১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ২:১৭

মুদ্রণ-সরবরাহে নৈরাজ্য

সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি’র বাজার। দেশের সাবরেজিস্ট্রি এবং আদালত অঙ্গনে দেখা দিয়েছে তীব্র স্ট্যাম্প সঙ্কট। সঙ্কটের তীব্রতার প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি লিখেছে। তাতে সুপ্রিম কোর্টসহ অধস্তন আদালতে স্ট্যাম্প, কার্টিজ পেপার, কোর্ট ফি ও ফলিওর জরুরি ভিত্তিতে সরবরাহ নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। ভুক্তভোগীরা মনে করছেন, স্বাভাবিকভাবে স্ট্যাম্প সঙ্কট হওয়ার কথা নয়। সৃষ্ট সঙ্কট হতে পারে কৃত্রিম। অতিরিক্ত মুনাফা হাতিয়ে নিতে স্ট্যাম্প সিন্ডিকেট কারসাজির মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে এই সঙ্কট সৃষ্টি করা হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, দেশজুড়ে কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্প সংকট দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে আশু ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। বর্তমানে ৩৪টি ক্ষেত্রে কোর্ট ফি ব্যবহৃত হচ্ছে। আর্থিক মামলা, ক্ষতিপূরণ, বাজারমূল্য আছে বা নেইÑ এ রকম স্থাবর সম্পত্তি, দখল-পুনরুদ্ধার, নিষেধাজ্ঞা, মুসলিম আইনের অধীনে অগ্রক্রয়, দলিল রদ, দলিল সংশোধন, চুক্তি রদ, ঘোষণা মামলা-পরবর্তী প্রতিকার, চুক্তি প্রবল, ইজমেন্ট অধিকার, বন্ধক খালাস, ফোরক্লোসার, মোহরানা, ভরণপোষণ, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার, বিবাহ বিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ব, সাধারণ ঘোষণা, বাটোয়ারা ও পৃথক দখল, ভাড়া, ডিক্রি রদ, ঘোষণা ও নিষেধাজ্ঞা, আপিল ও রিভিশনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়ের হওয়া মামলায় ব্যবহৃত হয় স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি। এ হিসেবে জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি (ডাক টিকিটের মতো) একটি অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ। একসময় সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের সব আদালত অঙ্গন জাল জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফিতে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল। আদালত অঙ্গন ও আইনজীবী সমিতিগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল জালিয়াত চক্র। এতে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছিল সরকার।

এ পরিস্থিতিতে জাল জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও নকল কোর্ট ফি ব্যবহার বন্ধে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন এক বিশেষ উদ্যোগ হাতে নেয়। গত বছর জাল স্ট্যাম্প ও নকল কোর্ট ফি শনাক্তকরণে সব আদালতে একযোগে ১ হাজার ২০০ ইইডি লাইট ডিটেক্টর সরবরাহ করা হয়। ওই সময় পুলিশের সহায়তায় অভিযান পরিচালনা করে জালিয়াত চক্রের অনেককে গ্রেফতার করা হয়। ফলে প্রায় বন্ধই হয়ে যায় জাল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফির ব্যবহার।

কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের প্রায় সব আদালতে জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি’র চরম সংকট দেখা দিয়েছে। সংকটের কথা জানিয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের কাছে একাধিক চিঠি এসেছে। স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি সংকটে দুর্ভোগে পড়েছেন বিচারপ্রার্থীরা। পরিস্থিতি নিরসনকল্পে জরুরি ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি সরবরাহ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার (বিচার) এস কে এম তোফায়েল হাসানের স্বাক্ষরে এ চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দফতরে এসেছে।

চিঠিতে বলা হয়, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে অন্যতম বিচার বিভাগ। সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ এবং দেশের ৬৪টি জেলার অধন্তন আদালতে প্রতি কার্যদিবসে বিচারপ্রার্থী জনগণের পক্ষে মামলা দায়েরসহ অন্যান্য দরখাস্ত দাখিলের ক্ষেত্রে জুডিশিয়াল ও নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি যুক্ত করতে হয়। আদালতে দাখিলকৃত স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি’র মাধ্যমে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পেয়ে থাকে। জুডিশিয়াল ও নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প জালিয়াতির কারণে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হতে বঞ্চিত হচ্ছিল। নকল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি শনাক্তকরণের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ ডাক বিভাগ, সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন বাংলাদেশ লিমিটেড (এসপিসিবিএল), ডিপার্টমেন্ট অব কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট ও পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্ট, বাংলাদেশ ব্যাংক এর সমন্বয়ে কিছু স্বল্পমেয়াদি ও কিছু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আইসিডি ইউভি এলইডি ফ্ল্যাশ লাইট (ইউভি-৩৬৫ এনএম) ডিভাইস ব্যবহার করে নকল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি শনাক্তকরণের নিমিত্ত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট অধস্তন আদালতের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা এবং জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি/সম্পাদকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং অধস্তন আদালতে আইসিডি ইউভি এলইডি ফ্ল্যাশ লাইট (ইউভি-৩৬৫ এনএম) ডিভাইস বিতরণ করে।

জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প সংকট নিরসনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো: গোলাম রব্বানী সাংবাদিকদের বলেন, জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি’র সংকটের বিষয়টি আমরা নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি মহোদয়কে অবহিত করেছি। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ সংশ্লিষ্টদের জরুরি ভিত্তিতে জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি সরবরাহ করতে বলেছেন। আমরা প্রধান বিচারপতির নির্দেশনার কথা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও আইন মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। আশা করছি দ্রুতই এ সংকট কেটে যাবে।

