১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ১:১২

মাদ্রা নতুন বাজার

অর্ডার পেলেই আনা হয় মাংস

আগে গ্রাম থেকে শহরে যেতো টাটকা ফল। আর এখন রাজধানী ঢাকা থেকে বিভিন্ন ফল আসে মাদারীপুরের বাজারে। তাই ঢাকার চেয়ে গ্রামে ফলের দাম বেশি। মাদারীপুরের মাদ্রা বাজারের ফল বিক্রেতা শামিম শেখ। ৭ বছর ধরে তিনি ফল বিক্রি করছেন। তার দোকানে মাল্টা আর কমলার কেজি ৩০০ টাকা করে। আপেলের দাম ২৫০ টাকা কেজি। শামিম জানান, আগের মতো এখন আর বেচাকেনা হয় না। গ্রামের মানুষ ফল খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। কেবল অসুস্থ কাউকে দেখতে গেলে ফল কিনে নিয়ে যান।
মাদারীপুর জেলার আড়িয়াল খাঁ নদী ঘেঁষা ইউনিয়ন ঝাউদি।

ভোরে মোরগের ডাক শুনে ঘুম ভাঙে এই গ্রামের মানুষের। সূর্য উঠার আগে তোড়জোড় শুরু হয় তাদের। হাতে কাঁচি কিংবা কাঁধে লাঙ্গল নিয়ে ছুটে চলেন মাঠে। চাষাবাদ এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান জীবিকা। তবে এখন অধিকাংশ জমিতে তেমন কোনো ফসল নেই। জোয়ারের পানি এসেছে গ্রামে। কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও আবার ঠাঁই নেই। এখানে ভালো ফলে সোনালী আঁশ খ্যাত পাট। এখন পাটের মৌসুম। কিন্তু আশানুরূপ দামে পাট বিক্রি করতে না পারায় তাদের মুখে হাসি নেই। অথচ জিনিসপত্রের চড়া দামে সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে তাদের। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করছে গ্রামের মানুষ।

ঝাউদি ইউনিয়নটি মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলায় অবস্থিত। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম ওরফে আবুল হাওলাদার জানিয়েছেন, ইউনিয়নটিতে ৪০ হাজার মানুষের বসবাস। তাদের অধিকাংশই কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল। প্রায় ৬ হাজার পরিবারের মধ্যে ৪ হাজার পরিবার কৃষক। এসব কৃষক পরিবারের মধ্যে দারিদ্রসীমার নিচে রয়েছে ৫০০-৬০০ পরিবার। প্রায় ২০-৩০ দিন আগে জমি থেকে পাট কেটেছেন এখানকার কৃষক। সেগুলো জাগ (পানিতে পচানো) দেয়াও হয়েছে। সেই পাট পানি থেকে তোলার পর গৃহিণীরা আঁশ আলাদা করছেন। ফের সেই পাটের আঁশ পানিতে ধুঁয়ে আটি বানিয়ে রাখছেন। শুকানোর পর বড় বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এই মৌসুমে কৃষকের এটাই প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততা। পাট বিক্রি করে আশানুরূপ টাকা আয় করতে না পারায় আক্ষেপও রয়েছে তাদের। এতে পরিবার নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে গ্রামটির অধিকাংশ বাসিন্দাদের। এ ছাড়া সারা বছর ধরে প্রধান শস্য ধান, সরিষা, আখ চাষাবাদ করেও খুব বেশি লাভ করতে পারেন না বলেও জানান গ্রামবাসী।

