১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ২:১০

সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর বড় আঘাত

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি বাড়ছে। বিদেশ থেকে দেশে ফেরত আসার প্রবণতাও কমেছে। ফলে বিদেশে কর্মরত প্রবাসীর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু এরপরও কমে যাচ্ছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। রেমিট্যান্স প্রবাহ নিম্নমুখী হওয়ায় ব্যাংকগুলোয় কমে গেছে ডলারের সরবরাহ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যোগ হচ্ছে না ডলার। উলটো রিজার্ভের ক্ষয় বাড়ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রভাবে বেড়ে যাচ্ছে ডলারের দাম। ব্যাংক ও খোলাবাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে নগদ ডলার। আমদানির জন্য চাহিদার অর্ধেক ডলারও মিলছে না, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের আঘাত হেনেছে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে না পারলে অর্থনীতিতে বিদ্যমান সংকট আরও ঘনীভূত হবে বলে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, আমদানি কমিয়ে সংকটের সমাধান করা যাবে না। এতে সমস্যা আরও বাড়বে। সংকট সমাধানের একমাত্র পথ রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ানো। এর কোনো বিকল্প নেই। এজন্য হুন্ডি বন্ধ করতে হবে। রপ্তানি আয় যথাসময়ে দেশে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, করোনার সময় হুহু করে রেমিট্যান্স বেড়েছিল। ওই সময়ে রিজার্ভও বেড়েছিল। দুই বছর ধরে রেমিট্যান্স কমছে। রিজার্ভও কমছে। রপ্তানি থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়, এর পুরোটা দিয়েও আমদানি ব্যয় মেটানো যায় না। ৪০ শতাংশ আমদানি ব্যয় মেটাতে হয় রেমিট্যান্স থেকে। ২০ শতাংশ ব্যয় অন্যান্য খাতে। বাকি ৪০ শতাংশ রিজার্ভে যোগ হতো। আমদানি বাড়লে যোগ হওয়ার পরিমাণ কমে। এখন আমদানি কমলেও রেমিট্যান্স কমে গেছে। যে কারণে এখান থেকে ডলার রিজার্ভে যোগ হচ্ছে না। তিনি মনে করেন, বিদ্যমান সংকট মোকাবিলা করতে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বাড়াতে হবে। এখন রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব নয়। ফলে রেমিট্যান্স বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে দেশ থেকে বিদেশ গেছেন ৬ লাখ ১৫ হাজার কর্মী। চলতি বছরের একই সময়ে গেছেন ৬ লাখ ১৮ হাজার কর্মী। ওই সময়ে বিদেশে যাওয়া কর্মী বেড়েছে ৩ হাজার বা ৫ শতাংশ। গত বছর গেছেন ১১ লাখ ৩৬ হাজার জন। সব মিলে এখন পর্যন্ত বিদেশে কর্মরত প্রবাসীর সংখ্যা গত জুন পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৪৯ লাখ। গত বছরের একই সময়ে তা ছিল ১ কোটি ৩১ লাখ। আলোচ্য সময়ে প্রবাসী বেড়েছেন সাড়ে ১৭ লাখ। করোনার সময় ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রায় ২ লাখ কর্মী বিদেশ থেকে ফেরত এসেছিলেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই ফিরে গেছেন। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর প্রতারণার কারণে কাজ না পেয়ে বা আইনি বেড়াজালে পড়ে এখন মাসে ১০০ থেকে ১৫০ জন ফেরত আসছেন। দেশ থেকে বিদেশে যাওয়া নতুন কর্মী এবং মোট প্রবাসীর সংখ্যা বাড়লেও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমেছিল ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। ওই কমার পর গত অর্থবছর বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। গত জুলাই আগস্টে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে ১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর মধ্যে কেবল আগস্টে কমেছে সাড়ে ২১ শতাংশ। অথচ গত বছরের জুলাই-আগেস্ট রেমিট্যান্স বেড়েছিল ১২ দশমিক ২৭ শতাংশ। কেবল আগস্টে বেড়েছিল ১২ দশমিক ৫৩ শতাংশ। রেমিট্যান্স কমায় রিজার্ভ বাড়ছে না। ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। বাড়ছে মূল্যস্ফীতির হার, যা পুরো অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

