২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ১০:১৪

সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সব পাটকল বন্ধ

একমাত্র ক্রেতা বেসরকারি মিল মালিকরা

১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন দাম চরম বিপাকে পাটচাষিরা

একসময় বর্ষাকে রাঙিয়ে দিত সোনালি আঁশ পাট। কৃষকের জমিতে পানির ঢেউয়ের মতো পাটগাছ দোলার সেই দৃশ্য এখনো যে নেই, তা নয়। সঙ্গে কাঁচা পাট পানিতে ভিজিয়ে রেখে আঁশ ছাড়ানোর জন্য কৃষকের যে প্রাণান্তকর চেষ্টা, সেটিও আছে। বিস্তৃত জলাধারজুড়ে পাটের সারি। পানি থেকে আঁশ ছাড়ানোর পর তা নানাভাবে রোদে শোকানো। সবই আছে। কিন্তু যে কৃষকরা ঘাম ঝরিয়ে সোনালি আঁশ তৈরি করেন তারা শুধু বঞ্চিত হন ন্যায্যমূল্য থেকে। সরকারি মিল বন্ধ। ন্যায্যমূল্য দিতে চান না বেসরকারি পাটকল মালিকরা।

সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সব পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সরকারিভাবে আগের মতো আর পাট কেনা হয় না। এখন দেশে পাটের একমাত্র ক্রেতা বেসরকারি পাটকল মালিকরা। তারাও পাটচাষিদের তেমন একটা মূল্যায়ন করেন না। দিতে চান না ন্যায্যমূল্য। এ অবস্থায় ‘মাথার ঘাম পায়ে ফেলে’ তৈরি পাট নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা।

বিগত ১০ বছরের মধ্যে এবার পাটের দাম নিম্নমুখী। বর্তমানে প্রতি মন পাট ১ হাজার ৮শ থেকে ২ হাজার ২শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক বছর আগেও প্রতি মন পাট ২ হাজার ৪শ টাকা থেকে ২ হাজার ৮শ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বাড়তি দামের আশায় যারা গত বছর পাট সংরক্ষণ করেছেন, তারা আরও বড় ধরনের লোকসানে পড়েছেন।

পাট ব্যবসায়ীদের বড় সংগঠন বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএ) বলছে, সরকার পাট খাতে ভর্তুকি এবং ব্যাংক থেকে নামমাত্র সুদে ঋণ এবং প্রণোদনা দিয়ে পাট শিল্পকে বাঁচাতে পারে। পাটজাত পণ্য যারা রপ্তানি করে তাদের নগদ সহায়তা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সরকারি সহায়তা না পেলে পাটসংশ্লিষ্ট সবাইকে পথে বসতে হবে।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুর রউফ যুগান্তরকে বলেন, সরকারি পাটকল বন্ধের কারণে পাটের দাম কমেছে-এটা যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে না। পাটকল বন্ধের পরও পরপর দুই বছর পাটের দাম বর্তমান বাজার দরের চেয়ে বেশি ছিল। এখন কি কারণে পাটের দাম কমেছে তা বলা মুশকিল। তবে ধারণা করা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে পাটজাত শৌখিন পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় পাটের দাম কমেছে। আন্তর্জাতিক মহামন্দার প্রভাব পড়েছে পাটের ওপর।

তিনি জানান, সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত মিলগুলো দেশের ১০ শতাংশ পাট ব্যবহার করত। বাকি ৯০ ভাগ পাটই ব্যবহার করতেন বেসরকারি মিল মালিকরা। সুতরাং সরকারি পাটকল বন্ধের প্রভাব পাটের বাজারদরের ওপর পড়েছে বলে মনে করি না।

পাটকলগুলো বন্ধের পর ১ হাজার ৩শ একর জমি এবং মূল্যবান মেশিনপত্র সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বন্ধ হওয়া ১৯টি সরকারি মিলের মধ্যে ইতোমধ্যে ৯টি ফের উৎপাদন চালু করতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। আরও ৮টি মিল চালুর জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করার পর্যায়ে আছি। তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ জামানত রেখে সরকারি মেশিনপত্র এবং জমি ব্যবহার করে পাটজাত পণ্য উৎপাদনে যাবে।

বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) সিনিয়র সহসভাপতি আরজু রহমান ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, পাঁচ বছর আগে সাধারণ পাটের মন ছিল ৫ হাজার টাকা। ভালোমানের পাটের মন ছিল ৬ হাজার টাকা। গত বছর দেশে প্রায় ২৪ লাখ বেল পাট অবিক্রীত রয়ে গেছে। এবার উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৮৬ থেকে ৮৭ লাখ বেল। বিপুল পরিমাণ পাট দেশে মজুত অথচ বাজারে দাম নেই। কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত। তিনি আরও জানান, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত উৎপাদনের ৮০ থেকে ৯০ ভাগ পাটজাত পণ্য এবং দ্রব্য নিজেরা ব্যবহার করে। অথচ বাংলাদেশ উৎপাদনের ৯০ ভাগ বিদেশে রপ্তানি করে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো কারণে সংকট হলে তার ধাক্কা গিয়ে কৃষকের গায়ে লাগে।

