১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ১:১৭

বিচারপতিদের সাম্প্রতিক কিছু মন্তব্য ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের গরমিল

ড. মো. নূরুল আমিন

গত ১৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান আক্ষেপ করে বলেছেন যে, দুর্নীতি বাংলাদেশের সর্বত্র ক্যান্সারের মতো কাজ করছে। তিনি বলেছেন, বিচার বিভাগও দুর্নীতিমুক্ত নয় এবং এ প্রেক্ষিতে এ বিভাগের ওপর মানুষের আস্থার সংকটেরও সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তথাপি মানুষ ন্যায়বিচারের আশায় আদালতের দ্বারস্থ হয়। তিনি দেশবাসীকে আশ^াস দিয়ে বলেছেন যে, ধীরে ধীরে আমাদের কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে আমরা মানুষের আস্থাটা আরো বাড়াতে চেষ্টা করব।

অন্যদিকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন সাবেক বিচারপতি, বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশের আইন-আদালত ও বিচার ব্যবস্থার সাম্প্রতিক অবস্থা প্রসঙ্গে এক হতাশাব্যঞ্জক চিত্র তুলে ধরে বলেছেন যে, বর্তমানে আমাদের দেশের আদালতগুলোর মূল কাঠামো ধসে পড়েছে। বিচারকদের ঐশ^রিক আত্মা অভিহিত করে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন যে, এই ঐশ^রিক আত্মার ওপর মানুষের আস্থা এখন নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। আদালত ও বিচারকের ওপর মানুষের আস্থা না থাকলে তার কাঠামো টিকে থাকতে পারে না, তা ধসে পড়ে।

কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলেছেন যে, আমাদের দেশে এখন অদৃশ্য ইঙ্গিতে আদালতের রায় দেয়া হয়। তার ভাষায় একজন বয়স্কা সম্মানিত মহিলাকে নি¤œ আদালত ৫ বছরের সাজা দিয়েছিল, কিন্তু উচ্চ আদালত তার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেদিল। তাকে জামিনও দেয়া যাবে না। অথচ খুনের মামলার আসামি জামিন পায় এবং মৃত্যুদ- প্রাপ্ত আসামিও খালাস পায়। তিনি কঠোরভাবে বিনা বিচারে আটকের সমালোচনা করেন এবং বলেন যে, দুর্নীতির মামলার বিচার হতে ১৫/২০ বছর লাগে। এর মধ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তি আরো দুর্নীতি করে টাকা নিয়ে বিদেশে পালায়। তিনি কেয়ারটেকার সরকার তথা ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে প্রদত্ত রায়কে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের প্রথম ধস হিসেবে অভিহিত করেন। এই মামলার তৎকালীন প্রধান বিচারপতি তার প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত রায় থেকে পূর্ণাঙ্গ রায়ে সম্পূর্ণ সরে এসে দেশে বিরাট সংকটের সৃষ্টি করেছিলেন। এখন এই রায় প্রসঙ্গে আসি।

পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, ২০১২ সালে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছিল। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সম্বলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে প্রদত্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিলেট ডিভিশনের সংক্ষিপ্ত রায়ের ১৬ মাস পর সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক পূর্ণাঙ্গ রায় স্বাক্ষর করে জমা দিয়েছেন এবং রায়টি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত রায়ে দেখা গেছে যে, সংক্ষিপ্ত রায়ের সাথে বেশ কিছু ক্ষেত্রে এর কোন মিল নেই। উল্লেখ্য যে, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে গঠিত সাত সদস্যের শক্তিশালী আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চের তরফ থেকে ২০১০ সালের ১১ মে তারিখে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা হয়। এই বাতিলের পক্ষে তিনজন বিচারক এবং বিপক্ষে তিনজন বিচারক অবস্থান নিয়েছিলেন। এই অবস্থায় সভাপতিত্বকারী প্রধান বিচারক তার কাস্টিং ভোট দিয়ে বাতিলের রায়কে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রদান করেন এবং এর ফলে ত্রয়োদশ সংশোধনীতে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষে নির্দলীয় নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে ঐ সরকার কর্তৃক নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান করে সংবিধানের যে সংশোধনী জারি করা হয়েছিল তা বাতিল ঘোষণা করা হয়। সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়েছিল যে, সংসদের দশম ও একাদশ নির্বাচন বেআইনী ঘোষিত ত্রয়োদশ সংশোধনীতে বর্ণিত কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে হতে পারে। এক্ষেত্রে যে নীতিটার কথা বলা হচ্ছে সেটা হচ্ছে-‘That which otherwise is not lawful, necessity makes lawful and that the safety of the people and the state is the supreme law.’ সংক্ষিপ্ত এই রায়ে আরো বলা হয়েছিল যে, সাবেক প্রধান বিচারপতি অথবা আপিলেট ডিভিশনের একজন বিচারপতিকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার যে বিধানটি ত্রয়োদশ সংশোধনীতে ছিল তা বাদ দিয়ে সংসদ এক্ষেত্রে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে পারেন। কিন্তু সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক কর্তৃক স্বাক্ষরিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে সংক্ষিপ্ত রায়ের এই অংশটি হুবহু নেই এবং তা বদলিয়ে দেয়া হয়েছে। বদলানোর পর তা শুধু পর্যবেক্ষণ নয় একটি নির্দেশনায়ও পরিণত হয়েছে এবং এতে বলা হয়েছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনগণের প্রতিনিধি এমপিদের নিয়েই শুধু গঠন করা যাবে। রায়ে আরো বলা হয়েছে যে, ঐ সময়ের মন্ত্রিসভা হবে একটি ক্ষুদ্র আকারের মন্ত্রিসভা। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হবার পর সংক্ষিপ্ত রায় যারা পত্রপত্রিকায় পড়েছেন এবং আদালতে শুনেছেন তারা নিজেদের চোখ এবং কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। দেশের খ্যাতনামা আইনজীবী এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হবার পর তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন যে, সংক্ষিপ্ত রায়ে কেয়ারটেকার সরকারের যে গঠন প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছিল তাতে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্দলীয় ব্যক্তিদের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ ছিল। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা বদলে দেয়ায় এই সুযোগ আর থাকলো না। এতে রাজনৈতিক সংকট আরো ঘনীভূত হলো। এখানে আরো একটি বিষয়ও লক্ষণীয়। বিচারপতি খায়রুল হক তার রায়ে বলেছেন যে, ১৯৯৬ সালের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর আইন সংবিধানে বিধৃত রাষ্ট্রীয় মূলনীতি এবং মৌলিক কাঠামোকে নষ্ট করে দেয়ার কারণে বিতর্কিত আইনটি অসাংবিধানিক, বে আইনী এবং অকার্যকর বলে গণ্য হয়েছে। রায়ে তিনি আরো বলেছেন যে, সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি সংসদের কর্তৃত্বাধীন। পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্বাচনের একটি যুক্তিসঙ্গত সময়ের আগে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া যেতে পারে এবং এই সময়টি ৪২ দিন হতে পারে। তার রায় অনুযায়ী নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা নতুন মন্ত্রিসভা গঠন না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনায় স্বভাবিক এবং সাধারণ কার্যাবলী সম্পাদন করবে। রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যদিও ১৯৯৬ সালের সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধনী) আইনটি অসাংবিধানিক এবং বেআইনী তথাপি পার্লামেন্ট তার বিশেষ ক্ষমতা ও সিদ্ধান্তক্রমে দশম ও একাদশ পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন আকার ও আকৃতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে পারবে। রায়ে তিনি আরো বলেছেন যে, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত সকল ব্যক্তি এবং প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকবে। এতে বিদ্যমান সংবিধানের ৫৬(২) নং অনুচ্ছেদটির পরিবর্তে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৫৬ (৪) নং অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে। এটা করা হলে বর্তমানে এক-দশমাংশ মন্ত্রী টেকনোক্র্যাটদের মধ্য থেকে নেয়ার যে বিধান রয়েছে তা রহিত হয়ে যাবে। যা হোক সংক্ষিপ্ত রায় ও পূর্ণাঙ্গ রায়ের পার্থক্য বেশ কিছু বিতর্কের জন্ম দিয়েছে যা সম্পূর্ণভাবে অনভিপ্রেত। আইন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ এই গরমিলকে বিচার বিভাগীয় অসদাচরণ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন যে, শুধু বাংলাদেশ নয় দুনিয়ার ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা বিরল।

