১ মে ২০১৭, সোমবার, ৮:০৭

চলনবিলে কৃষকের কান্না

পানিতে ডুবে গেছে ফসল, বাড়তি মজুরি দিয়েও শ্রমিক মিলছে না

চলনবিলকে বলা হয় শস্যভাণ্ডার। আত্রাই ও গুড় নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে দেশের সবচেয়ে বড় এ বিল। ডুবে গেছে বোরো ধান, আলু, বাদাম, ভুট্টা, পাট, তরমুজ, করলাসহ অন্যান্য ফসল। ধান কাটার জন্য মাইকিং করে শ্রমিক ডাকা হচ্ছে। বাড়তি মজুরি দিয়েও শ্রমিক মিলছে না।

নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, নলডাঙ্গা, নিয়ামতপুর, চন্দননগর, ভাবিচা, শ্রীমন্তপুর, বাহাদুরপুরে কয়েক হাজার হেক্টর জমি থেকে কোনো ফসল তোলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এসব এলাকার ছোটবড় সব চাষি বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন বলেন, অসময়ে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে এসেছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের জন্য তালিকা তৈরি করতে কৃষি অধিদফতরের উপ-পরিচালককে চিঠি দেওয়া হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কর্মকর্তাকেও চিঠি দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, সিংড়া এলাকায় আত্রাই নদীর কাছে বিলদহর-কৃষ্ণনগর এলাকায় বাঁধ আছে। নিজেদের সুবিধার জন্য স্থানীয় মত্স্যজীবীরা ২০১১ সালে বাঁধের একটি অংশ কেটে দেন। বাঁধের এ কাটা অংশ দিয়ে আত্রাই নদী থেকে প্রচণ্ড স্রোতে চলনবিলে পানি ঢুকছে।

পানিতে ডুবে যাওয়া অন্যান্য ফসল ঘরে তুলতে না পারলেও জরুরিভাবে ধান কাটতে কয়েক দিন ধরেই স্থানীয়ভাবে মাইকিং করে দিনমজুর ডাকা হচ্ছে। বিলদহর বাজার এলাকার কৃষক কাদের মণ্ডল জানান, তার চাষ করা ৪৫ বিঘা জমির সবই পানিতে ডুবে গেছে। ধান কাটার জন্য তিনি দিনমজুর পাচ্ছেন না। অন্যান্য মৌসুমে ২৫০ টাকা চুক্তিতে শ্রমিক পাওয়া গেলেও এবার ৭০০ টাকা দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না।

স্থানীয়রা জানান, পানিতে ডুব দিয়ে ধান কাটা খুব কষ্টের। শ্রমিকরা সারা দিন পানিতে ডুবে ধান কাটতে চাচ্ছেন না। ফলে বেশি মজুরি দিয়েও শ্রমিক মিলছে না। কৃষ্ণনগর গ্রামের একাধিক কৃষক জানান, চলনবিলের অধিকাংশ কৃষক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করেন। হঠাত্ ঢলের পানিতে ফসল ডুবে যাওয়ায় এখন কীভাবে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করবেন, সেই চিন্তায় তাদের ঘুম চলে গেছে।

বড়াইগ্রাম উপজেলায় জালোরা বিল, চিনিডাঙ্গা বিল, ভিটাকাজীপুর বিল ও কচুগাড়ি বিল, মাড়িয়া, বাজিতপুর, শ্রীরামপুরসহ বিভিন্ন নিম্নাঞ্চলে বৃষ্টির পানিতে ফসল ডুবে গেছে। এতে বড়াইগ্রামের সহস্রাধিক কৃষক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, বড়াইগ্রামে ধানের তেমন ক্ষতি না হলেও পাট, তরমুজ, করলা, ভুট্টার জমি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করলা এবং পাটক্ষেত প্রায় সবটাই পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেক জায়গায় কাঁচা-পাকা তরমুজ পানিতে ভাসতে দেখা গেছে।

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, চলনবিল অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও উল্লাপাড়ায় গত কয়েকদিনের টানা ভারী বর্ষণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টি আর বাতাসে ধানের গাছ মাটি আর পানিতে পড়ে একাকার হয়ে গেছে। ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কায় হতাশ হয়ে পড়েছে কৃষকরা।

কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, তাড়াশে এ বছর ইরি বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২২ হাজার ৩শ ২০ হেক্টর। উল্লাপাড়াতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ৬ হাজার হেক্টর। সারা বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সোনালি ধানে ছেয়ে গিয়েছিল ফসলের মাঠ। আর সামান্য কয়েকদিন পর ফসল ঘরে তোলার আশায় বুক বেঁধেছিল চলনবিলের কৃষকেরা। তবে কৃষকের এই আশায় গুড়ে বালি হয়েছে ভারী বৃষ্টি ও ঝড়।

তাড়াশ ও উল্লাপাড়ায় একাধিক কৃষক জানান, আর মাত্র তিন চার দিন পরেই ফসল কাটতে চেয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টি ও বাতাসের কারণে ধান গাছ পানিতে ডুবে গেছে। সময়মতো ধান কাটতে না পারায় প্রতি বিঘায় ৫ থেকে ৬ মণ ধান কম হবে। এতে তারা এ বছর বড় আকারের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

তাড়াশ উপজেলা কৃষি অফিসার মো. সাইফুল ইসলাম জানান, কয়েক দিনের ভারী বর্ষণে চলনবিল এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছিল। এতে বিভিন্ন এলাকার ফসল পানিতে তলিয়ে যায়। ইতোমধ্যে প্রশাসনের সহায়তায় অন্তত ২০টি খাল কেটে পানি বের করা হয়েছে। পাশাপাশি আবহাওয়ার উন্নতি হওয়ায় কিছুটা ক্ষতি হলেও কৃষকরা পুরোপুরি ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। এখন আর ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নেই।

উল্লাপাড়া কৃষি অফিসার মো. খিজির হোসেন প্রামাণিক জানান, তার এলাকায় কিছুটা জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলেও স্থানীয় প্রশাসন ও ইউপি চেয়ারম্যানদের সহযোগিতায় সেটা দূর করা হয়েছে।

 

http://www.ittefaq.com.bd/wholecountry/2017/05/01/112380.html