১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:৪৭

ইলিশের চড়া দামের নেপথ্যে

শিকার ও পরিবহণে অস্বাভাবিক ব্যয়

আছে মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপট

প্রকৃতির অপার দান হলেও শিকার থেকে শুরু করে বাজারজাত পর্যন্ত ব্যয় বৃদ্ধির কারণেই বাড়ছে ইলিশের দাম। এর সঙ্গে মধ্যস্বত্বভোগীদের লাভের অঙ্ক যোগ হয়ে তা চলে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। দাম কেন আকাশছোঁয়া জানতে চাইলে এভাবেই ব্যাখ্যা দেন এই খাত সংশ্লিষ্টরা। পরিস্থিতি এমন যে গরিব তো দূর থাক মধ্যবিত্তের পাতেও এখন আর জুটছে না ইলিশ। বুধবার বরিশালের পাইকারি বাজারে এক কেজি সাইজের ইলিশ বিক্রি হয় ৬০ হাজার টাকা মন দরে। ৪২ কেজিতে মন হিসাবে প্রতি কেজির দাম পড়ে প্রায় সাড়ে ১৪শ টাকা। খুচরা বাজারে গিয়ে যা বিক্রি হয় ১৬ থেকে ১৮শ টাকা। যে কারণে জাতীয় এই মাছ এখন শুধু বিত্তশালীদের খাদ্যে পরিণত হয়েছে।

গেল বছরও কেজি আকারের ইলিশের দাম ছিল প্রতি মন ৪২ থেকে ৪৫ হাজার। এ বছর সেই দাম দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজারে। কেন অত্যধিক দাম বৃদ্ধি- জানতে চাইলে বরগুনা জেলা মৎস্য ট্রলার মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘এটা ঠিক যে ইলিশ প্রকৃতির দান। সেই দান ঘরে তুলতে ঘাটে ঘাটে যে খরচ সেটা ইলিশ বেচেই তুলতে হয়। সবাই ইলিশের দাম নিয়ে অভিযোগ করছেন, ভেতরের বিষয়গুলো তো কেউ খতিয়ে দেখছেন না। মোটামুটি আকারের একটি মাছ ধরা ট্রলার বানাতে খরচ হয় ৩৫-৪০ লাখ টাকা। ১৪-১৫ জন মাঝি মাল্লা নিয়ে এই ট্রলার সাগরে মাছ ধরতে গেলে তেল-মবিল আর ৮-১০ দিনের বাজার মিলিয়ে আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকা খরচ হয় মালিকের। সেই সঙ্গে যোগ হয় দাদন বাবদ মাঝি মাল্লাদের নেওয়া ৩ লাখ টাকা। আর সব ট্রিপে যে মাছ মেলে তাও কিন্তু নয়। অনেক সময় ফিরতে হয় শূন্য হাতে। তখন পুরো টাকাটাই লোকসান।’

বরিশাল ইলিশ মোকামের আড়তদার জহির সিকদার বলেন, ‘আগে ডিজেল কিনতাম ৬০ টাকা দরে। এখন তা ১০৯ টাকা। একই হারে বেড়েছে মবিলের দাম। চাল-ডালসহ অন্যসব পণ্যের দামও বাড়তি। যে কারণে আগের তুলনায় বেড়েছে সাগরে ট্রলার পাঠানোর খরচ। ৩ লাখ টাকা খরচ করে একটি ট্রলার সাগরে গিয়ে যদি ২০ মন ইলিশ পায় তাহলে কত টাকায় বিক্রি করলে খরচ উঠবে? ধরা পড়া সব ইলিশ তো আর কেজি সাইজের হয় না। ৩-৪শ গ্রাম ওজনের ইলিশও ওঠে জালে। ৩০-৪০ লাখ টাকায় ট্রলার বানিয়ে, প্রতি ট্রিপে ৩ লাখ টাকা বাজার খরচ আর জেলেদের দেওয়া দাদনের টাকার সঙ্গে মিলিয়ে হিসাব করুন যে ইলিশের দাম তুলনামূলকভাবে কম না বেশি।’
আলীপুর ইলিশ মোকামের ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে ইলিশ বাজারে। সাগরে মাছ ধরতে গেলে বরফ নিতে হয়। প্রতি মন ইলিশে লাগে দেড়শ টাকা দামের এক ক্যান বরফ। বাইরে পাঠানোর ক্ষেত্রে আবারও বরফ দিয়েই পাঠাতে হয় তা। তেলের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে পরিবহণ সেক্টরেও। আগে যেখানে ঢাকায় এক ট্রাক ইলিশ পাঠাতে খরচ হতো ১৮-২০ হাজার সেখানে এখন ৩০ হাজার টাকায়ও পাঠানো যায় না। দাম বেড়েছে মাছ প্যাকিংয়ের বাক্স, হোগলাসহ অন্যান্য উপকরণের। এসব ব্যয় হ্রাস পেলে কমবে ইলিশের দাম।’ বরিশাল মোকামের ব্যবসায়ী গোপাল চন্দ্র সাহা বলেন, ‘নিজেরাও এখন ইলিশ খেতে পারি না। একটা ইলিশের দামে যখন দুজন লেবারের মজুরি হয় তখন খাওয়ার সাহস থাকে না। আড়তের ভাড়া দিতে হয়। দুজন সরকার (ম্যানেজার), লোড-আনলোডের লেবার মিলিয়ে বিশাল খরচ। ইলিশের দাম যে সাধারণের নাগালের বাইরে আমরাও বুঝি। কিন্তু কী করব, আমাদেরও তো বাঁচতে হবে। সবাই ইলিশের দাম নিয়ে ক্ষুব্ধ। ২-৩ বছর আগেও কম দামে ইলিশ বেচে বেশি লাভ নিয়ে ফিরেছি। এখন সমান সমান থাকতেই কষ্ট।’