তিনি আরও জানান, ইউরোপ এবং আফ্রিকার বাজারে পাটজাত দ্রব্যের বিপুল চাহিদা ছিল। বিশ্বজুড়ে বিরাজমান মহামন্দায় সেখানে এখন চাহিদা কমে গেছে। পাকিস্তান ডলার সংকটের কারণে পাটজাতপণ্য নিতে পারছে না। তাছাড়া বিশ্বমানের পাটজাত পণ্য উৎপাদনে বেসরকারি পাটকলগুলোর সক্ষমতার অভাব রয়েছে। বিরাজমান বাস্তবতায় সরকারকে এ খাতের কৃষক, রপ্তানিকারক, ব্যবসায়ী ও মিল মালিকদের পাশে দাঁড়াতে হবে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব সচিব আবু জুবায়ের হোসাইন বাবলু যুগান্তরকে বলেন, সরকার দেশের ১৯টি ফসলের ওপর প্রণোদনা দিয়ে থাকে। তারমধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার ৪ লাখ পাটচাষিকে ৮ কোটি ১০ লাখ টাকা প্রণোদনা দিয়েছে। প্রত্যেক পাটচাষি ২০২ টাকা ৫০ পয়সা করে প্রণোদনার অর্থ পেয়েছেন। চলতি অর্থবছর সরকার ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬০০ জন পাটচাষির জন্য ৮ কোটি ৪৯ লাখ ৯ হাজার ১৫ টাকা সম্ভাব্য প্রণোদনার জন্য বরাদ্দ রেখেছে। এই অর্থবছরে পাটচাষিরা প্রত্যেকে ২৫২ টাকা করে পাবে। তিনি আরও জানান, সারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় গত বছরের চেয়ে এ বছর বরাদ্দ বেশি রাখা হয়েছে।

পাট গবেষণা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের পাট আঁশের মান পৃথিবীর অন্যান্য পাট উৎপাদনকারী দেশগুলোর চেয়ে অনেক ভালো। উৎপাদনের দিক থেকে ভারতের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। পাট রপ্তানির ক্ষেত্রে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। বাংলাদেশের পাটের খ্যাতি এখনো বিশ্বজোড়া। বর্তমানে গোটা বিশ্বে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্ব বাজারে পাটের চাহিদা এখনো রয়েছে। বিশ্ব বাজারের চাহিদা কাজে লাগিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখার পরিবর্তে সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

তারা আরও জানান, পাটের বাজার বেসরকারি মিল মালিকরা নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা যে মূল্য বলবে, তার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে সরকারি মিল চালু থাকলে এবং সরকারি মিলের জন্য পাট ক্রয় করা হলে বাজারে ভারসাম্য থাকত। এখন সেই ভারসাম্যটাও নেই।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্বের যে কটি দেশের মানুষ ভাত খেয়ে অভ্যস্ত তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সে কারণে দেশে ধান উৎপাদনে সরকার কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। মানুষ বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে কমদামে চাল ক্রয় করছে। দেশের ভেতরে চালের গ্রাহক সবাই। অনুরূপ দেশে বিপুল পরিমাণ পাট উৎপাদন হয়, অথচ দেশের পাটজাত দ্রব্য ব্যবহারে কারও আগ্রহ নেই। পাটজাত দ্রব্যের স্থান দখল করেছে পলিথিন। নিজেদের উৎপাদন যদি দেশে ব্যবহার না করা হয়, বিপুল পরিমাণ পাট নিয়ে কৃষককে বিপাকে পড়তেই হবে। এ ক্ষেত্রে পলিথিনের দৌরাত্ম্য কমালে পাটজাতপণ্যের চাহিদা বাড়বে।

পাট অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, কাঁচা পাট এবং পাটের সুতা ভারতে চলে যাচ্ছে। কারণ, তাদের চাহিদা বেশি। তারা আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা করে। ভারতের সিংহভাগ পাটকল বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। তারা বিশ্বমানের পাটজাত পণ্য উৎপাদন করে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হলেও ভারতে জাতীয় পাট কমিশন (জাতীয় জুট কমিশন) রয়েছে। জুট কমিশন ঠিক করে দেয় কোন মিল কত পরিমাণ পাটজাত দ্রব্য উৎপাদন করবে। বিপরীত দিকে বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নেই বলে দাবি করেন তারা।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/719931