১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ১:০৭

প্লাটিলেট সংগ্রহে ভোগান্তি

সারা দেশে ২০৬টি ব্ল্যাডব্যাংক থাকলেও মাত্র ১৬টিতে প্লাটিলেট পৃথককরণের প্লাজমা অ্যাফেরেসিস মেশিন

মুমূর্ষ ডেঙ্গু রোগীর জন্য প্লাটিলেট (রক্তের একটি ক্ষুদ্র কণিকা) সংগ্রহ কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারি হাসপাতালে প্লাটিলেট পৃথকীকরণে প্রয়োজনীয় মেশিন সংকটের সুযোগে বেসরকারি হাসপাতালে ছুটছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। সেখানে শুধু প্লাটিলেটের পেছনে ব্যয় মেটাতেই তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

যুগান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে যে তথ্য মিলেছে তাতে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের ব্যয়ে আকাশ-পাতাল তফাত। প্রতিব্যাগ প্লাটিলেট সংগ্রহে সরকারি হাসপাতালে ফি দিতে হয় নামমাত্র ২৫০০ টাকা। অথচ বেসরকারি হাসপাতালে ২০-৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। যা একজন রোগীর জন্য বড় ধরনের চাপ।

পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এবারের ডেঙ্গুজ্বরের ধরন পরিবর্তন ও কারও ক্ষেত্রে তেমন উপসর্গ প্রকাশ না পাওয়ায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই রোগীরা শকে চলে যাচ্ছেন। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে শরীরে বিভিন্ন অঙ্গে রক্তক্ষরণ হয়ে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় চিকিৎসকরা রক্তের প্লাটিলেট দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। সারা দেশে সরকারি হাসপাতালে ২০৬টি ব্ল্যাডব্যাংক থাকলেও মাত্র ১৬টিতে প্লাটিলেট পৃথককরণের প্লাজমা অ্যাফেরেসিস মেশিন রয়েছে। এর ১০টিই আবার ঢাকাকেন্দ্রিক। প্রয়োজনীয় মেশিন সংকটে রোগীরা বেসরকারি হাসপাতালের ব্ল্যাডব্যাংকে ছুটছেন। সেখানে উচ্চমূল্যের প্লাটিলেট সংগ্রহে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন।

টানা আট দিন ডেঙ্গুজ্বরের চিকিৎসা শেষে শুক্রবার রাজধানীর হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান গিয়াস উদ্দীন (৫৫)। তার ভাগ্নে তারিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দিনদশেক আগে মামা, মামি ও তাদের ১২ বছর বয়সি সন্তানসহ পরিবারের সবাই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে মামার সিবিসি (কমপ্লিট ব্ল্যাড কাউন্ট) পরীক্ষার ফলাফলে রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ ২২ হাজারে নেমে যায়। প্রথমে তাকে মগবাজারের বেসরকারি আদদ্বীন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ততক্ষণে প্লাটিলেটের পরিমাণ ৭ হাজারে নেমে যায়।

আদদ্বীনে ২ ব্যাগ প্লাটিলেট দেওয়া হলেও তেমন উন্নতি হচ্ছিল না। পরে বেসরকারি হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নেওয়া হয়।
প্লাটিলেট সংগ্রহের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তারিকুল ইসলাম বলেন, আদদ্বীন হাসপাতালে প্লাজমা অ্যাফেরেসিস মেশিন না থাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যলয়ে (বিএসএমএমইউ) থেকে প্লাটিলেট সংগ্রহ করি। হলি ফ্যামিলিতে ভর্তির পর প্লাটিলেটের প্রয়োজন হলেও সেখানে কীট ও প্রয়োজীয় জনবল না থাকায় শান্তিনগরের কোয়ান্টাম ব্ল্যাডব্যাংকে যোগাযোগ করি। কোয়ান্টাম সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিব্যাগ প্লাটিলেটের জন্য চারজন রক্তদাতা ও ২০ হাজার করে টাকা লাগবে। ওই সময় আকস্মিক ডোনার ও অর্থ জোগাড় করতে বিপাকে পড়তে হয়। ফলে প্লাটিলেটের জন্য ফের বিএসএমএমইউতে যোগাযোগ করি। তারিকুল আরও জানান, নিজেদের ডোনার থেকে রক্ত নিলেও এক ব্যাগ প্লাটিলেট সংগ্রহের জন্য বিএসএমএমইউর ব্যাংকে ১৪ হাজার টাকা, প্যাথলজিতে ২৮০০ এবং ক্রস ম্যাচিংয়ের জন্য ১ হাজারসহ মোট ১৮ হাজার টাকা গুনতে হয়। বিএসএমএমইউ থেকে তিন ব্যাগ প্লাটিলেট সংগ্রহ করা হয়। এভাবে মামার পরিবারের তিন সদস্যের ডেঙ্গুর চিকিৎসায় ১০ দিনে প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

