১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:৪৭

রেজ্যুলেশনের ওপর ভোট আজ

বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে ইইউ পার্লামেন্টে বিতর্ক

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিশেষত গুম-খুন এবং বিরোধী দল বা ভিন্নমত দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ, একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অনুষ্ঠানের যে দাবি উঠেছে তার পক্ষে-বিপক্ষে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে আলোচনা এবং বিতর্ক চলছে। বুধবার স্থানীয় সময় বিকাল ৫টা থেকে (বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা) পশ্চিমে ইউরোপের দেশ ফ্রান্সের গ্রঁতেস্ত অঞ্চলের রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর স্ট্রাসবার্গে (ফরাসি উচ্চারণে স্ত্রাসবুর) ওই বিতর্ক শুরু হয়। সেখানে বাংলাদেশ ছাড়াও আরও দুটি দেশ গুয়েতেমালা এবং আজারবাইজানের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং গণতন্ত্র নিয়ে বিতর্ক হওয়ার কথা রয়েছে।

ওই বিতর্ক পর্যবেক্ষণকারী এক কূটনীতিক জানিয়েছেন, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যালয় স্ট্রাসবার্গে অনুষ্ঠেয় প্লেনারি সেশনে ‘রেজ্যুলেশন অব হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ শিরোনামে ৩ দেশের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সেখানে বিশেষত অধিকারের কেসটি আলোচনায় আসবে। জরুরি ওই বিতর্কটি বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার ভোরে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নের সুপারিশ সংবলিত যে রেজ্যুলেশন আনা হয়েছে তার ওপর আজ ভোটাভুটি হবে। কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, ‘হিউম্যান রাইটস সিচুয়েশন ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট ও কমিশনের রুল ১৪৪-এর আলোকে ওই আলোচনা এবং বিতর্ক হচ্ছে। যেখানে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন, আইনের শাসনের ঘাটতি, এলিট ফোর্স র‍্যাব ও ডিবি পরিচয়ে রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং সাধারণের হয়রানি, গুম-খুনের বিষয়টি আলোচনায় আসছে।

উল্লেখ্য, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিয়ে প্রায়শই আলোচনা, বিতর্ক তথা প্রস্তাব আসে। এসব রেজ্যুলেশন নন-বাইডিং হলেও তা রেফারেন্স হিসেবে থেকে যায়, যা সংশ্লিষ্ট দেশের রাজনীতিতে বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক চাপে বাড়তি মাত্রা যুক্ত করে। স্মরণ করা যায়, ২০১৪ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর থেকে নিয়মিত বিরতিতে (দফায় দফায়) ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।

চলমান রাজনৈতিক সংকটের দ্রুত অবসান এবং একটি বিশ্বাসযোগ্য, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিতে শর্তহীন সংলাপের আয়োজন করতে সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে ইউরোপের ২৭ রাষ্ট্রের জোট ইইউ’র রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং তাদের আইন প্রণেতারা। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সংসদ ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে উত্থাপিত রেজ্যুলেশনে আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচন যাতে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে হয় সেই আহ্বান এবং সুপারিশ করা হয়েছে। প্রস্তাবটি পাস হলে বাংলাদেশের সংকট সমাধানের পথ সুগম হবে বলে আশা করছে রেজ্যুলেশন উত্থাপনের সহায়ক হিসেবে কাজ করা বাংলাদেশিরা।
এ বিষয়ে বিএনপি’র আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক ড. শাকিরুল ইসলাম খান শাকিল এক বার্তায় জানান ইইউ পার্লামেন্টে বিভিন্ন গ্রুপ প্রস্তাব জমা দিয়েছে। যাতে বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন, আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও আসন্ন নির্বাচনকে দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য করার বিষয়ে বিভিন্ন সুপারিশ রয়েছে। এ বিষয়ে বেলজিয়াম বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আলম হোসেন মানবজমিনকে ইইউ পার্লামেন্টে উত্থাপিত একটি প্রস্তাবে গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার অবনতিশীল অবস্থা সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ এবং সরকারকে অবিলম্বে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে। এদিকে গত জুনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ৬ সদস্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলকে একটি চিঠি লিখেন। এতে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ, চলমান সংকটের টেকসই ও গণতান্ত্রিক সমাধানের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আলোচনার কথা বলা হয়। চিঠিদাতারা হলেন- ইভান স্টিফেনেক (স্লোভাকিয়া), মিকেইলা সিজদ্রোভা (চেক প্রজাতন্ত্র), অ্যান্দ্রে কোভাচভ (বুলগেরিয়া), কারেন মেলচিয়র (ডেনমার্ক), হ্যাভিয়ের নারত (স্পেন) ও হেইডি হাউতালা (ফিনল্যান্ড)। ইইউ সদস্যরা চিঠিতে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বেগ জানান। সেই সঙ্গে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।

চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছে। তারা নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করছে এবং সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে। ক্ষমতা সংহত করার জন্য সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের, নির্যাতন, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে। হেফাজতে নির্যাতনসহ অন্যান্য খারাপ আচরণের অভিযোগও আগের মতোই রয়েছে। প্রায়ই এসব ঘটনায় বাংলাদেশ র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) নাম আসছে। এই নির্যাতন শুধু রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপরই সীমাবদ্ধ নয়, তা নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরও ঘটছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সমপ্রদায়ও রয়েছে। বাংলাদেশের দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে জালিয়াতি, কারচুপির ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে ইইউ পার্লামেন্ট মেম্বাররা বলেন, বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কার্যকর কোনো পদ্ধতি এখন নেই, যাতে জনগণ তাদের পছন্দের প্রতিনিধি বাছাইয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। এ প্রেক্ষাপটে দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে চিঠিতে ইইউ পার্লামেন্ট সদস্যরা বলেন, ‘আমরা মনে করি, বাংলাদেশ ব্যবসা ও উন্নয়ন সহযোগিতার ক্ষেত্রে আমাদের দীর্ঘদিনের অংশীদার হওয়ার কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জোরালো কারণ রয়েছে। বাংলাদেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অবাধ, সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিতের লক্ষ্যে ভূমিকা রাখার জন্য জোসেপ বোরেলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন, এ জন্য বিএনপি’র চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং চলমান সংকটের টেকসই ও গণতান্ত্রিক সমাধানের জন্য বিএনপিসহ অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আলোচনা জরুরি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকারের বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শুধু ধারাবাহিক আলোচনা চালিয়ে যাওয়াই নয়, দৃশ্যমান অগ্রগতিও হতে হবে। এ ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ইউরোপীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ইইএ) প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ অথবা বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস সুবিধা দেয়া হবে কিনা, সে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এসব শর্ত আরোপ ও মনে করিয়ে দেয়ার মতো পদক্ষেপ নেয়া যায়।

https://mzamin.com/news.php?news=73991