১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৩:১৯

বিদ্যুৎ সেক্টরে অশনি সংকেত

ভর্তুকির টাকা না পাওয়ায় নিয়মিত বিল পরিশোধ করতে পারছে না সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র। একই অবস্থা বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রতেও। একারণে বিদ্যুৎ খাতেই আটকে গেছে তিন হাজার কোটি টাকার গ্যাস বিল। এদিকে বিল পরিশোধ না করা আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) কেন্দ্রগুলোকে গ্যাস সরবরাহ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গ্যাসের বকেয়া বিলের পরিমাণ কমছেই না। এই তালিকায় রয়েছে সরকারি- বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান, রয়েছে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রও। গ্যাসের বকেয়া বিল আদায়ে হিমশিম খাচ্ছে ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি।

দেশে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ২৭টি। এই সংখ্যক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৩ হাজার ৩৩৪ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। এদের মধ্যে ১১টি আইপি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে যারা গ্যাস ব্যবহার করে। এই ১১ বিদ্যুৎকেন্দ্র ২ হাজার ৫৯৭ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন। এছাড়া এসআইপিডি রয়েছে আরও ৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি দেশে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। আবার দেশের মধ্যে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকেও গ্যাস কিনে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করছে। কিন্তু বিল আদায় না হওয়ায় আমদানি করা তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম পরিশোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা। বিষয়টি এরইমধ্যে বেশ কয়েকবার জ্বালানি বিভাগকে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। আইপিপি ও পিডিবির বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাছ থেকে বিল আদায়ের জন্য কমিটি গঠন করা হলেও তা কাজে আশানুরূপ কাজে আসেনি। গ্যাস বিল আদায়ের জন্য বার বার নোটিশ করার পরেও কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বিল পরিশোধ না করা আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট) বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি জ্বালানি বিভাগের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি খাতে যে সংকট তৈরি হয়েছে তাতে গোটা বিশ্ব ভুগছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। বিদ্যুৎ খাতকে পর্যাপ্ত ভূর্তুকি দেওয়া যাচ্ছে না ফলে বকেয়া পরিশোধ করতে পারছে না। এ সংকট বেশিদিন থাকেব না।

বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প সংস্থা (বিসিআইসি) নিয়ন্ত্রণাধীন কেপিআই-১ মানসম্পন্ন যমুনা সার কারখানা প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে দৈনিক ১ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন ইউরিয়া উৎপাদন করে আসছিল। কয়েক বছর ধরে গ্যাসের চাপ স্বল্পতা ও মেশিনারিজ ত্রুটির জন্য উৎপাদন কমে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ মেট্রিক টনে নেমে আসে। এর মধ্যে প্রতিবছর দুএকবার কর্তৃপক্ষ গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করায় সার উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা জানান, ভর্তুকির অর্থ না পাওয়ায় নিয়মিত বিল পরিশোধ করতে পারছে না সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র। একই অবস্থা বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রতেও। ফলে বিদ্যুৎ খাতেই আটকে গেছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার গ্যাস বিল। এই পরিস্থিতিতে বিল পরিশোধ না করা আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) কেন্দ্রগুলোকে গ্যাস সরবরাহ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা কিস্তিতে গ্যাস বিল পরিশোধের সুযোগ চেয়েছিলেন। তাদের সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভালো গ্রাহকদের এ সুযোগ দিয়েছিলো সরকার। তবে সেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান এ সুযোগ পাবে, যারা করোনার আঘাত আসার আগে নিয়মিত গ্যাস বিল পরিশোধ করেছে। যারা আগে থেকেই বিল পরিশোধে অনিয়মিত বা বিল খেলাপি, তারা এ সুযোগ পাবে না। মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের মাসিক সমন্বয় সভায় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (টিজিটিডিসিএল) পক্ষ থেকে কিস্তিতে বিল পরিশোধের আবেদনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। প্রস্তাবটির বিষয়ে সভায় যে আলোচনা হয়, তার ভিত্তিতে এবং তিতাসের বোর্ড সভায় অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভালো গ্রাহকদের কিস্তিতে গ্যাস বিল পরিশোধের সুযোগ দেয়া হতে পারে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়ার পর ২৬ মার্চ থেকে গত ৩০ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। তখন রফতানিমুখী শিল্প খাত, ওষুধ শিল্প ও খাদ্যপণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য সব শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কার্যত বন্ধ ছিল। সেই সময় কোনো কোনো শিল্প-কারখানা চালু থাকলেও উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারেনি। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে গ্যাস বিল পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এ ধরনের বেশকিছু প্রতিষ্ঠান গ্যাস বিল কিস্তিতে পরিশোধ করার সুযোগ চেয়ে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে। গত মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সময়ের গ্যাস বিল ছয় মাস থেকে ১২ মাসের কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ তারা চেয়েছে বলে জানা গেছে।

গত ১০ জুন ডিজিটাল মাধ্যমে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের মাসিক সমন্বয় সভায় গ্রাহকদের আবেদনের বিষয়টি তুলে ধরেন তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এ-সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা গ্যাস বিপণন নিয়মাবলিতে না থাকায় বিষয়টি নিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌ. মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ ইনকিলাবকে বলেন, বেশ কয়েক বছরের চেয়ে তিতাসের বকেয়া অনেক কমেছে। তিতাস নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছে। তবে বিদ্যুৎ খাতের বিষয়টা ভিন্ন রকম। কারণ এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যহত হতে পারে। তারপরও বড় বড় বকেয়া বিল আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা সংযোগ বিচ্ছিন্নের মতোও সিদ্ধান্তও নিয়ে থাকি। বোর্ড সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

গত ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতে পিডিবি এবং আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) মিলিয়ে গ্যাস বিল বকেয়া পড়েছে দুই হাজার ৮৮৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এছাড়া বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) বিভিন্ন সার কারখানায় গ্যাস বিল বকেয়া পড়েছে ৮৯৮ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ দুই খাতেই ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির বিল বকেয়া পড়েছে তিন হাজার ৭৮৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা। দেশে মোট ছয়টি কোম্পানি গ্যাস বিতরণ করে থাকে। এরমধ্যে রয়েছে, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড এবং সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড। সবচেয়ে বেশি গ্যাস বিল বকেয়া পড়েছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের। কোম্পানিটি পিডিবি’র কাছে বকেয়া রয়েছে ৬০৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা আর আইপিপিগুলোর কাছে এই বকেয়ার পরিমান ৩৯৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, কমিটি বেশ কয়েকটি সভায় করা হয়েছে। কিন্তু তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। সবশেষ অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটি একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। সেখানে আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে নির্দিষ্ট সময় বেধে চিঠি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই চিঠিতে বলা হয়, কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র বিল পরিশোধ না করলে তাদের লাইন কেটে দেওয়া হবে।
তিতাস গ্যাস কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সেলিম মিয়া (অপারেশন) ইনকিলাবকে বলেন, তিতাস নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করার কারণে আগের চেয়ে তিতাসের বকেয়া অনেক কমেছে। তবে বিদ্যুৎ খাতের বিষয়টা ভিন্ন রকম। এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যহত হতে পারে। তারপরও বড় বড় বকেয়া বিল আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা সংযোগ বিচ্ছিন্নের মতোও সিদ্ধান্তও নিয়ে থাকি।

https://dailyinqilab.com/national/article/602176