১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ১০:০২

পরকীয়া বিবাদ বনাম ছাত্রলীগ

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

ঘটনা ঘটলো আরো দু’দিন পর। তার আগে থেকেই বিষয় হিসেবে ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ি নিয়ে লেখার কথা ভাবছিলাম। অনেক কাল ধরেই লক্ষ্য করছি, যাকে পছন্দ না তাকে ধরে পিটুনি দেয় ছাত্রলীগ, হাত-পা ভেঙে দেয়। তারপর মুমূর্ষু ব্যক্তিকে কখনো রিক্সায় বা অন্য কোনো বাহনে করে থানায় নিয়ে যায়। গিয়ে বলে এরা জামাত-শিবির। আমরা ধোলাই দিয়ে দিয়েছি। বাকী ব্যবস্থা পুলিশ করুক। পুলিশও যেনো এই ‘জামায়াত-শিবির করা’ লোকদের জন্য থানায় বসে অপেক্ষা করে। কখনো কখনো আর এক দফা পিটায়। পারলে তাদের জিম্মি করে টাকা আদায় করে। এরকম অভিযোগও বিস্তর।

আমি ছাত্রলীগের এই আচরণের প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম। আমরা দেখেছি ছাত্রলীগের পান্ডারা কী ভিত্তিতে কাউকে জামায়াত-শিবির বলে আখ্যায়িত করে এবং পিটিয়ে তাদের লাশ বানায়। কিন্তু কোন বিবেচনায় কেউ জামায়াত-শিবির করলেই ছাত্রলীগ তাকে পিটিয়ে লাশ বানিয়ে ফেলবে? সে অধিকার তারা কোথায় পেল। তাছাড়া জামায়াত-শিবির কোনো নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠন নয়। সুনির্দিষ্ট আদার্শের উপর ভিত্তি করে তারা তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করে। সেখানে ইসলাম তাদের আদর্শ এবং সে আদর্শ নিয়েই তারা রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করে। কেউ ইসলাম ধর্ম পালন করলে তাকে ‘রাজাকার’, পাকিস্তানের চর’ বলে অভিহিত করা হয়। সরকারের উচ্ছিষ্টভোগী ব্যক্তিরা ধর্ম নিয়ে কখনো কখনো চরম বাড়াবাড়ি করে। এদের একজন রাশেদ খান মেনন। তিনি একবার বলেছিলেন নামাজির সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। যারা এভাবে মসজিদে আসছে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু মন্ত্রিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মেনন এবং হাসানুল হক ইনু হজ্জ করতে গিয়েছিলেন। সেখানে মিনায় এহরাম পরে পানির বোতল হাতে এই দুই ইসলাম বিরোধী রাজনীতিক মেনন-ইনু বসেছিলেন। সে ছবি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো। সে বিবেচনায় এই দুই ব্যক্তি রাজনৈতিক ভন্ড। এরা রাজনীতিক। কিন্তু কোনো দিন ছাত্রলীগের ঐসব অপকর্মের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি।

এদিকে পুলিশের সংবিধান বিরোধী ও আইন-শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজে সরকারও উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। জামায়াত-শিবির বলে যে তরুণদের পিটুনী দিয়ে ধরে ছাত্রলীগ পুলিশের তো তাদের থানায় আটক করে ব্যবস্থা নেয়া দরকার ছিলো। কিন্তু পুলিশ কখনো সে পথে হাঁটেনি। এসব শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবির বলে ধরে এনে পিটুনি দেয়া গর্হিত অপরাধ। সাধারণত দেখা যায় ছাত্রলীগের মিছিলে না গেলেই তাদেরকে ধরে এনে ‘গণরুমে’ নিয়ে জামায়াত-শিবির বলে পিটুনি দেয় ছাত্রলীগ।

কিন্তু শিক্ষার্থীরা এর যদি কোনো প্রতিকার না পায় তাহলে নিশ্চয়ই তারা এক সময় প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। সেটা সমাজে এক ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। আমরা দেখেছি সাধারণ মানুষের উপর ছাত্রলীগ ও পুলিশ মিলে পৈশাচিক নির্যাতন চালায়। কিন্তু ধর্মের ঢাক চিরদিন চাপা থাকে না। এক সময় তা আপনিই বেজে উঠে।

তার একটা জলজ্যান্ত উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে সম্প্রতি ছাত্রলীগ ও পুলিশের মধ্যকার সংঘর্ষ ও মারামারি ঘটনার মধ্য দিয়ে। ৩৩তম বিসিএস ক্যাডারের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক। তার স্ত্রীও পুলিশ ক্যাডারে এডিসি। তিনি রমনা জোনের কুখ্যাত এডিসি হারুন অর রশিদের সহকর্মী। সেই সূত্রে আজিজুল হকের স্ত্রী ও হারুন অর রশিদের মধ্যে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শনিবার রাতে আজিজুল হকের স্ত্রী ও হারুন অর রশিদ বারডেম হাসপাতালের চার তলায় আড্ডা দিচ্ছিলেন। সেখানে এসে হাজির হন আজিজুল হক। স্ত্রীকে নিয়ে আজিজুল হক ও হারুন অর রশিদের মধ্যে তীব্র বাকবিত-া হয়। হতে পারে আজিজুল হক ও হারুন হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে। এর আগেও স্ত্রীর পরকীয়া নিয়ে আজিজুল হক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ফল হয়নি।

