২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:১৭

নির্বাচন সামনে, সদর্পে ফিরছে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা

ব্যস্ত সড়কে মাত্র দেড় মিনিটে ফিল্মি স্টাইলে প্রকাশ্যে গুলী চালিয়ে ও কুপিয়ে আহত করা হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনসহ তিনজনকে। ঘটনাটি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করায় তদন্তে নামে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পরীক্ষা করে পুলিশ নিশ্চিত হয় দু’টি শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে বিরোধের জেরে ঘটেছে এ ঘটনা। গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়, মোটরসাইকেলে থাকা সাত-আট অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী মামুনের ওপর ওই হামলায় জড়িত কারাগারে থাকা আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের সহযোগীরা। হঠাৎ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে বিরোধের ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সংশ্লিষ্টদের ধারণা-দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সদর্পে ফিরছে সন্ত্রাসীরা। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা ইতোমধ্যে নিজেদের জাহির করতে তৎপরতা শুরু করেছে। আর এতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠতে পারে আন্ডারওয়ার্ল্ড।

গত সোমবার রাতে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে লক্ষ্য করে ছোড়া গুলীতে আহত মোটরসাইকেল আরোহী আইনজীবী ভুবন চন্দ্র শীল লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন তার স্বজনেরা। এই ঘটনায় তার স্ত্রী রতœা রানী শীল বাদী হয়ে মামলা করেছেন। গতকাল বুধবার সকালে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের এসি এস এম আরিফ রায়হান এ তথ্য জানিয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার রাত পৌনে ১০টার দিকে তেজগাঁও বিজি প্রেস থেকে সামান্য দূরত্বে একটি প্রাইভেটকারকে হঠাৎ ঘেরাও করে ফেলে চারটি মোটরসাইকেলে থাকা সাত-আট অস্ত্রধারী যুবক। প্রাইভেটকারে যাত্রী হিসেবে ছিলেন ঢাকার অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ মামুন, তার দুই সহযোগী খোকন ও মিঠু। অস্ত্রধারীদের দেখেই মামুন প্রাইভেটকার থেকে নেমে দৌড়ে বিজি প্রেসের পাশের গলিতে পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় হামলাকারীরা গলির ভেতরে মামুনকে ধাওয়া করে। এক পর্যায়ে তারা মামুনকে কোপাতে থাকে। এ সময় এলোপাতাড়ি গুলীও চালানো হয়। সন্ত্রাসীদের ওই গুলী গিয়ে লাগে রাস্তার উল্টো পাশ দিয়ে যেতে থাকা মোটরসাইকেল আরোহী আইনজীবী ভুবন চন্দ্র শীলের মাথায়। আহত হন আরিফুল হক ইমন নামের আরেক পথচারীও। আইনজীবী ভুবন ভাড়ার মোটরসাইকেলে মিরপুর থেকে তার ফকিরাপুলের বাসায় ফিরছিলেন। তিনি বর্তমানে ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে আছেন। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম জানান, ঘটনার পর মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সে জানিয়েছে, জামিনে বের হওয়ার পর ১২ সেপ্টেম্বর আদালত এলাকায় মামুনের সঙ্গে সন্ত্রাসী ইমনের সাক্ষাৎ হয়েছিল। হাজিরা দিতে তারা আদালতে যান। তখন আদালত এলাকায় ইমন হাতের ইশারায় মামুনকে গুলী করার মতো দেখিয়ে মেরে ফেলার বার্তা দেন। একসময় তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এখন আলাদা গ্রুপ করা নিয়ে মামুন ও ইমনের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। দীর্ঘদিনের শত্রুতার জেরে হত্যার উদ্দেশ্যেই মামুনের ওপর হামলা চালায় তারা। মামুন সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই শহীদ সাঈদ আহমেদ টিপু ও চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার আসামী। সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় মামুন ২৬ বছর জেল খেটে তিন মাস আগে জামিনে মুক্তি পান। তার পর থেকে তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল ইমন গ্রুপ। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, সন্ত্রাসী ইমন ও মামুন একসময় ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও এলাকার আতঙ্ক ছিলেন। তারা একসঙ্গে দীর্ঘদিন আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জোশেফের হয়ে কাজ করেছেন। ইমন-মামুন দু’জনই চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার আসামী। ওই মামলায় ইমন কারাগারে থাকলেও তিন মাস আগে জামিনে বের হয়েছেন মামুন। কারাগারে থাকা অবস্থাতেই দু’জনের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। সেই বিরোধের জেরে এ হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা মামুনেরও। এরআগে দুবাইয়ে আত্মগোপন করা ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম জিসান আহমেদ মন্টি ওরফে জিসানের নির্দেশে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে খুন করা হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিকেরও যোগসাজশ রয়েছে। ফ্রিডম মানিক বর্তমানে ভারতে আত্মগোপন করে আছেন।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ঝিমিয়ে পড়া আন্ডারওয়ার্ল্ড হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এক সময়ের আলোচিত ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের তৎপরতা শুরু হয়েছে। এসব সন্ত্রাসীর অনেকেই বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে বিদেশে পলাতক আছে। আবার অনেকে আছে কারাগারে। কিন্তু আড়ালে-আবডালে থেকেই তারা আবার সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি বেশ কিছু ঘটনা তার জানান দিচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, বিদেশে পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার চিহ্নিত অপরাধীদের নিয়ে অরাজকতা তৈরি করার নীলনকশা কষছে। কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও সহযোগীদের নানা বিষয়ে নির্দেশনা দিচ্ছে। এদের অনেকে রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত রয়েছে। এসব তথ্য পেয়ে নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দীর্ঘদিন আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ বিভিন্ন অপরাধী ভারত, মালয়েশিয়া, দুবাই, ইতালি, কানাডা, লন্ডন, ফ্রান্স, আমেরিকাসহ নানা দেশে আত্মগোপন করে আছে। তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশে অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকা- চালিয়ে আসছে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গন। চলছে পালটাপালটি রাজনৈতিক কর্মসূচি। রাজধানী ঢাকায় আধিপত্য ধরে রাখতে রাজনৈতিক দলগুলো বেশ তৎপর। প্রায়ই ঘটছে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা। এক্ষেত্রে সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হচ্ছে-বিশেষ করে রাজধানীর চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা সক্রিয় হচ্ছে মিছিল-মিটিংয়ে। কেউ কেউ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রশাসনের ছত্রছায়ায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টাও করছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অবৈধ অস্ত্র আমদানিও বেড়েছে। প্রায়ই সীমান্ত এলাকায় অবৈধ অস্ত্র জব্দ করা হচ্ছে। অন্যদিকে পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা অনেকেই প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা নির্বাচনের আগে পরিকল্পনামাফিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বিভিন্ন এলাকায় আতঙ্ক তৈরি করবে।

