১ মে ২০১৭, সোমবার, ৮:০৯

হাওরডুবিতে উত্তরাঞ্চলের শ্রমজীবীদেরও দুর্দিন

হাওরে ফসল কাটার ধুম পড়ে বৈশাখ মাসে। ফসল ঘরে তুলতে কিষান-কিষানি থেকে শুরু করে সব বয়সী হাওরবাসী ব্যস্ত থাকে দিন-রাত। কিন্তু সাত জেলাজুড়ে বিস্তৃত হাওরাঞ্চলের বিপুল জমির বোরো ধান ঘরে তোলার মতো পর্যাপ্ত শ্রমশক্তি স্থানীয়ভাবে কখনোই ছিল না। আর এই সময়টাতে বোরো ধান কাটতে দেশের উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাকবলিত এলাকার লাখ লাখ দাওয়াল বা ক্ষেতমজুর চলে আসে হাওরাঞ্চলে। টানা এক-দেড় মাস পরিশ্রম করে তারা নৌকাবোঝাই করে কয়েক মাসের খাবার নিয়ে বাড়ি ফেরে। অনেকে ট্রাকে করেও ধান নিয়ে যায়। কেউ কেউ আবার ধান বেচে টাকা নিয়ে ঘরে ফেরে। অকাল বর্ষণ আর ঢলের পানিতে ফসলডুবির কারণে এবার হাওরবাসীর পাশাপাশি এই ক্ষেতমজুরদেরও কপাল পুড়েছে। পাল্টে গেছে হাওরজুড়ে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মব্যস্ততার চিত্র।

