১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:২০

সুন্দরবনাঞ্চলের ইকোসিস্টেমে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে জাহাজডুবির ঘটনা

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: সুন্দরবনাঞ্চলে জাহাজডুবির ঘটনা ইকোসিস্টেমে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। ২০১৪ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৯ বার সুন্দরবনাঞ্চলে বড় ধরনের জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে। জাতিসংঘের জলাভূমিবিষয়ক সংস্থা ‘রামসা’ এবং উন্নয়ন সহযোগী ইউএনডিপিসহ বিশ্বের অনেক নামিদামি পরিবেশবাদী সংগঠন উদ্বেগ প্রকাশ করলেও সমস্যার সমাধান হয়নি আজ পর্যন্ত। সুন্দরবনের অভ্যন্তরের স্পর্শকাতর চ্যানেল দিয়ে এখনও কার্গো বা জাহাজ চলাচল করছে। ঘন কুয়াশার মধ্যে চলাচলরত এসব নৌযানের অধিকাংশেরই ফিটনেস নেই। এসব নৌযান ধারণ ক্ষমতার অধিক তেল ও মালামাল নিয়ে চলাচল করছে। এতে করে জাহাজডুবির কারণে নদ-নদীর পানি যেমন দূষিত হচ্ছে, অন্যদিকে ধ্বংস হচ্ছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। ফলে দুই বাংলার জন্য গর্বের ধন, এক রোমাঞ্চকর জঙ্গল সুন্দরবন হুমকীর মুখে পড়েছে। যে বনকে আশ্রয় করে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান। যেখান থেকে বছরে ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা সরকারের রাজস্ব আদায় হয়। এত সব প্রাপ্তির পরেও সুন্দবনের ওপর বিষফোঁড়ার আবির্ভাব থেমে থাকেনি। এমনকি ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে নৌরুট বন্ধ করার নির্দেশ দেন। ২০১২ সালের ২১ আগস্ট পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে নৌরুটটি বন্ধের আহ্বান জানায়। কিন্তু কেউ কারো কথা আমলে নেয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সুন্দরবনাঞ্চলে জাহাজডুবির ঘটনা ২০১৪ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৯ বার ঘটেছে। গত ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ সালে ‘শাহজালাল এক্সপ্রেস’ নামক একটি লাইটার জাহাজ মোংলা বন্দরের পশুর নদে ডুবে যায় ৫০০ টন সার নিয়ে। জাহাজটা ডুবে যাওয়ার ১১ দিন পর উদ্ধারকারী দল তল্লাশি চালিয়ে জানাল, জাহাজের খোলসে থাকা সার নদীর পানিতে মিশে গেছে, অবশিষ্ট নেই একটুও। ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ট্যাংকার সাউদার্ন স্টার সেভেন ডুবে সাড়ে ৩ লাখ লিটার জ্বালানি তেল ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র সুন্দরবন অববাহিকায়। সুন্দরবনসহ আশপাশের নদ-নদীর অন্তত ৫০০ কি.মি. এলাকা জুড়ে বিষাক্ত এই তেলের বিস্তার ছড়িয়ে পড়ে। বনবিভাগ প্রাথমিকভাবে ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণের মামলা করলেও ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায় বলে জানিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। সেই সময় সাময়িকভাবে সুন্দরবনের নৌপথ দিয়ে সকল প্রকার নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হলেও কিছুদিন পর ফের নৌ চলাচল চালু হয়। এর মাত্র ৫ মাস পরেই আবারো ২০১৫ সালের ৫ মে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের মরা ভোলা নদীর বিমলের চরে এমভি জাবালে নূর নামে একটি সারবাহী কার্গো ডুবে যায়। জাহাজটিতে প্রায় ৫শ’ মেট্রিক টন এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) সার ছিলো বলে জানিয়েছিলো বন বিভাগ। ২৭ অক্টোবর (মঙ্গলবার) রাত ৮টার দিকে সুন্দরবনের বিউটি মার্কেট এলাকার খাদ্য গুদামের সামনে পশুর নদীতে এমভি জিআর রাজ নামে একটি জাহাজ ডুবে যায়। মংলা বন্দরের হাড়বাড়িয়া-১ থেকে ৫১০ টন কয়লা নিয়ে যশোরের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল জলযানটি। এছাড়াও ২০১৮ সালে পশুর নদীর হারবাড়িয়া চ্যানেলে ৭৭৫ মেট্রিক টন কয়লা বোঝাই কার্গো ডুবে যায়। ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শরনখোলা রেঞ্জের ভোলা নদীতে ডুবতে ডুবতে অন্য কার্গোর সহায়তায় মোংলায় পৌঁছাতে সক্ষম হয় আরেকটি কয়লাবোঝাই কার্গো। ২০১৫ সালের ২৫ অক্টোবর পশুর নদীতে ৫১০ মেট্রিক টন কয়লাবাহী কার্গো ডুবে যায়। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীতে ১২৩৫ মেট্রিক টন কয়লাবাহী কার্গো ডুবে যায়। ২০১৭ সালের ৪ জুন হারবাড়িয়া চ্যানেলে ৮২৫ টন সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল বোঝাই কার্গো ডুবে যায়। এর আগে সুন্দরবনে ১৯৮৮ সালে দু’বার এবং ১৯৯৪ সালে সুন্দরবনে তেল দূষণের ঘটনা ঘটে। এ কারণে ২০০২ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সুন্দরবনে তেল দূষণে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে এবং এর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কিন্তু ওই প্রতিবেদনের আশঙ্কাকে আমলে নেয়নি কেউ।