সূত্র জানায়, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের বড় একটি অংশ হুন্ডির কবলে পড়েছে। এতে রেমিট্যান্স কমছে। যেসব দেশে হুন্ডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, ওইখানে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। অন্যসব দেশ থেকে কমছে। দেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে ১০টি দেশ থেকে। এর মধ্যে প্রধান ছয়টি দেশ থেকে রেমিট্যান্স কমছে। রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রথম সারির একটি এবং দ্বিতীয় সারির তিনটি দেশ থেকে বেড়েছে। এ কারণে সার্বিকভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে হুন্ডির কারণে রেমিট্যান্স কমে যায়। এটি বন্ধ করতে গত বছর সরকারের একটি প্রতিনিধিদল দেশটিতে গিয়ে এর কারণ অনুসন্ধান করে। এর ভিত্তিতে ওই দেশের সঙ্গে আলোচনা করে হুন্ডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ফলে আমিরাত থেকে এখন রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে। গত বছরের জুলাইয়ে আমিরাত থেকে ৩১ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। গত জুলাইয়ে তা সাড়ে ৬ শতাংশ বেড়ে ৩৩ কোটি ডলার এসেছে। রেমিট্যান্স পাঠানোর শীর্ষ দেশ থেকে আমিরাত নেমে গিয়েছিল তৃতীয় অবস্থানে। এখন আবার দেশটি দ্বিতীয় অবস্থানে চলে এসেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৪৪ কোটি ডলার। হুন্ডির কারণে ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ১৫ দশমিক ১৬ শতাংশ কমে ২০৭ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। হুন্ডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় গত অর্থবছর দেশটি থেকে রেমিট্যান্স ৪৭ শতাংশ বেড়ে ৩০৩ কোটি ডলারের বেশি এসেছে। গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশটিতে নতুন কর্মী গেছেন ৪২ হাজার ৬২৩ জন। মোট রেমিট্যান্সের ৫২ শতাংশই আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। ইউরোপের দেশগুলো থেকে ১৬, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে ৮, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৬ এবং অন্যান্য দেশ থেকে আসে ৮ শতাংশ। দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব থেকে ১৮, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১৫, যুক্তরাজ্য থেকে ১১, কাতার থেকে সাড়ে ৬, কুয়েত থেকে সাড়ে ৬, মালয়েশিয়া থেকে সাড়ে ৫ এবং ওমান থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ রেমিট্যান্স আসে।

সৌদি আরব থেকে গত বছরের জুলাইয়ে ৩৫ কোটি ডলার এসেছিল। গত জুলাইয়ে এসেছে ৩১ কোটি ডলার। কমেছে ৪ কোটি ডলার। অথচ গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ২ লাখ ২৬ হাজার কর্মী গেছেন সৌদি আরব, যা মোট জনশক্তি রপ্তানির ৩৫ শতাংশ। এরপরও দেশটি থেকে রেমিট্যান্স ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশটি থেকে এসেছিল ৫৭২ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে কমে এসেছে ৪৫৪ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে আরও কমে এসেছে ৩৭৭ কোটি ডলার। দেশটি থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসছে এখন।

ওমান থেকে গত বছরের জুলাইয়ে এসেছিল ৮ কোটি ডলার, এবার এসেছে ১২ কোটি, বেড়েছে ৪ কোটি ডলার।
কাতার থেকে গত বছরের ওই সময়ে এসেছে সাড়ে ১০ কোটি ডলার, গত জুলাইয়ে ১১ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। বেড়েছে ৫০ লাখ ডলার। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশটিতে কর্মী গেছেন ১৪ হাজার ৩৯৫ জন। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশটি থেকে এসেছিল ২৭৬ কোটি ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে কমে এসেছে ১৩৫ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে তা বেড়ে এসেছে ১৪৫ কোটি ডলার।

