১ মে ২০১৭, সোমবার, ৮:১২

চালের মূল্যবৃদ্ধিতে রেকর্ড

চট্টগ্রামের পাইকারি চালের আড়ৎ খাতুনগঞ্জ-চাক্তাই ও পাহাড়তলীতে চালের মূল্যবৃদ্ধিতে সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছে। পাইকারি বাজারে মোটা চালের দাম চার মাসের ব্যবধানে কেজিতে ১৮ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।


হাওর অঞ্চলে ফসলহানির অজুহাতে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি দাম বেড়েছে ৩শ’ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি শুল্ক কমানো না হলে চালের মূল্য আরও বাড়বে।

গত বছর এ মৌসুমে পাইকারি বাজারে চালের যে মূল্য ছিল এখন তা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বন্দর নগরী চট্টগ্রামে খুচরা বাজারে ৪৫ টাকার নিচে কোনো চালই নেই।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, একদিকে আমদানি না থাকা অন্যদিকে হাওরাঞ্চলে ফসলহানির কারণে মিল মালিক ও কৃষকরা চাল বেচাকেনা করছেন রেখে-ঢেকে। এ কারণে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হচ্ছে, বাড়ছে মূল্য। শুল্ক কমিয়ে এখনই আমদানির সুযোগ না দিলে চালের মূল্য আরও বাড়বে বলেও আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

চাক্তাই চালপট্টি ও পাহাড়তলী বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর আউশ মৌসুমে পাইকারি বাজারে মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ২০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৫ টাকায়। একই চাল চলতি আউশ মৌসুমে পাইকারি বাজারেই বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪২ টাকা দরে। খুচরা বাজারে গিয়ে যা ৪৫ টাকা থেকে ৫৫ টাকায় ঠেকেছে।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে নতুন বছরের শুরু থেকেই চালের দাম বাড়তে শুরু করে। গত এক মাস আগে মোটা চাল ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকায়। রোববার সেই চাল দুই হাজার টাকা থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সর্বশেষ এক সপ্তাহের ব্যবধানে সব ধরনের চালে বস্তাপ্রতি বেড়েছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।

চাক্তাই চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও বৃহৎ চাল ব্যবসায়ী এনামুল হক রোববার বিকালে যুগান্তরকে জানান, আউশ মৌসুমে এমনিতেই অন্যান্য মৌসুমের চেয়ে ফলন অর্ধেক হয়। এবার তার ওপর হাওরাঞ্চলে বন্যার কারণে ব্যাপক ফসলহানি হয়েছে। এতে ৬-৭ লাখ টন ফসলের ক্ষতি হয়েছে বলে সরকারিভাবেই বলা হচ্ছে।

তাছাড়া উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যে চালের জোগান আসে সেখান থেকে বিক্রি কমিয়ে দেয়া হয়েছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় চট্টগ্রামে এক মাস আগে থেকেই চালের দাম বাড়তে থাকে। হাওরাঞ্চলে ফসলহানির কারণে চালের দাম আরও এক দফা বেড়েছে।

সরকার যদি চালের ওপর শুল্ক কমিয়ে দিয়ে এখনই আমদানির সুযোগ না দেয়, তবে চালের দাম আরও বাড়বে। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে চালের দাম। শুল্ক বেশি হওয়ায় আমদানিকারকরা চাল আমদানি করছেন না।

বর্তমানে চালের ওপর ২৮ শতাংশ শুল্ক রয়েছে, যা কেজিতে ৯-১০ টাকা পড়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামে চাল মজুদ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিদিন উত্তরবঙ্গ থেকে যেসব ট্রাক ঢোকে তা থেকে বিক্রির পর যা থাকে তাই মজুদ।

নগরীর রেয়াজুদ্দিনবাজার, কাজিরদেউড়ি বাজার, চকবাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি স্বর্ণা সিদ্ধ চাল ৪৫ টাকা, ভারতীয় বেতি ৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

মিনিকেট (আতপ) এক নম্বর ৪৮ টাকা, জিরাশাইল (নবান্ন) ৫২ টাকা, আতপ বেতি এক নম্বর ৪৮ টাকা, দেশি পাইজাম ৪৭ টাকা, দিনাজপুরী পাইজাম ৫০ টাকা, কাটারিভোগ ৬০ টাকা,