এই ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় বাজার মাদ্রা নতুন বাজার। প্রতিদিন সকাল ও বিকালে মানুষ বাজারে আসেন। সংসারের জিনিসপত্র কেনেন। পুরো বাজারে মাত্র একটি মাংসের দোকান রয়েছে। কিন্তু সেখানে নিয়মিত মাংস বিক্রি হয় না। শুধু অর্ডার পেলেই কখনো ৫ কেজি কখনো ১০ কেজি মাংস সদর থেকে কিনে এনে দোকানে বিক্রি করেন। গ্রামের বাসিন্দারা জানান, মাংস কেনার মতো সামর্থ্য নেই এখানকার দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষের। তাই এই বাজারে গরু কেটে মাংস বিক্রি হয় না। বিয়ের অনুষ্ঠান থাকলে কেবল তখনই ক্রেতার সঙ্গে চুক্তি করে গরু কিনে আনা হয়। যেসব কৃষকের ফসলি জমি নেই তারা সারাদিন ক্ষেতে বদলা দিয়েও এক কেজি মাংস কেনার টাকা রোজগার করতে পারেন না। রোজ কাজ করে ৫০০-৬০০ টাকা আয় করেন। অথচ এক কেজি মাংসের দাম ৭৫০ টাকা। ক্ষেতে নিয়মিত কাজও হয় না। তাই এই টাকা দিয়েই ম্যানেজ করে পুরো পরিবারকে চলতে হয়।

বাজারে কয়েকটি মাছের দোকান রয়েছে। পাঙ্গাস, তেলাপিয়া, দেশি পুটি, কৈ- এসব মাছই বেশি বিক্রি হয়। আর দামী মাছের মধ্যে কেবল ইলিশ। তাও সবচেয়ে ছোট আকারের ইলিশ। এক কেজি ওজন দিলে তাতে প্রায় ৫টা মাছ ওঠে। মাদ্রার এই বাজারটিতে মাছ বিক্রি করেন জসিম হাওলাদার। তিনি বলেন, বড় ইলিশ মাছ আনলে বিক্রি হয় না। মানুষের সাধ্য নাই এতটাকা দিয়ে কেনার। আমি প্রতিদিন ছোট ছোট ১০-১৫ কেজি ইলিশ এনে বিক্রি করি। তাও কেজি ৭০০-৮০০ টাকা করে। এখন মাছের দাম বেশি। তাই বিক্রিও হয় কম। মাদ্রা বাজারের একটি চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা। এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার কথা জিজ্ঞেস করতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আব্দুল মালেক হাওলাদার। তার বয়স ৮০ বছর। এখনো হাঁটাচলা করতে পারেন।

জিনিসপত্রের দাম নিয়ে তিনি আক্ষেপ করেন। বলেন, ঢাকার চেয়েও এখানে সবকিছুর দাম বেশি। ঢাকায় আলু ৪৫ টাকা হলে এখানে বেচে ৫০ টাকা। আমাগো সব কিছুই কিনে খাইতে হয়। দাম বেশি দিয়াই কিনতে হয়। ৬০ টাকার নিচে কোনো চাল পাওয়া যায় না। মিনিকেট কিনলে ৭০ টাকা। মালেক হাওলাদার ৮০ শতাংশ জমিতে পাট লাগিয়েছিলেন। সেখানে ২০ মণ পাট হয়েছে। তবে পাটের দাম কম হওয়ায় তেমন লাভ হয়নি। এখন বাজারে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকার বেশি পাট বিক্রি করা যায় না। তিনি বলেন, ক’বছর আগেও ৩ হাজার টাকা পাটের মণ বিক্রি করেছি। আর এখন দুই হাজার টাকা বেচা লাগে। পাটে এখন কোনো লাভ হয় না। তাও মানুষ জমিতে লাগায়। এ ছাড়া কী করবো। ক্ষেত খালি রেখেও তো লাভ নাই।

বাজারটির অপু হেয়ার স্টাইলের নরসুন্দর অনিল শীল। দ্রব্যমূল্যের কাছে অসহায়ত্বের কথা জানালেন তিনিও। বলেন, এখানে তরিতরকারির দামও বেশি। ঢাকার চেয়েও অনেক সময় বেশি থাকে। যশোর থেকে মাল আসে সদরে। সেখান থেকে আবার এই বাজারে নিয়ে আসে। ৫০ টাকার নিচে কোনো তরকারিই পাওয়া যায় না। বাড়িতে কুটুম আসলে শুধু মাছ-মাংস কেনে। নইলে শাক-সবজি দিয়েই ভাত খায়।

