১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ২:১৫

নিত্যপণ্য সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে

নিত্যপণ্যের বাজার কার্যত সি-িকেটের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। নানামুখি উদ্যোগ, পদক্ষেপ গ্রহণ করেও সিন্ডিকেট ভেঙ্গে ফেলা যাচ্ছে না। বাণিজ্যমন্ত্রী জাতীয় সংসদে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করার পর সিন্ডিকেটের ব্যাপক দৌরাত্ম্যে ও অরাজকতা ঠেকাতে ডিম, তেল, আলু ও পেঁয়াজের দাম বেঁধে দেয়া হয়। বাণিজ্যমন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত দর আড়তদার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী কেউই মানছেন না। পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে যে যার মতো বিক্রি করছেন। বাজার নিয়ন্ত্রণে গতকালও ৪ কোটি পিছ ডিম ভারত থেকে আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী ও সরকারের বেঁধে দেয়া দামে পেঁয়াজ, আলুসহ অন্য পণ্য না পাওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন ক্রেতারা। চার দিনেও দর কার্যকর না হওয়ায় খুচরা ব্যবসায়ীরা দুষছেন, পাইকার ও আড়তদারদের। তাদের অভিযোগ, মানুষ বেশি খবর নিচ্ছে খুচরা দোকানে। পাইকারি পর্যায়ে না কমলে আমরা কীভাবে কম রাখব? অন্যদিকে, বাজারে গিয়ে হতাশ ক্রেতারা বলছেন, সরকার দর ঠিক করে হাঁফ ছেড়েছে। বাজারে কী হচ্ছে, সেদিকে খেয়াল নেই। এদিকে সিন্ডিকেট ভাঙতে অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানো শুরু করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। তবে মূল যে সিন্ডিকেট- যাদের মোবাইল বার্তায় মুহূর্তে বেড়ে যায় পণ্যের দাম- তাদের লাগাম টানতে পারেনি এসব অভিযান। তাদের সম্পর্কে অন্ধকারে রয়েছে অভিযানকারীরা। অবশ্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান বলেছেন, বাজারের এই সিন্ডিকেট ভাঙার এখতিয়ার ভোক্তা অধিদফতরের নেই, ভোক্তা আইনেও এটা কাভার করে না।

সম্প্রতি শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার বাজারে গিয়ে পণ্য কিনতে না পেরে সীমিত আয়ের মানুষকে কাঁদতে দেখেছেন; বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সরকারকে বিপদে পড়বেন, এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। ডিম, তেল, আলু ও পেঁয়াজের দাম বেঁধে দিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, এসব পণ্যের দাম কঠোরভাবে মনিটরিং করছে সরকার। বাস্তবে বেঁধে দেয়া দামে পণ্য বিক্রির সিদ্ধান্ত মানছেনা কেউ। এদিকে কয়েক মাস অগেই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দ্বারা বাজারের আরো একাধিক পণ্যের দাম বৃদ্ধির ভয়ংকর পরিস্থিতি আসছে বলে সতর্ক করেছিল একটি গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের মতে, খুব শিগগিরই দাম বাড়তে পারে নিত্য পণ্য আলু, ডিম,আটা-ময়দা, ডালসহ একাধিক পণ্যের। সিন্ডিকেট কয়েক দিনের জন্য হঠাৎ করে বাজার অস্থিতিশীল করে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ফান্ডকে সমৃদ্ধ করবেন বলে জানিয়েছে। একই সঙ্গে আমদানির কথা বলে বাজার কিছুটা স্বাভাবিক করে সিন্ডিকেট তাদের স্বার্থ হাসিল করে বাজার থেকে অর্থ হাতিয়ে নিবে। ইতোমধ্যে আলু ও ডিমের বাজারকে সিন্ডিকেট প্রভাবিত করে স্বার্থ হাসিল করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই সিন্ডিকেটের নাটের গুরু কারা? সিন্ডিকেটের হাত সরকারের হাতের চেয়েও কি লম্বা? ভুক্তোভোগীদের প্রশ্ন মাঝে মাঝে সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে শত শত কোটি টাকা লোপাট করা হচ্ছে সে টাকা কোথায় যায়?

জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, বিশ্ব বাজারের কারণে যদি কোনো পণ্যের দাম বাড়ে ১০ শতাংশ, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে বাংলাদেশে সে পণ্যের দাম বাড়ে ৮০-৯০ শতাংশ। প্রতিটা পণ্যেই রয়েছে বাজার সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে দেশের মানুষের পকেট ফাঁকা করছে, অথচ কোনো প্রতিকার মিলছে না। এই বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বা সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সিন্ডিকেট ভাঙতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিয়ে তারাই আবার একেক সময় এমন এমন কথা বলেন, যাতে ব্যবসায়ীদের সাহস আরও বেড়ে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল হোতাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সরকারের বেঁধে দেয়া দামে কখনোই পণ্য বিক্রি হবে না। তারা মোবাইলে বার্তা পাঠালেই সারা দেশে একযোগে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। তাদেরকেই প্রথম শাস্তির আওতায় আনতে হবে। নইলে ক্রেতারা আরও জিম্মি হয়ে পড়বে। গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৪টি পণ্যের দাম বেধে দেয়। এরপর থেকে গতকাল পর্যন্ত- এই ৪ দিন বাজার ঘুরে দেখা গেছে- বেধে দেয়া দামে কোনো পণ্যই মিলছে না। বিক্রি হচ্ছে আগের দামেই।

প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে দাম নির্ধারণ করে লাভ কী? জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান বলেন, বাজারদর প্রত্যাশিত পর্যায়ে আনতে আমরা সারা দেশে অভিযান চালাচ্ছি। আমাদের যা যা করা দরকার, তা করব। ভোজ্যতেল ও চিনির দাম আগে নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা কেন কার্যকর হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি এখন কথা বলতে চান না। নতুন পণ্যের ঘোষিত দর কার্যকর করতে চান।

বিভিন্ন বাজারে দেখা গেছে, ভোক্তা অধিদফতর অভিযান চালাতে বাজারে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সাবধান হয়ে যাচ্ছেন বিক্রেতারা। তারা দোকান বন্ধ করে পালাচ্ছেন। অভিযানকারীরা চলে গেলে ফের বিক্রি শুরু হয় অতিরিক্ত দামে। এসব দোকানদারদের অভিযোগ, তারা যাদের কাছ থেকে পণ্য কিনেন- সেই পাইকার এবং আমদানিকারকদের কাছ থেকে পন্য কিনতে হয় সরকারি দামের অতিরিক্ত দামে।

এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, আমরা এ বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে মাঠে নেমেছি। অভিযান চলছে। সরকার নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রি না করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নতুন নির্ধারণ করা দাম অনুযায়ী, প্রতি পিস ডিম ১২ টাকা, পেঁয়াজ কেজি প্রতি ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, আলু ৩৫ টাকা এবং সয়াবিন তেল লিটার প্রতি ১৬৯ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা থাকলেও, আগের বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে এসব পণ্য।

বাড়তি দামে নাভিশ্বাস ক্রেতার। তারা মনে করছেন, খুচরা বাজারে নয়, কারসাজি হচ্ছে পাইকারি বাজারে। এক ক্রেতা বলেন, পাইকারিতে ডিমের দাম ১২ টাকা। সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও বাজারে সেটি কেউ মানছে না। গত বৃহষ্পতিবার খুচরা বাজারে প্রতিটি ডিমের দাম ১২ টাকা, আলুর দাম প্রতি কেজি ৩৫ টাকা থেকে ৩৬ টাকা এবং পেঁয়াজের দাম ৬৪ টাকা থেকে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঘোষণার পর থেকেই বাজারে নতুন দর কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাজারের চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। এই তিন পণ্য বিক্রি হচ্ছে আগের বাড়তি দামেই।

রাজধানীর হাতিরপুল কাঁচাবাজারে গতকাল বিকেলে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী শামসুদ্দিন বলেন, আলু ৫০ টাকার কমে কেউ বিক্রি করছেন না। পেঁয়াজ কিনেছি ৮৫ টাকা কেজি। দাম কমানোর এ ঘোষণার মানে কী?