কে এই শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন: গত জোট সরকারের সময়ে পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন প্রায় ১৬ বছর ধরে কারাগারে আটক। দেশে গ্রেফতারে ভয়ে ইমন পালিয়ে ভারতে যায়। এরপর কলকাতা পুলিশের হাতে আটকের পর ২০০৮ সালের ৭ মার্চ তাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেয় কলকাতা পুলিশ। সেই থেকে কারাগারেই আছে পুলিশের তালিকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন। ঢাকায় ফিরিয়ে আনার পর ইমনকে সে সময় ব্যাপক দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল সিআইডি পুলিশ। উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান অল্প বয়সেই অন্ধকার জগতে পা বাড়ায়। পুলিশের তথ্যমতে, সন্ত্রাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুনের অভিযোগ ছিল ইমনের বিরুদ্ধে। তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা মকবুল হোসেনের (মৃত) ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। পারিবারিক একটি সূত্র জানায়, ইমন এসএসসি পাসের পর বখাটে হয়ে যায়। সে এইচএসসিতে ভালো ফল করেনি। এরপর পড়াশোনা ছেড়ে পুরোপুরি সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে। পুলিশ জানায়, ২০০৭ সালের ৮ ডিসেম্বর কলকাতার মির্জা গালিব স্ট্রিটের ফ্ল্যাট থেকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। ঢাকায় এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলার সূত্র ধরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে সময় পুলিশ জানিয়েছিল, ইমন ঢাকায় এক ব্যবসায়ীর কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছিলেন। সেই ফোনের সূত্র ধরে ঢাকার সিআইডি পুলিশ বিষয়টি কলকাতা পুলিশকে জানায়। এরপর কলকাতা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। ইমন সেখানে নিজের নাম পাল্টে রেখেছিলেন স্বপন সরকার। সেই নামে সব পরিচয়পত্র জোগাড় করেছিলেন কলকাতায়। এই গ্রেপ্তারের আগে ২০০১ সালের ৩০ জুন ইমন প্রথম ধরা পড়েছিলো কলকাতা পুলিশের হাতে। তখন ইমন স্ত্রী লীনাকে নিয়ে থাকতেন মির্জা গালিব স্ট্রিটের উত্তরা কটেজে। ধরা পড়ার পর এদের বিরুদ্ধে বে আইনি অনুপ্রবেশের অভিযোগে (ফরেনার্স আইন) কলকাতায় মামলা হয়। ইমনের স্ত্রী লীনা আদালতে দোষ স্বীকার করে মুক্তি পায়। ১৯৯৮ সালে বনানী ট্রাম্পস ক্লাবে চিত্রনায়িকা দিতির স্বামী সোহেল চৌধুরী খুনের পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ইমনকে গ্রেপ্তার করে। কয়েক মাস জেল খাটার পর তিনি জামিনে ছাড়া পেয়ে ভারতে চলে যায়। কলকাতার গড়িয়াহাটের কনক সরকারের বাড়িতে ওঠে। ১৯৯৯ সালের ৩০ জুন কলকাতা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। ২০০১ সালে জামিন পায়। সে বছরের অক্টোবরে ইমন দেশে ফেরে। ২০০৪ সালে র‌্যাবের ধাওয়া খেয়ে আবার কলকাতায় চলে যায় সে। একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু পাং বাবুকে হত্যার মধ্যদিয়ে সন্ত্রাসীর তালিকায় নাম ওঠে ইমনের। এ হত্যা মামলায় তাকে প্রধান আসামী করা হলেও কোনো দিন বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি।

https://www.dailysangram.info/post/536033