২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ১০:২৪

সিন্ডিকেটে অসহায় যাত্রী

দিনের পর দিন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠেছে। রেন্ট-এ কার চালক সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় সাধারণ যাত্রী। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রকাশ্যে অনিয়মের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় হয়রানি আরো বাড়ছে। নিয়ম-নীতি দেখার কেউ নেই। প্রবাসে কাজ করে যারা রেমিটেন্স পাঠান দেশে; তারা দেশে আসা যাওয়া করতে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হন। ভুক্তোভোগী প্রবাসীরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার কারণেই ঘটছে এমনটা। প্রবাস থেকে প্রিয়জন ফিরছেন আবার অনেকে বিদেশে যাচ্ছেন। দেশি-বিদেশি বিমান যাত্রীদের বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে এবং বের হতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে। বিদেশ থেকে যে বিনিয়োগকারীরা আসছেন তাদেরও পড়তে হচ্ছে যানজট ভোগান্তিতে। বিমানবন্দরে এ ভোগান্তি যেন নিয়তি হয়ে গেছে। বিমানবন্দর এলাকায় আসলে কারোই যেন নিস্তার নেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সব সময়ই লেগে থাকে যানবাহনের জটলা। বিশেষ করে পার্কিং করা সিএনজি, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসের কারণে এই জটলা সৃষ্টি হয়। রাস্তায় গাড়ি ও সিএনজি চালিত অটোরিকশা দাঁড় করানোর কারণে সৃষ্টি হয় আরও বেশি যানজট। রাস্তার উপরেই দাঁড়িয়ে থেকে গাড়ির চালকরা যাত্রীদের ডাকতে থাকেন। এভাবে যাত্রীদের ডাকাডাকির কারণে দীর্ঘসময় গেলেও দায়িত্বরত কর্মীরা কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছেন না। এই যানবাহনের জটলা, অব্যবস্থাপনার পার্কিং ও দুর্ভোগ থেকে দ্রুত মুক্তি চান বিমানবন্দরে আসা লোকজন।

বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা জানান, যেহেতু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর একটি দেশের প্রবেশ তোরণ হিসেবে বিবেচিত, তাই সার্বিক কার্যক্রম ও সেবা দেশের ভাবমূর্তির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রেন্ট-এ কার প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজে সার্ভিসসহ আরও কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। এসব অঙ্গতি দূর করতে তারা জোর দিচ্ছেন। কর্মকর্তারা মনে করেন, জরুরি ভিত্তিতে এসব সংস্কার করা না হলে আধুনিকতার দৌড়ে আমরা পিছিয়ে পড়ব।

প্রবাসীরা বলছেন, অবহেলা আর অব্যবস্থাপনার কারণে দিনের পর দিন বাড়ছে ভোগান্তি। বিশ্বের কোন বিমানবন্দরেই এতো লেট হয় না আমাদেরকে নিজ দেশের বিমানবন্দরে যতটা দেরি আর হয়রানির শিকার হতে হয়। আমরা চাই যাতে করে খুব দ্রুত এই সমস্যাটা ঠিক হয়ে যায়।

দীর্ঘ সাত বছর পর বিদেশ থেকে দেশে আসেন নারায়ণগঞ্জের শরীফ আহমেদ। চারমাস ছুটি কাটানোর পর আবার সউদী আরবে যাচ্ছেন তিনি। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে তিনি ইনকিলাবকে বলেন, ছুটি শেষে আবার বিদেশে যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে আসলাম। কিন্তু পুরো রাস্তা গাড়িতে করে স্বাচ্ছন্দ্যে আসতে পারলেও বিমানবন্দরের সামনে এসে পড়তে হয় ভোগান্তিতে। বিমানবন্দরের ভেতরে প্রবেশমুখে গাড়ির জটলার কারণে এক স্থানেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়েছে। আমার মতো অনেকেই এখানে এসে দীর্ঘ সময় এক জায়গায় বসে থাকতে হচ্ছে। এমন অবস্থায় আমাদের ফ্লাইট মিস হওয়ারও আশঙ্কা থেকে যায়।

বিদেশ ফেরত প্রবাসী কাউসার জানিয়েছেন, ইমিগ্রেশন থেকে বের হয়ে লাগেজ নিয়ে যাত্রীদের বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে। কার পার্কিংয়ের অবস্থা জটিল। বিমানবন্দরের সামনে ও কার পার্কিংয়ের স্থানে সারা দিন ট্যাক্সিক্যাব ও দালালদের যানবাহনে ভর্তি থাকে। ফলে যাত্রীদের যানবাহন নিয়েও নানা সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। এটাই বিমানবন্দরের প্রতিদিনের চিত্র।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বিমানবন্দর সড়কে এবং আশপাশে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২০ ঘণ্টাই যানজট লেগে থাকে। বিদেশগামী যাত্রীদের গাড়ি করে বিমানবন্দরের মূল গেইট থেকে টার্মিনাল পর্যন্ত যেতে লেগে যায় দুই থেকে তিন ঘণ্টা। একইভাবে বিদেশ ফেরত যাত্রীদের টার্মিনাল থেকে মূল গেইট পর্যন্ত আসতে সময় লাগে এক থেকে দুই ঘণ্টা। প্রতিদিনই শত শত গাড়ি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে পার্কিং করা হয় টাকার বিনিময়ে। প্রভাবশালীরা এই টাকা উঠান বলে জনা গেছে। গাড়ি প্রতি প্রথম তিন ঘণ্টার জন্য দিতে হয় ১০০ টাকা। আর পরবর্তী প্রতি ঘণ্টার জন্য দিতে হয় ৩০ টাকা করে। নির্ধারিত টাকা দিয়েও অনেক সময় অতিরিক্ত সময় বসে থাকতে হয় ভাড়া চালিত প্রাইভেটকার ও মাক্রোবাস চালকদের। তারা বলছেন, পার্কিং সমস্যার কারণেই বিমানবন্দরসহ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। বিমানবন্দর এলাকায় পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা না থাকায় এ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।