গতকাল রাজধানীর হাতিরপুল, নাখালপাড়া, তেজকুনিপাড়াসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আগের মতোই আলু ৫০-৫৫ ও দেশি পেঁয়াজ ৭৫-৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ডিমের হালি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকার আশপাশে। তবে কারওয়ানবাজারে পেঁয়াজে ৫ ও আলুর কেজি ২ টাকা কম দেখা গেছে।

ডিম ব্যবসায়ী আবদুর রহমানের দাবি, তেজগাঁওয়ের আড়তেই পাইকারি পর্যায়ে প্রতি পিস ডিমের দাম রাখছে ১২ টাকা। পরিবহন খরচ যোগ করে মুনাফা তুলতে হলে ১৩ টাকার নিচে বিক্রি করা সম্ভব নয়।

তেজকুনিপাড়া এলাকার চাঁদপুর স্টোরের বিক্রয় কর্মী সুমন হোসেন বলেন, মহল্লায় বেচাবিক্রি কম। বাজারে দাম না কমলে তো মহল্লার খুচরা বিক্রেতারা লোকসান দিয়ে বিক্রি করবে না। মানুষ বেশি দামে কিনে আমাদের কাছে খেদোক্তি করে চলে যান। এ বাজারের আলু ও পেঁয়াজ ব্যবসায়ী আবুল হোসেন বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে আড়তে দাম কমাতে হবে। পাইকাররা রাতে আড়তে আলু ও পেঁয়াজ বিক্রি করে বাসায় চলে যান। সরকারি সংস্থা অভিযানে আসে দিনে। ছোট ব্যবসায়ীদের জরিমানা করে দায় সারে।

এছাড়া একই দিন সয়াবিন তেল ও পাম তেলের দামও কমানোর ঘোষণা দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। পরে সেদিন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ভোজ্যতেলের দাম কমানোর ঘোষণা দেয়। এতে বলা হয়েছে, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্য কমায় দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমানো হয়েছে। ফলে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৫ টাকা কমিয়ে ১৬৯ টাকা এবং ৫ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৮২৫ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া প্রতি লিটার খোলা পাম তেলের দাম ৪ টাকা কমিয়ে ১২৪ টাকা করা হয়েছে। এর আগে চিনির দামও নির্ধারণ করে দেয় সরকার।

বাজার স্থিতিশীল রাখতে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেশীয় পেঁয়াজ, আলু ও ডিমের দাম বেধে দিয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সেই নির্ধারীত দামে দিনাজপুরের হিলিতেও মিলছে না দেশীয় পেঁয়াজ ও আলু। এখনো বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে এই দুটি পণ্য। হিলি বাজারের পেঁয়াজ বিক্রেতা সিদ্দিক হোসেন বলেন, সরকার দেশীয় পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা কেজি। কিন্তু আমরা তো সেই দামে পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারছি না। বর্তমানে আমাদের দোকানে যেসব পেঁয়াজ রয়েছে তা ৭৫ টাকা কেজি দরে ক্রয় করা। আর আমরা প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করছি ৮০ টাকা কেজি দরে। সরকারের সেই বেঁধে দেয়া দামে আমরা তো কিনতে পারিনি তাহলে আমরা বিক্রি করব কিভাবে। আমাদের এসব পেঁয়াজ বাড়তি দামে ক্রয় করা যার কারণে বাড়তি দামেই বিক্রি করতে হবে। সরকার নির্ধানিত দামে যদি মোকামে পেঁয়াজ কিনতে পারি তাহলে আমরাও সেই দামে বিক্রি করতে পারব।

দাম কেন কার্যকর হয় না : বড় কোম্পানি, বাজার বিশ্লেষক, পাইকারি বিক্রেতা ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে নির্ধারিত দর কার্যকর না হওয়ার চারটি কারণ জানা যায়Ñ১. বড় কোম্পানি, উৎপাদক অথবা আমদানি পর্যায়ে দর কার্যকর করতে না পারা। ২. পাইকারি বাজার ও খুচরা পর্যায়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি না থাকা। দেখা গেছে, যতক্ষণ বাজারে অভিযান চলে, ততক্ষণ দাম কম থাকে। ৩. চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য না থাকা। সরবরাহÑসঙ্কট থাকলে কোনোভাবেই নির্ধারিত দর কার্যকর করা সম্ভব নয়। ৪. বেড়ে যাওয়ার পর দর নির্ধারণে লাভ হয় না।

এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েন অব বাংলাদেশ-ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নইলে বাজার আরওসামঞ্জস্যহীন হয়ে পড়বে।##

https://dailyinqilab.com/national/article/603592