মোকামের একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, ‘ব্যয় বৃদ্ধি সত্ত্বেও আরও খানিকটা কমে বেচা যেত ইলিশ। কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপটে সম্ভব হয় না। নদ-নদীতে যারা ইলিশ ধরেন তারা সারা দিনে পান ৮-১০টি ইলিশ। এই ইলিশ নদীতেই কিনে আড়তে এনে বিক্রি করে একটি পক্ষ। এই মধ্যস্বত্বেও বাড়ে ইলিশের দাম। সাগর বা নদী থেকে আনা ইলিশ আড়তে বিক্রির ক্ষেত্রে সাধারণ খরচ দেখিয়ে মনপ্রতি ৪শ টাকা নেয় আড়ত মালিকরা। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য আড়তে মাছ গেলেও একই নিয়ম। এভাবে প্রতি মনে বাড়ে আরও ৮শ টাকা। এর সঙ্গে আছে আড়তের লাভ। সব মিলিয়ে আকাশে ওঠে ইলিশের দাম।’

বরিশাল মৎস্য আড়তদার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নিরব হোসেন টুটুল বলেন, ‘এটা তো পুরোপুরি অনিশ্চয়তার ব্যবসা। মাছ না পেলেই লোকসান। তার ওপর ঝড়ে ট্রলার ডোবার শঙ্কা। জ্যৈষ্ঠ থেকে ৩০ আশ্বিন পর্যন্ত ভরা মৌসুম ইলিশের। সাগরে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মৌসুমও এটাই। এর মধ্যে প্রজনন মৌসুম আর মা-ইলিশ নিধনে নিষেধাজ্ঞা মিলিয়ে ৮৭ দিন বন্ধ থাকে মাছ ধরা। বাকি ৬৩ দিনে ৪-৫ বার সাগরে যেতে পারে একটি ট্রলার। এই ৪-৫ বারে কতটুকু মাছ মেলে আর তাতে লাভ-লোকসান কতটুকু আপনিই বলুন? আমাদের ঋণ দেয় না কোনো ব্যাংক। ট্রলার কিংবা জালের ইন্স্যুরেন্সও করে না। বিনিয়োগের পুরো টাকা যেমন পকেটের, তেমনি বিপদে মেলে না ক্ষতিপূরণ। বলতে পারেন অন্য মাছ ধরে আয় করার কথা কিন্তু এসব ছোট ট্রলারের মূল আয় ওই ইলিশই। যে কারণে ইলিশের দিকেই তাকিয়ে থাকে সবাই।’

মৎস্যবিজ্ঞানী ও ইলিশ গবেষক আনিসুর রহমান বলেন, ‘ইলিশে বাংলাদেশ বিশ্বখ্যাত হলেও এদিকে সরকারের নজর কিন্তু খুব বেশি না। ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে বছরজুড়ে মাছ ধরায় নানা নিষেধাজ্ঞা আর জেলেদের বিনা পয়সায় চাল দিলেই তো শেষ হয়ে যায় না। এই যে জেলেরা ট্রলার বানায়, জাল কেনে এজন্য তাদেরকে কোনো রকম ঋণ সুবিধা দেয় না কোনো ব্যাংক। ট্রলার-জালেও হয় না ইন্স্যুরেন্সও। বাংলাদেশে এটিই মনে হয় একমাত্র খাত যারা উল্লেখ করার মতো কোনো সুবিধা না পেয়েও টিকে আছে। এখানে সরকারের উচিত সহজ শর্তে ঋণ আর ঝুঁকি মোকাবিলার ব্যবস্থা করা। তাছাড়া এই খাতে যদি কিছু ভর্তুকির ব্যবস্থা করা যায় তাহলে হয়তো মূল্য নির্ধারণ কিংবা ইলিশের দাম কমার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। আসলে বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এটা ঠিক যে সব ব্যবসাতেই ঝুঁকি আছে, কিন্তু সাগরে মাছ ধরার মতো এতো ঝুঁকি আর কোনো ক্ষেত্রে নেই। সরকারের উচিত হবে এই খাতকে সহায়তার পথ উদ্ভাবন করে জেলেদের পাশে দাঁড়ানো। কেবল তাহলেই ইলিশের দাম কমাসহ সাধারণের নাগালে আসবে ইলিশ।’

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/717721