এদিকে জুডিশিয়াল, নন-জুডিশিয়াল এবং কোর্ট ফি’কে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে চলছে একপ্রকার নৈরাজ্য। কোর্ট ফি কে মুদ্রণ করছে, কে সরবরাহ করছে, কে বিপণন করছে, কিভাবে নিয়ন্ত্রণ ও রাজস্ব আদায় চলছেÑ এ বিষয়ে নেই সুস্পষ্ট বিধিবিধান। ফলে সকল প্রকার স্ট্যাম্প জালিয়াতি বন্ধ কিংবা ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি। মাঝে মধ্যে জাল স্ট্যাম্প সরবরাহকারী আটক হওয়ার খবর প্রচারিত হলেও গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তির কথা জানা যায় না। বিশ্লেষকদের মধ্যে এই জালিয়াতি ও স্ট্যাম্প নৈরাজ্যের পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। প্রধান কারণটি হচ্ছে আইনগত।

আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, স্ট্যাম্পের ব্যবহার ব্যাপক বিস্তৃত হলেও শত বছরের পুরনো আইনে চলছে স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি’র মুদ্রণ, বিপণন ও নিয়ন্ত্রণ। এটির মূল্যও নির্ধারিত হচ্ছে ১৮৯৯ সালের ‘স্ট্যাম্প আইন’ অনুসারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ’ বছর বছর স্ট্যাম্পের পরিমাণ পরিবর্তন করে। চর্চিত প্রথা অনুযায়ী স্ট্যাম্পের মালিক সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। অথচ অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই বিভাগ কোনো স্ট্যাম্প বা কোর্ট ফি মুদ্রণ করে না। বিপণনের সঙ্গেও তারা জড়িত নয়। এ সংক্রান্ত কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ কিংবা এনবিআর কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের চাহিদাক্রমে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ সকল প্রকার স্ট্যাম্প মুদ্রণ করছে। তবে ডাক বিভাগের নিজস্ব ছাপাখানা থাকলেও স্ট্যাম্প ছাপাচ্ছে সরকারেরই আরেক প্রতিষ্ঠান ‘সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস’ থেকে। মুদ্রণের পর স্ট্যাম্পগুলো ডাক বিভাগের হেফাজতেই থাকে। অথচ এখানে রয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সংকট। ডাক বিভাগের কাছ থেকে জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি (এনডিসি) চাহিদা অনুযায়ী ডাক বিভাগ থেকে স্ট্যাম্পগুলো গ্রহণ করে। নিয়ে রাখে ডিসি অফিসের ‘ট্রেজারি’তে। এখানেও রয়েছে নিরাপত্তার অভাব। স্ট্যাম্প ভেন্ডারগণ খুচরা বিক্রির জন্য ব্যাংকে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে টাকা জমা দিয়ে স্ট্যাম্প কিনে নেন। লাইসেন্সধারী ভেন্ডারগণ এখানে নির্ধারিত হারে কমিশন লাভ করেন। বাস্তবতা হচ্ছে, স্ট্যাম্প ব্যবহারকারীরা স্ট্যাম্প কিনছেন স্ট্যাম্পে উল্লেখিত মূল্যমানের চেয়ে বেশি দামে। এ অর্থ কার পকেটে যায়? কারো কাছে হিসাব নেই এর। দ্বিতীয়ত, মুদ্রণ, সংরক্ষণ, পরিবহন, বিপণন এবং খুচরা বিক্রেতাদের একটি ‘চেইন’ রয়েছে। বিদ্যমান এই ‘চেইন’-এর নির্দিষ্ট কোনো নিয়ন্ত্রক কিংবা জবাবদিহিতার কর্তৃপক্ষ নেই। ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে বিশাল ফাঁক-ফোকর। জমি হাতবদল, ফ্ল্যাট হস্তান্তর, নানা দাফতরিক কাজে প্রয়োজন হয় স্ট্যাম্পের। গুরুত্বপূর্ণ এ উপকরণ মুদ্রণ, কেনাবেচায় কার্যকর কোনো তদারকি নেই। তাৎক্ষণিকভাবে চেনার সুবিধার্থে জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে কিছু নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তবে সূক্ষ্মভাবে পরখ না করলে খালি চোখে সেটি ধরার উপায় নেই। নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে বিশেষ নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যও থাকে না। এ ক্ষেত্রে আসল-নকল স্ট্যাম্পের পার্থক্য করা দুরূহ। জাল স্ট্যাম্পবিরোধী অভিযানে যুক্তরা জানিয়েছেন, মুদ্রণ, সংরক্ষণ, পরিবহন, বিতরণ এবং খুচরা বিক্রির সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া জাল স্ট্যাম্পের ব্যাপক ব্যবহার সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, আইনে স্ট্যাম্প সংক্রান্ত স্বতন্ত্র কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। এই সুযোগে জাল বা নকল স্ট্যাম্প ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। কখনোবা মুদ্রণ থেকে ব্যবহারকারীর হাত পর্যন্ত পৌঁছানের ক্ষেত্রে যে চেইন রয়েছে সেটির যেকোনো পর্যায়ে রয়েছে কারসাজির সুযোগ। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অধিক অর্থ লুটে নেয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমান যে সংকট সেটি সিন্ডিকেটেরই সৃষ্ট সঙ্কট বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

https://dailyinqilab.com/national/article/603585