অভিযোগ রয়েছে, এসব দুর্ঘটনার পর ধীর গতিতে দায়সারা উদ্ধার তৎপরতা চালায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এর কারণে বিষাক্ত ফার্নেস অয়েল, সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল (ফ্লাই অ্যাশ) ও সার সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালের পানিতে মিশে ছড়িয়ে পড়ে। এতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যসহ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে সেখানকার জলজ, বনজ উদ্ভিদ ও প্রাণী। বিশেষ করে ফার্নেস অয়েলে ডলফিনের অভয়ারণ্য হিসেবে নির্ধারিত স্থানে ডলফিনের জীবন হুমকির মুখে পড়ে। ফার্নেস অয়েলের কালো স্তর থেকে রক্ষা পায়নি বিখ্যাত সুন্দরী গাছের শ্বাসমূল, ভেসে আসা বীজ এমনকি স্থানীয় গৃহস্থের হাঁস-মুরগি পর্যন্ত।

কেউ কেউ বলছেন, ট্যাংকার ও জাহাজডুবির ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন ও মামলা করে দায় সেরেছে কর্তৃপক্ষ। কোনো শাস্তি বা কঠোরভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা না নেওয়ায় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। অভিযোগ উঠেছে, একটি পক্ষ চক্রান্ত করে সুন্দরবন ও মংলা বন্দরকে ধ্বংস করতে পরিকল্পিতভাবে এসব ফিটনেসবিহীন নৌযান ডুবাচ্ছে। সেই সাথে হাতিয়ে নিচ্ছে বীমার টাকা ও ফাঁকি দিচ্ছে ব্যাংকের লোন।

বিশেজ্ঞরা বলছেন, যেকোন নদীতে তেল, কয়লা, সিমেন্ট ও সারবাহী জাহাজ ডুবে গেলে তা পরিবেশ, প্রতিবেশ ব্যবস্থা, জীববৈচিত্র্য ও জলজ প্রাণির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। সুন্দরবন এলাকার ক্ষেত্রে এ ক্ষয়ক্ষতি অত্যন্ত মারাত্মক এবং যার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হয়।
দাবী উঠেছে নৌ মন্ত্রণালয়সহ নৌ পরিবহন অধিদপ্তর, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, বিআইডব্লিউটিএ, বন অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার। পরিবেশ দূষণ এবং ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণের লক্ষ্যে জাহাজ উদ্ধার হওয়া পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং অব্যাহত রাখা। তদন্ত দলে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা। জাহাজডুবি প্রতিরোধে নৌ মন্ত্রণালয়সহ নৌ পরিবহন অধিদপ্তর, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, বিআইডব্লিউটিএ, বন অধিদপ্তরের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

https://www.dailysangram.com/post/535385