চিনিগুঁড়া ৯৫ টাকা, ২৯ বেতি ৪২ টাকা, পাইজাম চিকন ৪৬ টাকা, বেতি আতপ চিকন ৪৪ টাকা, সিদ্ধ জিরাশাইল চিকন ৪৮ টাকা, সিদ্ধ মিনিকেট চিকন ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে উত্তরবঙ্গের মিল মালিক ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। বোরো ও আমন মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে চাল কিনে গুদামজাত করেন তারা।

সংকট সৃষ্টি করে বাজার অস্থির করে তোলেন তারা। নওগাঁ, দিনাজপুর, আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সান্তাহার (বগুড়া), রাজশাহী, কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন জেলায় তিন শতাধিক মিল ব্যবসায়ী রয়েছেন। এদের মধ্যে প্রায় ৩০ জন বড় মিলমালিক। তারা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে ধান-চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন।

চট্টগ্রামের বড় পাইকারি বাজার পাহাড়তলী ও চাক্তাই ব্যবসায়ীরা জানান, নওগাঁ, মহাদেবপুর, আশুগঞ্জ, দিনাজপুর, পাবনা, ঈশ্বরদীর মোকামগুলো থেকে বেশির ভাগ চাল আসে চট্টগ্রামে।

আশুগঞ্জ থেকে বেতি ও ইরি জাতের, দিনাজপুর থেকে মিনিকেট, পাইজাম, চিনিগুঁড়া, কাটারিভোগ জাতের আতপ এবং নওগাঁ, পাবনা, ঈশ্বরদী থেকে সিদ্ধ জাতের চাল আসে চট্টগ্রামে।

প্রতিদিন ৪৫০ থেকে ৫০০ টন চাল চাক্তাইয়ের আড়তগুলোতে আসে। ৫০ কেজি বস্তায় ১৬-২১ টাকা কমিশন পান আড়তদাররা। আর পাহাড়তলী পাইকারি বাজারে আসে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৪৫০ টন চাল।

এ বিষয়ে পাহাড়তলী চাল বাজারের সহ-সভাপতি মো. জাফর আলম যুগান্তরকে জানান, ইরি মৌসুম শুরুর আগে চালের দাম উঠা-নামা করে। এবার আগে থেকেই বাড়তি রয়েছে।

সিলেট অঞ্চলে হাওর এলাকায় বৃষ্টির কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ১৫ দিন পরে এসব ফসল কাটার কথা ছিল। বৃষ্টির ক্ষতির প্রভাব বাজারে এসে পড়েছে। এক মাসের ব্যবধানে সব ধরনের চাল বস্তাপ্রতি ৩-৪শ’ টাকা বেড়ে গেছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০১৫-১৬) বেসরকারিভাবে ২৫৭ দশমিক ২৪ হাজার টন চাল আমদানি হয়। আর চলতি অর্থবছরের (২০১৬-১৭) ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমদানি হয়েছে মাত্র ৪১ দশমিক ১৩ হাজার টন চাল।

চট্টগ্রাম রাইচ মিল মালিক সমিতির সভাপতি শান্ত দাশগুপ্ত যুগান্তরকে জানান, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় উৎপাদিত ধান দেশের চাহিদা মেটায়। কিন্তু এসব জেলায় বৃষ্টি আর বন্যায় শত শত একর ফসলি ধান তলিয়ে গেছে।

এতে দেশে ধান-চাল সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চাল ওই সব জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে চালের বাজার ফের অস্থির হয়ে পড়েছে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘চালের দাম বাড়ার প্রধান কারণ হচ্ছে সিন্ডিকেট ও বড় ব্যবসায়ীরা।

সরকারের নজরদারির অভাবে চালের দাম দফায় দফায় বেড়েছে। প্রশাসন কিছু ব্যবসায়ীকে সুবিধা পাইয়ে দিতে চুপ রয়েছে। এটা শুভলক্ষণ নয়।’ তিনি বলেন, ‘চালের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার খোলাবাজারে চাল বিক্রি শুরু করে। এবার তাও দেখছি না।’

http://www.jugantor.com/online/economics/2017/05/01/46122/