করেন। এ কারণে বৃত্তি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত হোঁচট খায়।


https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/09/21/1320024