সহকর্মী, রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মী, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে আলোচনায় পুলিশের এডিসি হারুন। প্রেসিডেন্টের (এপিএস আজিজ এ সময় ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতাকে (আনোয়ার হোসেন নাঈম ও শরীফ আহমেদ মুনিমকে) নিয়ে বারডেমে যান। সেখানে আজিজুল হক ও এডিসি হারুনের মধ্যে বাকবিত-া চলে। তখন পুলিশের এডিসি হারুন এক পর্যায়ে শাহবাগ থানায় ফোন করে দশ পনেরোজন পুলিশ ডেকে আনেন। তারা এসে ছাত্রলীগের এক নেতাকে থানায় ধরে নিয়ে যায়। পরে অন্য নেতা সেখানে যান। ছাত্রলীগ নেতারা অভিযোগ করেন যে থানায় ওসির কক্ষে নিয়ে তাদেরকে বেধড়ক পেটান হারুন ও তার সহযোগীরা। ছাত্রলীগের ঐ দুই শীর্ষ নেতাকে থানায় তুমুল পিটুনি দেয় এডিসি হারুন। এতে ছাত্রলীগ নেতা নাঈমের বেশ কয়েকটি দাঁতও ভেঙে যায়। তিনি তখন সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ছাত্রলীগ নেতাদের মেরে তাদের আহত অবস্থার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হলে ছাত্রলীগ নেতারা শাহবাগ থানায় ভিড় করেন। নাঈম বলেন, থানা হচ্ছে মানুষের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। কিন্তু সেখানে আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর করা হয়। এ নিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অদক্ষ নেতৃত্বকে দায়ী করেন তারা এবং এডিসি হারুনের চাকরিচ্যুতিও দাবি করা হয়। এই অপরাধে হারুনকে তিন দফায় ল্যাপ দিয়ে শেষ পর্যন্ত সাসপে- করা হয়।

থানায় হামলার শিকার ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন নাঈম বলেন, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ ছাড়া এর বিচার পাবো না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, হারুন যতটুকু অপরাধ করেছে সে অনুযায়ী বিচার হবে।

ধারণা করি ঘটনার এখানেই শেষ নয়। এই ঘটনা আরো নতুন নতুন ঘটনার জন্ম দেবে। সরকার পুলিশকে প্রশ্রয় দিতে দিতে এদেরকে ফ্রাংকেনস্টাইনের দানবে পরিণত করেছে? এখন দুই দানবের সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। এর পরিণতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে সেটা বলতে পারি না।

তবে আশ্চর্য ঘটনা এই, এই হামলার বিরুদ্ধে এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। তার কারণ খুব স্পষ্ট। সামনে নির্বাচন। তাতে বিরোধীদের ওপর হামলা চালাতে সরকারের এই দুই বাহিনীকেই দরকার। ফলে সরকার তাদের কোনো পক্ষকেই চটাতে চায় না। পুলিশের একটা তত্ত্ব আছে। কেউ তো অভিযোগ করেনি। কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। থানার মধ্যেই পিটিয়ে সারা শরীর থেতলে দিয়েছেন, রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে নাঈমের চারটি দাঁত ভেঙে দিয়েছেন। তিনি সেখানেই জ্ঞান হারালে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তারপরও অভিযোগ লাগবে? মামলা হবে না? এখানে সরকারের তরফে একটা ধামাচাপা দেয়ার প্রয়োজন আছে। লক্ষ্যণীয় যে, এই ঘটনায় জড়িতদের সকলেই বর্তমান ও সাবেক ছাত্রলীগ। এডিসি হারুনও ছাত্রলীগ করতে করতেই এই পর্যায়ে এসেছেন।

বসে বসে টেলিভিশনে প্রচারিত আলোচনাগুলো শুনলাম। সেখানে দেখলাম, কেউই বিশ্বাস করছে না যে, এই ঘটনায় পুলিশের কোনো শাস্তি হবে। এখন এক পুলিশ কনস্টেবলের নাম সামনে আনা হচ্ছে, সে নাকি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ হামলাকারী। অর্থাৎ হারুনকে দায়মুক্তি দেয়ার জন্য একটা বলির পাঁঠা সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। সাধারণ মানুষ মনে করছে, হারুন কিছুদিন চুপচাপ থাকবে এবং কিছুদিন পর তাকে আরও বড় দায়িত্বে পদায়ন করা হবে। বেঁচে থাকলে হয়তো সেটাও দেখে যাব।

সর্বশেষ : পুলিশ বলেছে, তদন্ত কমিটির রিপোর্টের জন্য অপেক্ষায় আছেন তারা। ডিবি প্রধান হারুনের বক্তব্য থেকে জানা গেল, ছাত্রলীগের নেতারাই নাকি আগে এডিসি হারুনের ওপর চড়াও হন। ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ, কিছু কি বুঝতে পারলেন।

https://www.dailysangram.info/post/535477