রক্তরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের রক্তে তিন ধরনের ক্ষুদ্র রক্তকণিকার মধ্যে সবচেয়ে ছোটটি প্লাটিলেট। প্লাটিলেট রক্ত জমাট বাঁধতে ও রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে সাহায্য করে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরের প্রতি মাইক্রোলিটার রক্তে প্লাটিলেটের মাত্রা দেড় লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ পর্যন্ত। এই পরিমাপের চেয়ে প্লাটিলেটের মাত্রা কমে গেলে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে না। এতে করে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি দেখা দেয়। চলতি বছর ডেঙ্গুর চারটি ধরনের মধ্যে ৭৬ শতাংশ রোগী দ্বিতীয় ধরনে আক্রান্ত হন। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নেওয়ায় আক্রান্তদের শক সিনড্রোম অর্থাৎ হঠাৎ শরীর নিস্তেজ হয়ে যাওয়া, হেমোরেজিক ফিভার বা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে মৃত্যু বাড়ছে। হাসপাতালে ভর্তির তিন দিনের মধ্যে এ ধরনের রোগীর ৮১ শতাংশই মারা যাচ্ছেন।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপতালের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান যুগান্তরকে জানান, ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট প্রয়োজন হলে দুটি পদ্ধতিতে এটি নেওয়া হয়। প্রথমত, সেন্ট্রিফিউজ মেশিনের মাধ্যমে চারজন দাতার ৪ ব্যাগ রক্ত থেকে এক ব্যাগ প্লাটিলেট সংগ্রহ করা হয়। দ্বিতীয়ত, একজন রক্তদাতার শরীর থেকে শুধু প্লাটিলেট নেওয়া, বাকিটা মেশিনের মাধ্যমে দাতার শরীরে চলে যাবে। প্লাজমা অ্যাফেরেসিস পদ্ধতিতে প্লাটিলেট সংগ্রহকে সিঙ্গেল ডোনার প্লাটিলেট (আরডিপি) বলা হয়। সরকারি হাসপাতালের ব্ল্যাডব্যাংকে প্লাজমা অ্যাফেরেসিস পদ্ধতিতে এক ব্যাগ প্লাটিলেট সংগ্রহে আড়াই হাজার টাকা খরচ পড়ে। সরকারিভাবে কীট সরবরাহ না থাকলে রোগীকে বাইরে থেকে কীট কিনতে হয়। ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা খরচ পড়ে। একটি অ্যাফেরেসিস কীটের আমদানি মূল্য ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেফ ব্ল্যাড ট্রান্সফিউশন ম্যানেজমেন্টের শাখা সংশ্লিষ্ট যুগান্তরকে জানান, নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচির মাধ্যমে রোগীর রক্ত নিশ্চিতে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা হেলথ কেয়ারের তত্ত্বাবধানে ২০৬টি সরকারি এবং বেসরকারিভাবে ১৭২টি ব্ল্যাডব্যাংক রয়েছে। বিভাগ, জেলা পর্যায়ের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিশেষায়িত ব্ল্যাডব্যাংকে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের তথ্য রাখা হয়। প্লাজমা অ্যাফেরেসিস পদ্ধতিতে প্লাটিলেট সংগ্রহে সরকারিভাবে সারা দেশে মাত্র ১৬টি হাসপাতালে সুবিধা রয়েছে। রাজধানীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হপাসাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগাদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিউিটট, জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট, জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার ও শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটসহ ১০টি সরকারি হাসপাতালে এ সুবিধা আছে।

ঢাকার বাইরে বরিশাল ছাড়া বাকি সাত বিভাগীয় শহরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্লাজমা অ্যাফেরেসিস পৃথকীকরণ ব্যবস্থা আছে।
জানা গেছে, অ্যাফেরেসিস প্লাটিলেটের কীট সরবরাহ করে তিনটি প্রতিষ্ঠান ডায়ামেড গ্রুপ, জনতা ট্রেডার্স ও ট্রেডসওয়ার্থ। এসব সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান চাহিদা বাড়লে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দফায় দফায় কীটের দাম বাড়িয়ে দেয়। এই সুযোগে পপুলার, গ্রিনলাইফ, থ্যালাসেমিয়া হাসপাতাল, রেড ক্রিসেন্ট, এএমজেড, রামপুরা ফরাজী হাসপাতাল ও পুলিশ লাইন্স হাসপাতাল এবং ইউনাইটেড হাসপাতালে অ্যাফেরেসিস প্লাটিলেট কার্যক্রমে উচ্চমূল্য রাখা হয়। বেসরকারি হাসপাতালে প্লাজমা অ্যাফেরেসিস পদ্ধতিতে এক ব্যাগ প্লাটিলেটের জন্য ২০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডা. রাশেদা সুলতানা যুগান্তরকে বলেন, প্লাটিলেট ১০ হাজারের নিচে নামলে তখন প্লাজমা লিকেজ হয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। তবে রক্তচাপ ও অন্যান্য জটিলতা না থাকলে প্লাটিলেট কমলেও ভয়ের কারণ নেই। প্রত্যেক ব্ল্যাডব্যাংকে প্লাজমা অ্যাফেরেসিস মেশিন বসানোর বিষয়ে চেষ্টা চলছে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে প্লাটিলেট খরচের লাগাম টানার উদ্যোগ নিতে হবে। এখানে রোগীদের নাভিশ্বাস অবস্থা। সরকারি হাসপাতালে এই সুবিধা বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।

প্লিটিলেটের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ডেঙ্গুজ্বর জটিল রূপ নিলে বা রক্তক্ষরণ দেখা দিলে তাকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলা হয়। এক্ষেত্রে রক্ত নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে রোগীর রক্তনালিগুলোর দেওয়ালে যে ছোট ছোট ছিদ্র থাকে, সেগুলো বড় হয়ে যায়। এতে রক্তনালির দেওয়াল ভেদ করে রক্তের জলীয় উপাদান বা ‘রক্তরস’ নালির বাইরে বের হয়ে আসে। একে প্লাজমা লিকেজ বলা হয়। এতে রোগীর পেটে, বুকে পানি জমা ও রক্তচাপ কমতে থাকে। রোগীর মস্তিষ্ক, কিডনি, হার্টে রক্তক্ষরণের আশঙ্কা থাকে। তবে প্লাটিলেট কমে গেলেই রক্ত নিতে হবে এমনটা নয়। সেক্ষেত্রে লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিলে রোগীকে সারিয়ে তোলা সম্ভব-যোগ করেন তিনি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/718420