১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ১:১০

মোগড়াকান্দা গ্রামে চাপা কান্না

সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়নের মোগড়াকান্দা গ্রাম। প্রায় ৪ হাজার মানুষের বসবাস এ গ্রামে। অধিকাংশ মানুষই কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। বারো মাসই সবজি চাষ করেন। কেউ কেউ ইজিবাইক চালান, শ্রমিকের কাজ করেন। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তাদের অনেকেই। বাড়তি আয় করতে অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে ছুটছেন। এই এলাকার লোকজনের ক্রয় ক্ষমতা কেজি থেকে ‘গ্রামে’ নেমে এসেছে। ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের লোকজন বলছেন, কয়েক মাস আগেও সংসার খরচ মেটাতে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা লাগতো। এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকায়।

কিন্তু তাদের আয় বাড়েনি। বরং আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। গ্রামের অনেকেই স্বল্প আয়ে সংসার খরচ মেটাতে পারছেন না। কথা হয় চুনারচর গ্রামের আজিম সরকারের সঙ্গে। সবজি চাষি আজিম কৃষি কাজের ফাঁকে চায়ের দোকান করেন। নিত্যপণ্যের দামের সঙ্গে সংসার চালাতে না পেরে বাড়তি আয় করতেই তিনি চা দোকান খুলেছেন। তারপরও ভালো সময় যাচ্ছে না। পরিবারের প্রতিদিনের খরচ মেটাতে পারছেন না। সবজি চাষে সার কীটনাশকের দাম বাড়ায় ক্ষেতে ব্যয় করা টাকা তুলতে পারছেন না। বাজারে সবজির দাম চড়া হলেও ক্ষেত থেকে বিক্রির সময় তিন ভাগের একভাগ টাকাও পান না। আজিম সরকার বলেন, আমার পোলায় ঢাকা থাকে। সে বলে ঢাকায় জিনিসপাতির দাম বেশি। কিন্তু আমি তো ঢাকা আর গ্রামে দামের কোনো তফাত দেখি না। সবজি বাদে অন্য জিনিসের দাম শহরের চেয়ে গ্রামে আরও বেশি।

ভাকুর্তা ইউনিয়নে ভূমি জরিপ চলছে। এতে আরও বিপাকে গ্রামবাসী। সংসারের খরচের সঙ্গে ভূমি জরিপের বাড়তি খরচ যোগ হওয়ায় অনেকে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। রোকনউদ্দিন নামের এক ব্যক্তি বলেন, রেকর্ড করমু নাকি ভাত খামু। টাকা না দিলে জমি অন্যের নামে রেকর্ড হয়ে যায়। একে তো জিনিসপাতির দাম বাড়তি। এখন আবার ভূমি জরিপে আমাগো মাইরা হালাবো। বাজারে যেতে পারি না। মাছ মাংস খাই না মাস পার হলো। গেরামের বাকি দোকান থেকে চাল, ডাল, তেল নিয়ে চলছি। সেখানেও অনেক টাকা বাকি পড়েছে। যা অবস্থা হইছে এখন জমি বিক্রি করে খাইতে অইবো। নাইলে মরতে হবে। আগে সকালে ডিম খেতাম, এখন খাই না। রুটি খাওয়ার টাকা নাই, ডিম’তো দূরের কথা। একই এলাকার বাসিন্দা দুলাল সরকার। বসতভিটে ছাড়া বাড়তি জমিজমা নেই। বটতলা বাজারে একটি সেলুন আছে। তিন বছর ধরে তার স্ত্রী কিডনি রোগে ভুগছেন। এক ছেলে মাধ্যমিকে পড়েন। সপ্তাহে অন্তত দু’বার স্ত্রীকে ডায়ালাইসিস করতে হয়। সংসার চলে না তার ওপর চিকিৎসা খরচ। মাসে ৮-১০ হাজার টাকা স্ত্রীর পেছনেই খরচ। জানালেন, দুপুরে বাড়িতে শুধু ভাত রান্না হয়েছে। কোনো তরকারি ছিল না। ছেলে না খেয়েই প্রাইভেটে চলে গেছে। বাজার করার টাকা নেই। হোটেল থেকে ছয়টা ডালের বড়া কিনেছি। তাই দিয়ে স্ত্রী-সন্তান বাবা মাসহ চারজন দুপুরের খাবার খেয়েছি। দিন শেষে যা আয় করি, স্ত্রীর চিকিৎসা করে ডাল-ভাত জোগাড় করতেই হিমশিম অবস্থা। মাছ-মাংস খাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারি না। কাঁচা বাজারে কবে গেছি মনে নেই।