গত বছরের জুলাইয়ে কুয়েত থেকে এসেছে ১৪ কোটি ডলার, জুলাইয়ে এবার এসেছে ১২ কোটি ডলার। কমেছে ২ কোটি ডলার। দেশটিতে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত কর্মী গেছেন ১৬ হাজার। দেশটি থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে এসেছিল ১৮৯ কোটি ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে কমে এসেছে ১৬৯ কোটি ডলার এবং গত অর্থবছরে আরও কমে এসেছে ১৫৬ কোটি ডলার।

বাহরাইন থেকে গত বছরের জুলাইয়ে এসেছে সাড়ে ৪ কোটি ডলার, এবার এসেছে ৫ কোটি। বেড়েছে ১ কোটি ডলার। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত নতুন কর্মী গেছেন ১২ হাজার।

২০২২ সালের জুলাই থেকে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি বাড়তে থাকে। এর আগে তা খুবই কম ছিল। ওই বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত গেছেন মাত্র ৮৮ জন। ওই বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ হাজার জনে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মালয়েশিয়া গেছেন ১ লাখ ৭৮ হাজার কর্মী। এরপরও দেশটি থেকে রেমিট্যান্স বাড়ছে না। বরং কমছে। মালয়েশিয়া থেকে গত বছরের জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৪ কোটি ডলার। চলতি বছরের একই মাসে এসেছে ১২ কোটি ডলার। কমেছে ২ কোটি ডলার।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে গত জুলাইয়ে এসেছে ৩৭ কোটি ডলার, এবার এসেছে ২০ কোটি। কমেছে ১৭ কোটি ডলার। দেশটি থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে এসেছিল ৩৪৬ কোটি, ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে এসেছে ৩৪৪ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে সামান্য বেড়ে এসেছে ৩৫২ কোটি ডলার। রেমিট্যান্স আহরণে দেশটি শীর্ষ অবস্থানে ওঠলেও এখন নেমে গেছে তৃতীয় অবস্থানে।

ইউরোপ থেকে রেমিট্যান্স বাড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এসেছিল ২৯০ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে এসেছে ৩১৮ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে এসেছে ৩৩৮ কোটি ডলার। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য থেকে গত জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছে ২০ কোটি ডলার, এবার ২২ কোটি, বেড়েছে ২ কোটি ডলার। ইতালি থেকে গত বছরের জুলাইয়ে এসেছে ১৩ কোটি, এবার এসেছে ১১ কোটি ডলার। কমেছে ২ কোটি ডলার।

অন্যান্য দেশ থেকে আলোচ্য সময়ে রেমিট্যান্স ২৪ কোটি থেকে বেড়ে ২৯ কোটি ডলার এসেছে। বেড়েছে ৫ কোটি ডলার। হন্ডির কারণে ওইসব দেশ থেকে রেমিট্যান্স আসছে না। ওইসব দেশে হুন্ডিবাজরা প্রকাশ্যে সাইনবোর্ড টানিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে তা দেশে তাদের এজেন্টের মাধ্যমে টাকায় পাঠিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু দেশে আসছে না বৈদেশিক মুদ্রা। ব্যাংকে প্রবাসীরা প্রতি ডলারের পাচ্ছেন ১১২ টাকা ২৪ পয়সা। হুন্ডিতে পাচ্ছেন ১১৮-১১৯ টাকা। তবে হুন্ডিতে ঝুঁকি বেশি।

চলতি বছরের মার্চ ও জুনে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। মার্চে ২০২ কোটি এবং জুনে ২২০ কোটি ডলার। বাকি সব মাসেই ২০০ কোটি ডলারের কম এসেছে। গত আগস্টে এসেছে সবচেয়ে কম ১৬০ কোটি ডলার।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আহরণ করে ভারত ১১ হাজার ১২০ কোটি ডলার। দ্বিতীয় পাকিস্তান ৩ হাজার কোটি, তৃতীয় বাংলাদেশ ২ হাজার ১৫০ কোটি ডলার। এরপর রয়েছে নেপাল ৯৩০ কোটি, শ্রীলংকা ৩৮০ কোটি এবং ভুটান ১০ কোটি ডলার।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/719540