১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, রবিবার, ১১:২৪

রাজধানীতে ৫২টি সক্রিয় ‘কিশোর গ্যাং’ গ্রুপে ৬৮২সদস্য

কিছু দিন আগে বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় গুরুতর আহত হয় এসএসসি পাস করা আরিয়ান। এর কয়েকদিন আগে প্রতিপক্ষ কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয় তিনজন। এভাবে বিভিন্ন সময় দেখা যায়-তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিশোরদের মধ্যে সংঘর্ষ এবং হতাহতের ঘটনা ঘটে। বলা যায়, কিশোর গ্যাং এখন আতঙ্কের নাম। বর্তমানে কিশোর গ্যাং শহর থেকে গ্রাম, পাড়া-মহল্লায়, অলিতে-গলিতে সর্বত্র গড়ে উঠছে আশঙ্কাজনক হারে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মতে, শুধু রাজধানীতেই ৫২টি সক্রিয় ‘কিশোর গ্যাং’ গ্রুপ এবং ৬৮২ জন ‘কিশোর গ্যাং’ সদস্য রয়েছে। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় সমগ্র দেশের চিত্র কতটা ভয়াবহ। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, মাদক চোরাচালান, অপহরণ, যৌন হয়রানি, চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি থেকে শুরু করে গুম-খুনের মতো ঘৃণ্য অপরাধে কিশোরেরা জড়িয়ে যাচ্ছে প্রায়ই। বর্তমানে কিশোর গ্যাং শুধু অভিভাবকদের জন্যই আতঙ্ক নয়; বরং পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্যও ক্ষতিকর। দুঃসাহসিক গোয়েন্দা কাহিনী, থ্রিলার সিনেমা ভিডিও গেমস এবং ক্রাইম পেট্রল দেখে ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর-তরুনরা। ক্যাবল নেটওয়ার্ক এবং নেট জগতে অবাধ প্রবেশের কারণে কিশোর-তরুনরা প্ররোচিত হচ্ছে। অভিভাবকদের কাছে এই গ্যাং কালচার ক্রমেই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাদকাসক্তি, দারিদ্র্য, নিম্নমানের জীবনযাত্রা, পরিবারিক সমস্যা, হতাশা, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাব, ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব এই কারণগুলোই মূলত কিশোর গ্যাংসমূহ গড়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী। মূল কারণগুলো ছাড়াও আরো কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে। যেমন-শিল্পায়ন ও নগরায়ণের প্রভাবে একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে একক পরিবারে পরিণত হচ্ছে। ফলে কিশোরেরা পারিবারিক অনুশাসনে দীক্ষিত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাছাড়া কেউ কেউ রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থের লক্ষ্যে এবং এলাকায় আধিপত্য বজায় রাখতে কিশোরদের ব্যবহার করছে নানা সন্ত্রাসীমূলক কর্মকা-ে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৭ বছরে ঢাকায় কিশোর অপরাধীদের হাতে ১২০টি খুন হয়েছে। বিশেষ করে স্কুলের গ-ি এখনো পার হয়নি এমন উঠতি বয়সের কিশোররা সামাজিক নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে উদ্বেগজনক হারে। এদের বেশির ভাগের বয়স ১৩ থেকে ১৭ এর মধ্যে। বাংলাদেশের শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচের সবাই ‘শিশু’। চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, হত্যা, প্রেমসংক্রান্ত বিরোধ, আধিপত্য বিস্তারে মারামারি, উচ্চস্বরে হর্ন বাজিয়ে মোটরবাইক চালনা, ইভটিজিং, নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার জন্য সন্ধ্যার পর সশস্ত্র মহড়া, মাদক সেবন ও বিপণন, ইত্যাদি এদের কাজ। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। এদের নিয়ন্ত্রণ করে এলাকার রাজনৈতিক দলের ‘বড় ভাই’য়েরা। প্রতিটি গ্যাংয়ের আলাদা আলাদা পরিচিতি ও নাম রয়েছে। যেমন- নাইন স্টার, ডিসকো বয়েজ, বিগ বস, নাইন এমএম, টাইগার গ্রুপ, নয়ন গ্রুপ, মিশন গ্রুপ, একে ৪৭, ফাইভ স্টার ইত্যাদি। পুলিশের অভিযানে মাঝে মাঝে এধরণের গ্যাং গ্রুপের সদস্য গ্রেফতার হলেও প্রভাবশালীদের ছাত্রছায়ায় অনেক কিশোর-তরুন অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ফিল্মি স্টাইলে ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, হত্যাকান্ডসহ ভয়ঙ্কর অপরাধে রয়েছে তাদের নাম। ফৌজদারি অপরাধ করলেও আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায় তারা। বয়সের তারতম্যের কারণে প্রকৃত সাজা দেয়া যায় না পুলিশ জানায়। ফলে বেশিরভাগ সময়ে অপরাধীদের গ্রেফতার করলেও কারাগারে না পাঠিয়ে সংশোধনাগারে পাঠিয়ে দেন আদালত।