একই ইউনিয়নের চুনারচর গ্রামের আয়তন প্রায় ১ কিলোমিটার। ভোটার সংখ্যা ১৬০০। জনসংখ্যা প্রায় ৩১০০। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষক। সবজি চাষের সঙ্গে জড়িত। অনেকে ঘাস চাষ করেন, প্রবাসে থাকেন। বাসিন্দারা জানান তারা বাজার খরচ কমিয়েছেন। অনেক কাটছাঁট করেও সংসার চালাতে পারছেন না। সবাই বাড়তি আয় করতে ছুটোছুটি করছেন। অন্যের জমিতে কামলা দিচ্ছেন। এই গ্রামের বাসিন্দা রহমত মিয়া বলেন, বয়স তো কম হইল না। এত কষ্ট করে কখনো চলি নাই। বাজারে গেলে মাথা ঝিম ধরে। তখন আগের দিনের কথা চিন্তা করি। আগে ১০০ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে টাকা ফেরত আসতো। বছর দেড়েক আগেও ২০০ টাকা হলে দিন চলে যেতো। আর এখন চাল, ডাল, নুন, তেল কিনতে ৫০০ টাকা যায়। মাছ মাংসের কথা চিন্তা করা যায় না। আমার জমা টাকা নাই। যা ছিল গত ১ বছরে খেয়ে ফেলেছি। এখন দিন কামাই করি দিন খাই। যে কামাই, তা দিয়া দিন চলছে না।

ভাকুর্তা বাজার এলাকার বাসিন্দা আবু হানিফ বলেন, কাটছাঁট করে হিসাবনিকাশ করে চলতে হচ্ছে। প্রতি মাসেই ধার করতে হয়। জিনিসপত্রের যে দাম, বাজারে গেলে চোখে অন্ধকার দেখতে হয়। দুইজনের পরিবার নিয়েই চলা খুব কঠিন হয়ে গেছে। এখন সবজি ও আদা-পিয়াজের দাম বাড়ায় কিনতে পারছি না।

কিছুদিন আগেও ৫০ টাকার নিচে সবজি পাওয়া যেতো। এখন ৬০ টাকার নিচে কোনো সবজি পাওয়া যায় না। তখন কিনতাম এক কেজি এখন কিনি আধা কেজি করে। পাশের গ্রাম কাইশারচরের বিল্লাল সিকদার বলেন, অটো চালাই আয় রোজগার আগের মতোই রয়েছে। দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় হয়। সপ্তাহে ৪ থেকে ৫ দিন রোজগার হয়। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে প্রতিদিন ৫০০ টাকার নিচে আয় করলে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে যায়। কিন্তু আয় তো বাড়ছে না। জিনিসপাতির দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। আগে ডিমের দাম কম ছিল এখন তাও বেড়ে গেছে। ডিম কিনতে পারি না। চালের বাজারে গিয়ে হাঁসফাঁস করছিলেন মোগড়াকান্দা গ্রামের সবুর হোসেন পালোয়ান। তিনি বলেন, ভাই, কোনটা থুইয়া কোনটা কিনমো, বুঝতে পারি না। শুধু লাউ শাক খেতে হচ্ছে। এক তরকারি কতদিন খাওয়া যায়? চাল, ডাল, তরকারি কিনলে, মাছ, তেল কিনার টাকা থাকে না। তেল মসলা সবজি কিনলে চাল কিনার টাকা থাকছে না। জিনিসের এত দাম থাকলে পরের ক্ষেতে কামলা দিয়া বেশিদিন বাঁচা যাইবে না। অল্প জমি আছে। সেখানে সবজি চাষ করি। যেই দামে সবজি বিক্রি করি বাজারে গিয়া দেখি তারচেয়ে ডাবল দামে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু আমরা দাম পাই না। ডোমরাকান্দা বটতলা বাজার, কলাতিয়া বাজার, মুশুড়িখোলা বাজার। সপ্তাহে দুইদিন হাট বসে।

আশপাশের গ্রামের সকলে এসব বাজার থেকে তরিতরকারি কেনেন। এই বাজারের ব্যবসায়ীদের আরও বেহাল দশা। আগের মতো বেচাকেনা নেই। মুশুড়িখোলা বাজারের মুদি ব্যবসায়ী হোসেন আলী জানান, মুশুড়িখোলা হাট সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবার বসে। হাটের দিনে ৫০০ থেকে ৬০০ মানুষ আসেন কেনাকাটা করতে। গত সোমবার হাট ছিল ফাঁকা। লোকজন কম। বিক্রিও কম। ব্যবসা করি ছোটবেলা থেকে। জীবনে কখনো হাটে এত কম লোকজন আসতে দেখিনি। বাজারে ক্রেতাদের সবার মুখ মলিন। মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক পরিমাণ জিনিস কেনাকাটা করছেন। আমাগো অবস্থাও নাজেহাল। বেচবার না পারলে আয় হয় কীভাবে? সংসার চলবে কীভাবে? চাল বিক্রেতা মো. আবির হোসেন বলেন, আগের চেয়ে চাল বিক্রি অনেক কমে গেছে। মাসের শুরুর দিকে একটু বিক্রি হয় তারপর সারা মাস তেমন একটা বিক্রি হয় না। ব্যবসার পরিস্থিতি তেমন একটা ভালো না। সংসার চলছে কষ্টে, স্ত্রী একটি স্কুলে চাকরি করে। দু’জনের আয় দিয়ে কোনো রকম চলছে।

https://mzamin.com/news.php?news=74291