ধান কাটার সুযোগ না পেয়ে এবার খালি হাতেই বাড়ি ফিরেছেন উত্তরাঞ্চলের পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় সাত লাখ দাওয়াল। কেবল দাওয়াল নয়, হাওর থেকে কৃষকের খলায় ধান পরিবহনের সঙ্গে জড়িত বিশেষ করে গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের গাড়িয়ালদেরও একই হাল। সামগ্রিক কৃষি অর্থনীতি বিপন্ন হওয়ায় হাওরের কৃষকদের মতো এসব ক্ষেতমজুর আর গাড়িয়ালও সীমাহীন ক্ষতির শিকার হয়েছে। এ ছাড়া হাওরের ধান মাড়াই শ্রমিক, ধান পরিবহনে নিয়োজিত ঠেলা-ভ্যানচালক, ছোট ছোট নৌযান ও চাতাল শ্রমিক মিলিয়ে আরো প্রায় ১০ লাখ মানুষ ফসলহানির কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জানা যায়, উত্তরাঞ্চলে এ সময় শ্রমজীবী মানুষের হাতে কোনো কাজ থাকে না। তাই কৃষি শ্রমিকদের বড় অংশই নিজ নিজ এলাকার মহাজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করে। সেই টাকায় পরিবারের কিছুদিনের খাবারের সংস্থান করে তারা ধান কাটতে চলে আসে হাওরাঞ্চলে। এ ছাড়া গাজীপুরের ভাওয়াল ও টাঙ্গাইলের কালিয়াকৈরসহ বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার গাড়িয়াল মহিষের গাড়ি নিয়ে এ সময় হাওরে আসে।
কিন্তু ফসলডুবির কারণে এবার হাওরের কৃষকদের মতো এসব শ্রমজীবীরও চরম দুর্দিন নেমে এসেছে। বহু ক্ষেতমজুর মহাজনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ শোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে। অনেকের ঘরে খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। হাওরে আসা উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার দাওয়াল ও হাওরের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত কয়েক দিনে ভৈরব, কুলিয়ারচর, বাজিতপুর ও করিমগঞ্জের চামড়া বন্দরসহ হাওরের বিভিন্ন প্রবেশদ্বারে ঘুরে দেখা গেছে, দাওয়াল ও গাড়িয়ালরা হাওর থেকে ফিরে যাচ্ছে। চামড়া বন্দরে দেখা মেলে ফিরতি একদল দাওয়ালের। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের কুমারুলি গ্রামের সিরাজুল ইসলাম, শাহজাহান মিয়া, দত্তগ্রামের মনিরুদ্দিন ও হারুন রশিদ জানান, ৫ এপিল তারা হাওরে আসেন। পানির নিচ থেকে কয়েক দিন ধান কেটেছেন। পরে ভয়ে আর কাটেননি। একে একে সব হাওরের ফসল তলিয়ে যাওয়ায় প্রায় খালি হাতেই তাঁরা ফিরে যাচ্ছেন। অথচ অন্যান্য বছর তাঁরা একেকজন ধান কাটার বিনিময়ে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার ধান পেয়েছেন। এবার তা জনপ্রতি হাজার তিনেক টাকার বেশি পাননি।
জামালপুরের মেলান্দহ ও ইসলামপুরের ২১ জন ক্ষেতমজুরের একটি দল এসেছিল হুমাইপুর হাওরে। ছয়-সাত দিন আগে এ দলটি হাওরে আসে। সব জমির ফসল পানির নিচে চলে যাওয়ায় তারা ধান কাটার কাজ করতে পারেনি। বিষণ্ন মনে অষ্টগ্রাম-বাজিতপুর ডুবোসড়কে বসেছিল তারা। ‘কেমন আছেন?’ জানতে চাইলে চরখারলিয়া গ্রামের আবুল হোসেন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘গেরস্তেরও মার, আঙ্গরও (আমাদের) মার!’ ইসলামপুরের কাজলারচরের জব্দালি হোসেন জানান, প্রতিবছরই তাঁরা ২০-২২ দিন ধান কাটার সুযোগ পেতেন। তাতে মাথাপিছু পেতেন ১০-১২ হাজার টাকার ধান। তাতে সংসারের কয়েক মাসের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যেত। এবার এই ফসলডুবি তাঁদেরও বিপাকে ফেলে দিয়েছে।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রায় ২৫ জন কৃষিশ্রমিক প্রতি একদিনে এক হেক্টর জমির ধান কাটকে সক্ষম। ধানকাটার মূল মৌসুম ১৫-১৬ দিন। ২৫ জন শ্রমিক মিলে প্রতি মৌসুমে কাটতে পারে প্রায় ১৫-১৬ হেক্টর জমির ফসল। সে হিসাবে হাওরাঞ্চলে আবাদ করা ৯ লাখ ৩০ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমির ধান কাটতে মোট ১৪ লাখ ৫৪ হাজার ৬৭ জন ক্ষেতমজুরের প্রয়োজন।
এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, এসব শ্রমিকের মধ্যে স্থানীয় কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা হবে ৫০ ভাগ। সে হিসাবে বাইরের বিভিন্ন এলাকার সাত লাখের বেশি ক্ষেতমজুর বা দাওয়াল প্রতি বছর হাওরে ধান কাটতে আসে। এবার হাওরে ফসলহানিতে স্থানীয় কৃষক-ক্ষেতমজুরদের পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের শ্রমিকরাও সীমাহীন ক্ষতির শিকার হয়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলা খামারবাড়ীর উপপরিচালক জাহেদুল হক এ ধারণার সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, বাইরে থেকে ধান কাটা শ্রমিক এবার সেভাবে হাওরে আসেনি। একই বক্তব্য পাওয়া যায় কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলেও। তিনিও স্বীকার করেন, অন্যান্যবারের মতো বাইরের শ্রমিকরা এবার হাওরে আসেনি। কিছু লোক এসে ফেরত চলে গেছে। তাঁর মতে, উজানের দাওয়ালসহ কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত সবাই এবার সীমাহীন ক্ষতির শিকার হয়েছে।
নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার একদল দাওয়ালের সঙ্গে এই প্রতিবেদকর কথা হয়। তালুকগুলনা গ্রামের খাতেমউদ্দিন, ছেদমিরগঞ্জের আমির আলী, চেংমারির জয়নাল আবেদীন, ইয়াজুল হক, তৌহিদুল ইসলাম, খারিজাগুলনার মোবারক হোসেন প্রমুখ কালের কণ্ঠকে জানান, নিজের এলাকায় কৃষি কাজই করেন তাঁরা। এ সময় কাজ না থাকায় প্রতি বছরই হাওরে আসেন। এবার এখানেও কাজ নেই। তাই খালি হাতেই ফিরে যাচ্ছেন।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের কামদিয়ার দাওয়াল রফিকুল ইসলাম ও তেঘরা গ্রামের মো. সুলতান, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের পাটাদহপাড়ার আবুল কালাম ও জংশের আলী জানান, ঋণ করে তাঁরা চাল-ডাল কিনে বাড়িতে দিয়ে এসেছেন। কিন্তু তাঁদের হাত খালি। কয়েক দিন ধান কেটে সামান্য যে কটা টাকা পেয়েছেন, তাতে ঋণই শোধ করা সম্ভব হবে না। সংসারের খরচ চালানো তো দূরের কথা।
গাজীপুরের ভাওয়ালের সিরাজ মিয়াসহ ১২ জন মহিষের গাড়ি নিয়ে হাওরে ধান টানতে এসেছেন। সিরাজ মিয়া জানান, ২৭ বছর ধরে তিনি হাওরে ধান পরিবহনের কাজ করছেন। অন্যান্য বছর একেকজন গাড়িওয়ালা ৭০ থেকে ৮০ হাজার ভাড়া পেয়েছেন। এবার গভীর হাওরের ধান তলিয়ে যাওয়ায় হাওরের উজানে ধান টানছেন। তিনি জানান, বছর ভালো গেলে কেবল তাঁর অঞ্চলের পাঁচ-ছয় শ গাড়িই ধান টানতে হাওরে যেত। এবার কিশোরগঞ্জের হাওরের উজান এলাকায় ভাওয়াল ও গাজীপুরের কালিয়াকৈরের কয়েক শ মহিষের গাড়ি এলেও এক-তৃতীয়াংশ মজুরিও পাবে না।
কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা ইটনার প্রত্যন্ত গ্রাম বর্শিকুড়ার কৃষক বাহারউদ্দিন ভূঁইয়া জানান, বর্শিকুড়া, সিমলাসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের ধান কাটতে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নীলফামারী, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতি বছর চার-পাঁচ হাজার দাওয়াল আসে। এবার অধিকাংশ দাওয়ালই হাওরে আসেনি।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/05/01/492743