র‌্যাবের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার উত্তরায় ২২টি ও মিরপুরে ১০টি গ্যাং সক্রিয়। এ ছাড়া তেজগাঁও, ধানম-ি, মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, মহাখালী, বংশাল, মুগদা, চকবাজার ও শ্যামপুরে একাধিক গ্যাং সক্রিয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা খুন, ছিনতাই-চাঁদাবাজি, শ্লীলতাহানি ও ইভটিজিং এবং মাদক ব্যবসার মতো অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের নিয়ন্ত্রক বা পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় সমাজের কিছু ‘বড় ভাই’ রয়েছে।

গত ২১ মে মাসে সংঘবদ্ধ একটি আন্তর্জাতিক টেলিগ্রাম গ্রুপে জড়িয়ে হাজার হাজার কিশোরী-তরুণীকে ব্ল্যাকমেইল করে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সংঘবদ্ধ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এ সময় ৯ কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। ২৫ মে মদের টাকা সংগ্রহ করতে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা পরিকল্পিতভাবে ইজিবাইক চালক কিশোর শাকিলকে নৃশংসভাবে খুন করে। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে এই হত্যাকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগে কিশোর গ্যাংয়ের লিডার জনিসহ (২১) চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এপ্রিল মাসে মোহাম্মদপুরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয়েছে লেগুনার লাইনম্যান মোহাম্মদ নবী হোসেন। একই থানায় কিশোর গ্যাংয়ের হাতে বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

এদিকে বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়েই কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় গুরুতর আহত হয় সদ্য এসএসসি পাস করা আরিয়ান। এ ঘটনায় দুই অভিযুক্তকে আটক করা হলেও এখনও পলাতক রয়েছে দুই জন। এছাড়া মামলা তুলে নিতে প্রতিনিয়ত হুমকি দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। এলাকার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, প্রকাশ্য দিবালোকে এক শিক্ষার্থীকে নির্মমভাবে কুপিয়ে জখম কর কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে শিক্ষার্থী আরিয়ানের ওপর এমন হামলা চালায় এলাকার কিশোর গ্যাং হামিম গ্রুপের সদস্যরা। লাঠি, রড, ছুরির আঘাতের সঙ্গে এলোপাথাড়ি লাথি-ঘুসি মারতে থাকে শিক্ষার্থী আরিয়ানকে। প্রাণ বাঁচাতে রক্তাক্ত শরীরে ছুটতে থাকে আরিয়ান। পেছনে হামলাকারীরাও ছুটতে থাকে। গত ১৫ আগস্ট ঘটে এই লোমহর্ষক ঘটনা। এরপর ১০ জনকে আসামি করে মামলা করে ভুক্তভোগীর পরিবার। গ্রেফতার করা হয় দুই জনকে। ভুক্তভোগীর পরিবারের অভিযোগ, মামলা তুলে নিতে আসামিরা উড়ো ফোনে প্রতিনিয়ত হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। আরিয়ানের বাবা জানান, যেদিন এ মামলার ২ নম্বর আসামি অনন্ত গ্রেফতার হয় সেদিন একটা ফোন নাম্বার থেকে ফোন আসে। অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘মামলা তুলে নিলে আপনার জন্য ভালো, আমার জন্যও ভালো হয়।’

https://www.dailysangram.info/post/535662