সংক্ষিপ্ত রায়ের পরিবর্তন ছাড়াও এখানে আরো কয়েকটি প্রশ্ন উঠেছে। প্রথমত সংক্ষিপ্ত রায়ের ১৬ মাস পর পূর্ণাঙ্গ রায় দেয়া যায় কিনা? আদালতে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণার অব্যবহিত পরে অবসরে গিয়ে ১৬ মাস পর পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করা যায় কিনা? দ্বিতীয়ত পূর্ণাঙ্গ রায় স্বাক্ষরের পূর্বে এই রায়ের বরাত দিয়ে সরকার সংবিধান সংশোধনের ন্যায় বড় রকমের কোনও পদক্ষেপ নিতে পারেন কিনা? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, কানাডা, ভারত, পাকিস্তানসহ গণতান্ত্রিক দুনিয়ার সভ্য দেশসমূহের বিচার বিভাগীয় আইন কানুন ও কনভেনশন পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করলে এই প্রশ্নগুলোর ইতিবাচক কোনও উত্তর পাওয়া যায় না এবং এটাই যদি বাস্তবতা হয় তা হলে যারা এই ঘটনাটি বিচার বিভাগীয় অসদাচারণ বলে আখ্যায়িত করেছেন তারা খুব একটা বাড়াবাড়ি করেছেন বলে মনে হয় না। এখানে আরেকটি বিষয়ও প্রণিধানযোগ্য। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে নির্বাচনকালীন সরকার ও তার গঠনপ্রণালী প্রভৃতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বেশ কিছু মন্তব্য করেছেন যা সংবিধানের সাথে খাপ খায় না। বলাবাহুল্য, সংবিধানে ১২৩ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে যে, সংসদের স্বাভাবিক মেয়াদ পূর্ণ হবার ৯০ দিন পূর্বে সংসদ এবং মন্ত্রিপরিষদকে বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে। সেখানে অন্তর্র্বর্তী সরকারের কথা নেই। প্রধানমন্ত্রী এখন লন্ডনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার গঠনের কথা বলেছেন এবং তাতে বিরোধী দল চাইলে অংশ নিতে পারেন বলেও উল্লেখ করেছেন। এই কথাটি প্রকারান্তরে পূর্ণাঙ্গ রায়েও এসেছে। এখানে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের সাথে এই রায়টির মিল হলো কিভাবে?