প্রতিদিন শাহজালাল বিমানবন্দরে ওঠানামা করে ১৪০ থেকে ১৫০টি ফ্লাইট। যাত্রীর সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ হাজার। যাত্রীদের বিদায় ও অভ্যর্থনা জানাতে আসেন ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ। বছরে গড়ে ৬০ লাখ মানুষ এ বিমানবন্দরে আসা-যাওয়া করেন। ফলে পার্কিংসহ গমনাগমনের বিভিন্ন স্থানে চলছে বড় ধরনের বাণিজ্য। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জমজমাট গাড়ি পার্কিং বাণিজ্য। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমতো ফি আদায় করা হচ্ছে। এ নিয়ে পার্কিংকারী গাড়ি ও চালকের সঙ্গে প্রায়ই বাকবিত-া ঘটছে ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের। এই পার্কিং বাণিজ্যের পেছনে ক্ষমতাসীন দলের শক্তিশালী সিন্ডিকেটকে দুষছেন সংশ্লিষ্টরা।
গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিন ঘুরে পুলিশের অব্যবস্থাপনা প্রত্যক্ষ করা গেছে। বিমানবন্দর থানার এএসআই দুলাল, এসপিবিএনয়ের নায়েক আব্দুর রহিম ও কনস্টেবল চিন্ময়কে প্রকাশ্যে সিএনজি ও প্রাইভেটকার চালকদের কাছ থেকে ১০০ ও ২০০ টাকা করে নিতে দেখা গেছে। একই সময় যারা টাকা দিতে অস্বীকার করছেন তাদের ভেতরে ঢুকতে বাধা দেয়া হচ্ছে। একই সাথে অনেককে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে।

এ বিষয়ে নায়েক আব্দুর রহিম বলেন, আমরা কারো কাছ থেকে টাকা নিচ্ছি না। নিয়ম অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করছি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শাহজালালে গাড়ি পার্কিং এলাকায় ইজারা প্রতিষ্ঠানের লাইনম্যানরা পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা চাহিদামতো বখশিশ না পেলে গাড়ি পাঠিয়ে দেন পেছনের সারিতে। সহজে যাত্রী পেতে বাধ্য হয়েই লাইনম্যানকে ৫০ থেকে দেড়শ’ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয় সিএনজি, কার ও মাইক্রো চালকদের। লাইনম্যানদের ঘুষ দিয়ে রাস্তার মধ্যেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখেন চালকরা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিমান ভ্রমণ পরবর্তী যাতায়াতের জন্য লক্কড়ঝক্কড় মার্কা কার ও মাইক্রোবাস এবং যাত্রীদের সঙ্গে অপেশাদার আচারণ। ইচ্ছামতো ভাড়া আদায়, দুর্ব্যবহারের পাশাপাশি যাত্রীদের মালামাল লুটপাটেরও অভিযোগ রয়েছে। বিমানবন্দরে যাত্রীদের পরিবহনে ইজারা নেয়া যে প্রতিষ্ঠান রেন্ট-এ কার সার্ভিস দিয়ে থাকে, তাদের বেশির ভাগই চলছে লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি দিয়ে। ফলে বিমানবন্দর চত্বরে ঢুকেই ভাঙাচুরা এসব গাড়ি দেখে বাংলাদেশের প্রতি নেতিবাচক ধারণা যাচ্ছে বিদেশিদের কাছে। তা ছাড়া যাত্রী ভোগান্তিতেও চরমভাবে বিঘিœত হচ্ছে দেশ ও সরকারের ভাবমর্যাদা।

বিমানবন্দরে রেন্ট-এ কার চালক পারভেজ ইনকিলাবকে বলেন, আমরা যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করি এ অভিযোগ সঠিক না। আমাদেরকে প্রতি পদে পদে টাকা দিতে হয়। সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তাদের টাকা না দিলে নানাভাবে হয়রানী করেন। এছাড়া পুলিশকেও চাঁদা দিতে হয়।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবৈধভাবে যারা আমাদের কাছ থেকে টাকা নেয় তারা খুব প্রভাবশালী। এদের সিন্ডিকেট অনেক উপরে। বেশি বললে বিমানবন্দরে ব্যবসা করা সম্ভব নয় বলে তিনি অভিযোগ করেন।

গাড়ি চালক আকরাম হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, আমি প্রায়ই বিমানবন্দরে ট্রিপ নিয়ে আসি। বিমানবন্দরের ভিতরে গাড়ি প্রবেশ করালেই দিতে হয় ১০০ টাকা। গাড়ি বসে থাকলেও ঘণ্টা হিসেবে টাকা দিতে হয়। এভাবে অনেক গাড়ি এখানে বসে থাকার কারণেও যানজটের সৃষ্টি হয়।

অভিযোগ রয়েছে, ইজারাদাররা খুশিমতো গাড়ি পার্কিং ফি বাড়িয়ে দিচ্ছে, গাড়িচালকদের হয়রানি করছে আর তাদের সহযোগী হচ্ছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী। গতকাল একাধিকবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

https://dailyinqilab.com/national/article/603803