স্থানীয় এক স্কুল শিক্ষক জানান, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সবকিছুই গ্রামের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। তারা কৃষি কাজ করে যে টাকা আয় করেন তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। তাই এই অঞ্চলের মানুষ একটু ভালো থাকার আশায় ছেলেদের কাজে দিয়ে দেন। এ কারণে এই অঞ্চলে শিক্ষার হারও অনেক কম। আবার অনেকের সারাজীবনের সঞ্চয় আর জমিজমা বিক্রি করে সন্তানকে বিদেশ পাঠিয়ে দেন। অবৈধ পথেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে পাঠানো হয়।

একটি এনজিওতে কর্মরত হেদায়েত হোসেন নান্নু বলেন, যাদের কৃষিকাজ করে সংসার চালাতে হয় তারা কষ্টে আছে। তবে যাদের পরিবারে প্রবাসী আছে তাদের এই কষ্ট করতে হয় না। তারা দাম বেশি হলেও চলতে পারে। কিন্তু এই গ্রামে নি¤œআয়ের কৃষকের সংখ্যাই বেশি। তাদের জীবনযাপন করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

সংসারের খরচ চালাতে চাষাবাদের পাশাপাশি গরু পালন করতেন আব্দুল গফুর মোল্লা। কিন্তু গরুতে এখন দুধ দিচ্ছে না। এতে বাজার খরচ চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে তাকে। সংসারের খরচ চালাতে কিছুদিন আগে এক মণ পাট ২৩০০ টাকায় বিক্রি করেছিলেন। সেখান থেকে ২০০ টাকা দিয়ে সার কিনেছিলেন। বাকি টাকা সংসার খরচ চালানোর জন্য ব্যয় করেছেন। গফুর মোল্লা বলেন, ছেলে-মেয়েরা ইলিশ মাছ খাইতে চাইছে। বাজারে বড় ইলিশ মাছের দাম জিজ্ঞেস করে কিনতে পারি নাই। পরে ছোট ছোট এক কেজি ইলিশ কিনেছিলাম ৭০০ টাকা দিয়ে। ৪ পিস পাইছি। আর তরিতরকারি কিনেছিলাম। কয়দিন আগেই তা খাওয়া শেষ। এখন বাজার করার টাকা নাই। আজ আলু দিয়া ঝোল বানাইছে। তা দিয়াই দুপুরে খাইছি। আলুর দামও এহন ৫০ টাকা হইছে। আলু কেনার সাহসও পাই না। আমার মতো ৮০ শতাংশ লোকের এমন অবস্থা। ধান করেছিলাম তাই শুধু চাউলটা ঘরে আছে।

কৃষিকাজ করেন ইয়াসিন চৌকিদার। তার কিছু জমি বর্গা দিয়েছেন। সেখান থেকে ২ মণ পাট পাবেন। আর নিজে চাষ করে ৪ মণ পাট করেছেন। বাজারে এসব পাটের দাম ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা বিক্রি করতে পারবেন। আর কিছু ধান রয়েছে ঘরে। ফের অন্য ফসল আসার আগ পর্যন্ত এসব দিয়ে টেনেটুনে সংসার চালাতে হবে তার। ইয়াসিন বলেন, ধান আছে তাই চাল কেনা লাগে না। টুকটাক বাজার করে সংসার চলে। কিন্তু ভালো খাওয়া যায় না।

দুই মেয়ে বায়না ধরেছে ইলিশ মাছ কেনার। বাবা কৃষক আব্দুল হালিম বৃহস্পতিবারও বাজারে গিয়েছিলেন। ইলিশ মাছ দরদাম করেও নিতে পারেননি। হালিম বলেন, মেয়েরা দুইবার কইছে ইলিশ মাছ কিনতে। ইলিশ মাছের দাম অনেক। এত টাকা দিয়ে মাছ কিনলে অন্য কিছু কিনতে পারবো না।

https://mzamin.com/news.php?news=74290