পাঠকদের নিশ্চয়ই স্মরণ থাকার কথা যে, আওয়ামী লীগ ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করার জন্য হরতাল, অবরোধসহ নৈরাজ্যকর এমন কোন কর্মসূচি নেই যা বাস্তবায়ন করেনি। গাড়ি ভাঙচুর, যানবাহন, ট্রেন, সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ, মানুষ হত্যা এবং লাগাতার হরতাল ও অবরোধ দিয়ে তারা দেশ ও দেশের অর্থনীতিকে অচল করে দিয়েছিল। তারা ঐ সময়ে দেশব্যাপী যে সংঘাত, সংঘর্ষের সৃষ্টি করেছিল তা আন্তর্জাতিক মহলকেও ভাবিয়ে তুলেছিল। অবস্থার এতই অবনতি হয়েছিল যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিষয়টির সম্মানজনক সুরাহার জন্য কমনওয়েলথ-এর সেক্রেটারি জেনারেল স্যার নেনিহানকে মধ্যস্থতার দায়িত্ব দিয়ে ঢাকা প্রেরণ করেছিলেন। তিনি একমাস ধরে প্রচেষ্টা চালিয়েও নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি থেকে আওয়ামী লীগকে নিবৃত্ত করতে পারেননি। আজকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালে সরকারি ও বিরোধী দলের সমসংখ্যক প্রতিনিধির সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন অন্তর্র্বর্তী সরকারের যে প্রস্তাব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পেশ করছেন এ প্রস্তাবটি কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেল তখনো করেছিলেন কিন্তু আওয়ামী লীগের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। ঐ সময়ে তৎকালীন বিএনপি সরকারও নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার বিরোধী ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অবস্থা বেগতিক হয়ে পড়ে এবং বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সরকারকে নমনীয় হতে হয়। ১৯৯৬ সালের ২৮শে মার্চ দেশের ষষ্ঠ সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন পাস হয় এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ অধিক সংখ্যক আসনে জয়ী হয়। কিন্তু সরকার গঠনের জন্য যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন ছিল তা তারা পায়নি। এই অবস্থায় জাতীয় পার্টি ও জাসদের সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। কিন্তু তাদের ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত এই শাসনামলে তারা দুর্নীতি ও দুঃশাসনে এতই জড়িয়ে পড়ে যে, সারা দেশের মানুষ তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। পত্রপত্রিকায় তাদের দুর্নীতি, অপশাসনের নিত্যনতুন কাহিনী ছাপা হতে থাকে। তাদের সৃষ্ট গডফাদার যথাক্রমে শামীম ওসমান, জয়নাল হাজারী, তাহের, গোলন্দাজ, ইকবাল প্রমুখ ও তাদের সন্ত্রাসী বাহিনীর অত্যাচারে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। বিচারের সর্বোচ্চ আদালতও তাদের সন্ত্রাস থেকে রেহাই পায়নি। বস্তি উচ্ছেদ সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়কে কেন্দ্র করে তারা হাইকোর্ট চত্বরে বস্তি বসিয়েছিল এবং বিচারকদের বিরুদ্ধে তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে ঝাড়ু ও লাঠি মিছিল বের করেছিল। আওয়ামী লীগ প্রধানকে সর্বোচ্চ আদালত থেকেই ‘রং হেডেড’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছিল। এই অবস্থায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দলীয় নেতৃবৃন্দের কাছে এই বিষয়টি যখন পরিষ্কার হয়ে যায় যে পরবর্তী নির্বাচনে দেশবাসী তাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসাবে না, তখনি তারা নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিলের জন্য গোপন ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং এরই প্রেক্ষাপটে তাদেরই সমর্থনপুষ্ট সুপ্রীম কোর্টের তিনজন আইনজীবী ২০০০ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে একটি রীট মামলা দায়ের করে। তাদের তরফ থেকে এই মর্মে নিদেন পেশ করা হয় যে, সরকারের গণতান্ত্রিক কাঠামো হচ্ছে সংবিধানের মৌলিক নীতি এবং সংবিধানের ভূমিকা ও অনুচ্ছেদ ৮ ও ৬৯ অনুযায়ী প্রশাসনের প্রত্যেকটি স্তর জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পরিচালনা করা উচিত। এই রীট আবেদনটি হাইকোর্টের বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদিন, বিচারপতি মোঃ আওলাদ আলী এবং বিচারপতি মির্জা হোসাইন হায়দারের সমন্বয়ে গঠিত একটি বিশেষ বেঞ্চে শুনানি হয়। শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করা হয়। এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৫ সালে সুপ্রীম কোর্টের আওয়ামীপন্থী ৩ জন আইনজীবী যথাক্রমে এম, সলিমুল্লাহ, রুহুল কুদ্দুস এবং আব্দুল মান্নান খান হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আপীল করেন। বলাবাহুল্য, আপীলকারী আইনজীবীদের মধ্যে জনাব সলিমুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেছেন এবং জনাব রুহুল কুদ্দুস বর্তমানে হাইকোর্টের একজন বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই আপীল মামলার রায়টি ২০১০ সালের মে মাসের ১১ তারিখে সংক্ষিপ্ত আকারে ঘোষিত হয় এবং এর পরপরই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জনাব এবিএম খায়রুল হক অবসরে চলে যান। অবসরে গিয়ে তিনি পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার কাজ শুরু করেন এবং রায় প্রকাশিত হবার পর দেখা যায় যে, মৌলিকভাবে ঘোষিত রায়ের সঙ্গে লিখিত ও স্বাক্ষরিত এবং সরকার কর্তৃক প্রকাশিত রায়ের মিল নেই। এই বিষয়টি দেশবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। উচ্চ আদালতের তরফ থেকে প্রদত্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায়ের অবস্থা যদি এই হয় তাহলে দেশ ও দেশবাসীর জন্য তা একটি মারাত্মক বার্তা বহন করে বলে মনে হয়। সম্ভবত এই নিয়ে কোন প্রশ্নই উঠতো না যদি ক্ষমতাসীন দলের কিছু কর্মকান্ড এবং আনুপূর্বিক কিছু ঘটনা সম্পর্কে মানুষের সন্দেহ না জাগতো।

আদালত একটি পবিত্র জায়গা। ইনসাফের জন্যে মানুষ আদালতের দ্বারস্থ হয়। এই আদালত যদি কোন প্রকার অনিয়ম, অসদাচরণ কিংবা পক্ষপাতিত্ব কিংবা দল বা গোষ্ঠী বিশেষের স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় অথবা হচ্ছে বলে জনমনে সন্দেহ দেখা দেয় তখন বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। আবার বিচার ব্যবস্থার উপর থেকে যদি মানুষের আস্থা বিশ্বাস উঠে যায় তাহলে দেশ ও সরকারের কার্যকারিতা আর থাকে না। মানুষ যার যা ইচ্ছা তাই করে। সুশাসনের সকল দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আজকে আদালতের সাবেক একজন প্রধান বিচারপতির আচরণ নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে তার সুরাহা হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এখানে আদালত অবমাননা বা ব্যক্তির অবমাননার বিষয়টি বড় নয়। বিষয়টি হচ্ছে দেশ ও বিচার ব্যবস্থার সম্মান অক্ষুণœ রাখা এবং তার উপর মানুষের আস্থার পুনর্বাসন। এই আস্থায় যদি কোন ধস নামে তাহলে মানুষের মধ্যে এই ধারণা জন্মায় যে, আদালত শাসক দলের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে এবং ‘মানবতা বিরোধী অপরাধের’ অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ বিভিন্ন আদালতে সরকার বিরোধী ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক যেসব মামলা মোকদ্দমা হয়েছিল তার রায়ও সরকারের ইচ্ছামতই হয়েছে এবং এক্ষেত্রে বিচার ছিল একটি প্রহসনে। এই ধারণা-বিশ্বাসের অনেকগুলো কারণও এর মধ্যে দেশ-বিদেশে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত রায় প্রদানের আগে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক কর্তৃক ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে লাখ লাখ টাকার অনুদান গ্রহণ দেশ-বিদেশে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক প্রকাশিত মানবাধিকার রিপোর্টে এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, গুরুত্বপূর্ণ মামলাসমূহের ক্ষেত্রে সরকার বিচারকদের অবৈধ অর্থ ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে নিজেদের অনুকূলে রায় আদায় করেছেন। State Department-এর রিপোর্টে (২০১১) বিষয়টিকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে :

“In August a Daily Star investigative report revealed that former Chief Justice ABM Khairul Haque received a payment of Tk. 10,37000 ($ 13,127) from the Prime Minister’s Relief and Welfare Trust. According to the report, Mr. Haque and several other Judges from the High Court Division received the money shortly before a series of rulings that nullified several Constitutional Amendments including a provision protecting the electoral system from politicization, thereby setting up the passage of the 15th Amendment by the A.L. led Parliament. The Ministry of Law, Justice and Parliamentary Affairs confirmed the amount transferred and Haque stated that the payment was used to purchase medical treatment for his wife.”

গুরুত্বপূর্ণ রায় প্রদানের পূর্বে বিচারপতিদের বিশেষ করে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সরকারের তরফ থেকে প্রদত্ত এ ধরনের অর্থ গ্রহণ তার/তাদের নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করে দিয়েছে বলে দেশ-বিদেশে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে তাদের রায়ে সরকারের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছে বলে মানুষ মনে করে। এরই প্রমাণ পাওয়া যায় মুন সিনেমার মালিকানা বিরোধ নিয়ে দায়ের করা মামলায় বিচারপতি খায়রুল হক কর্তৃক সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে প্রদত্ত রায়ে। একইভাবে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়েও প্রধানমন্ত্রীর অনেক ইচ্ছার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। এটা coincidence কিংবা Great men think alike এর মত ঘটনা কিনা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা এবং বিচারপতি খায়রুল হকই তা বলতে পারেন। পূর্ণাঙ্গ রায়টি পড়লে (যা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে) এটা বুঝা যায় না যে, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপীল মামলার এটি একটি রায়। এতে হাইকোর্ট ডিভিশন কেয়ারটেকার সরকারকে বৈধ বলে যে রায় দিয়েছিল তার কোনও বিশ্লেষণ নেই। মূল মামলায় বাদী যা চেয়েছেন তাই বিচার্য বিষয় হওয়ার কথা থাকলেও এখানে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে এসে সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের কাজকর্মকে বৈধতা দেয়া হয়েছে, যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি ছিল। কেয়ারটেকারের বিকল্প হিসেবে এমপিদের দ্বারা গঠিতব্য নির্বাচনকালীন সরকারের যে রূপরেখার কথা এতে বলা হয়েছে তাও অনেকের কাছে অপ্রাসঙ্গিক এবং বাস্তবতা বিবর্জিত বলে মনে হতে পারে। পার্লামেন্ট নির্বাচন করতে হলে পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে হয়, পার্লামেন্ট বহাল রেখে নির্বাচন করা যায় না। যদি তাই হয়, তাহলে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের জন্য এমপি পাওয়া যাবে কোথায়? এটি একটি বিরাট প্রশ্ন। সরকার গঠনের জন্য নির্বাচন দিয়ে কি কয়েক ব্যক্তিকে এমপি বানিয়ে আনতে হবে? তারা নির্বাচনের পর কি ফিরে যাবেন? এ ধরনের নির্বাচন ও ফিরে যাবার ঘটনা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে দুনিয়ার কোথাও নেই। কাজেই এ ধরনের নির্দেশনাকে অবাস্তব ও অদূরদর্শী না বলে কি কোনও উপায় আছে। এই অবস্থায় ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়টি রাজনৈতিক সংকট নিরসনের পরিবর্তে তাকে আরও ঘনীভূত করেছে বলে আমার বিশ্বাস।

https://www.dailysangram.info/post/535801