রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট দিন-রাত ক্রেতাদের আনাগোনা থাকলেও এখন আর নেই সেই চিরচেনা দৃশ্য। মার্কেটটি এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মার্কেটজুড়ে শুধুই অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের আর্তনাদ। মার্কেট ও আশেপাশের এলাকায় এখনো পোড়া গন্ধ। নিজ নিজ দোকানের পোড়া ধ্বংসস্তূপ সরাতে ব্যস্ত ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের চোখেমুখে এখন হতাশার ছাপ। কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন সেই চিন্তা সবার। অনেক ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, তাদের অনেক মালপত্র লুটপাট হয়েছে। তাদের অভিযোগ স্থানীয় বিহারি ক্যাম্প ও আশপাশের লোকজন পুড়ে যাওয়া দোকানের মালামাল লুট করেছেন।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলেন, ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডে তাদের সব স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এসব ব্যবসায়ীরা তাদের সবটুকু সম্বল দোকানে বিনিয়োগ করেছিলেন।
এখন পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়াতে আবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন। আবার ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য তারা সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন। যত দ্রুত সম্ভব পুনর্বাসন এবং মার্কেটের সামনে সড়কের পাশে অস্থায়ী দোকান বসানোর দাবি জানিয়েছেন তারা।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, কৃষি মার্কেটের বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছি, তিনি এ বিষয়ে অবগত আছেন। আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য। মার্কেটের ব্যবসায়ীরা অধিকাংশই মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত। আমাদের চোখের সামনেই এই বাজার গড়ে উঠেছে। এত বড় একটা ক্ষতি, প্রায় পাঁচ-ছয়শ’ পরিবার একদম সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে। আমরা অর্থনৈতিকভাবে তারা যাতে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে, সে সহযোগিতা করবো।
অপরদিকে কৃষি মার্কেটের সামনে জেলা প্রশাসনের পক্ষে একটি বুথ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করতে দেখা গেছে। ব্যবসায়ীরাও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে তালিকায় নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্তি করছেন। ঢাকার জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের একটি তালিকা করবো। তারপর আমরা সরকারের পক্ষ থেকে তাদের মানবিক সহায়তা করার চেষ্টা করবো।
গতকাল দেখা গেছে, পুড়ে যাওয়া মার্কেটের ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ দোকানের সামনে নির্বাক বসে আছেন। অনেকের মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। কি করবেন বা না করবেন সেটিও ভেবে পাচ্ছেন না। সবার চোখেমুখে হারানোর ছাপ। মার্কেটের নতুন কাঁচাবাজারের দোকানগুলোতে অক্ষত পণ্য নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, অনেকেই সহযোগিতার নামে লুট করেছেন। আবার অনেকে দোকান থেকে বের করে রাখা মাল নিয়ে গেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত দোকানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, নারী-পুরুষ ও ছোট বড় ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন দোকানের ছাই সরিয়ে মালামাল নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ লোহার অ্যাঙ্গেল, পাইপ নিয়ে যাচ্ছেন। মুদি দোকানগুলোতে সবচেয়ে বেশি ভিড় দেখা গেছে। এতে বিরক্ত ব্যবসায়ীরা। তাদের সরিয়ে দিলেও কেউ সরছেন না। এদের বেশির ভাগই পাশের বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দা।
মালামাল লুটের বিষয়ে জানতে চাইলে তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) আজিজুল হক বলেন, আমরা মার্কেটের নিরাপত্তায় কাজ করছি। সব গেটে আমাদের পুলিশ সদস্যরা আছে। কেউ কোনো অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা নিবো।
শুভেচ্ছা জুয়েলার্সের মালিক মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, চোখের সামনে কোটি টাকার সম্পদ পুড়তে দেখলাম, কিছুই করতে পারলাম না। দুই কসমেটিকসের দোকানের মালিক দুই ভাই জহিরুল ইসলাম লিটন ও জসিম উদ্দিন। জহিরুল বলেন, আগুন লাগার পরে দৌড়ে এসেও কিছুই উদ্ধার করতে পারেননি। তার ভাই জসিম বলেন, একটা কিচ্ছু বের করতে পারি নাই, একটা সুতাও না। এখন কি করবো, কোথায় কার কাছে যাবো? কবে দোকান ঠিক হবে, আর ঠিক হলেই আবার দোকান সাজাতে মালামাল তোলার টাকা কই পাবো। জানি না কী হবে।
আলী স্টোরের মালিক আবু তাহের বলেন, আগুন নেভার পরে দেখি দোকানের বেশির ভাগ মালামাল আগুন ও পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। গতকাল রাতে যেসব মাল পেয়েছি সেগুলো গুছিয়ে রেখে গেছি। গতকাল সকালে এসে দেখি বেশির
ভাগ মালই চুরি হয়ে গেছে। কে কীভাবে নিয়ে গেছে বলতে পারছি না। এগুলো যেন এখন লুটের মাল।
আলম নামের ব্যবসায়ী বলেন, আমরা তো নিঃস্ব হয়ে গেছি। কিন্তু চুরি করে নিয়ে এরা এখন আবার পোড়া ঘায়ে আঘাত দিচ্ছে। চাঁদপুর স্টোরের মালিক শারমিন আক্তার বলেন, তিন বোন মিলে দোকান চালাতাম। আগুনে সব পুড়ে গেছে। এরপর ছাইয়ের নিচে যা পেয়েছি সেগুলো গুছিয়ে এক পাশে রেখেছি। সাটার লাগানো ছিল। কিন্তু সকালে এসে দেখি কিছুই নেই। সাটার খুলে সব নিয়ে গেছে। সাবানের গুঁড়া, চিনির বস্তাসহ বিভিন্ন মালামাল রাখা ছিল।
এদিকে আগুনের হাত থেকে বেঁচে পাওয়া চাল, ডাল, আলু, লবণ, আটা, চিনিসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। আগুনের কারণে ধোঁয়ার গন্ধ ও ভেজা এসব পণ্য নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করছেন তারা। সাধারণ সময়ের ৮০ টাকার চাল এখন ১০ থেকে ১৫ টাকা কেজি বিক্রি করছেন। আবার কেউ কেউ এক বস্তা চাল বিক্রি করছেন মাত্র ৭০০ থেকে হাজার টাকায়। আর এসব পণ্য কম দামে কেনার আশায় অনেকেই ভিড় করতে দেখা গেছে।
বুধবার গভীর রাতে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। প্রথমে সাতটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। পরে ধাপে ধাপে ইউনিট বেড়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে যোগ দেয় ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিট। প্রায় ৬ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। এ ঘটনায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস