১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ৬:১২

অবশেষে এডিসি হারুন সাসপেন্ড

- শুরু থেকে উচ্ছৃঙ্খল ও বেপরোয়া

ঢাকা মহানগর পুলিশের চরম উচ্ছৃঙ্খল ও অপ্রতিরোধ্য রমনা বিভাগের এডিসি হারুন অর রশীদকে সাময়িক বরখাস্ত (সাসপেন্ড) করা হয়েছে। দুই ছাত্রলীগ নেতাকে নির্মমভাবে নির্যাতনের বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর পরনারীতে আসক্ত এই পুলিশ কর্মকর্তাকে গত রোববার প্রথমে রমনা বিভাগ থেকে প্রত্যাহার করে এপিবিএনএ বদলি এবং একদিন পর গতকাল সোমবার তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, এডিসি হারুনকে নিয়ে শুরু থেকেই সরকার ও পুলিশ প্রশাসন বিব্রত। কিন্তু ছাত্রলীগের সাবেক এক সভাপতির বন্ধু হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নেয়া যাচ্ছিল না। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, চাকরির শুরু থেকেই এডিসি হারুন কোনো শৃঙ্খলা মানেননি। প্রতিনিয়ত চাকরিবিধি অমান্য করেও রয়ে গেছেন বহাল তবিয়তে। এমনকি, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গেছেন হারুনের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে। ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন হরহামেশাই। কথার আগেই গায়ে হাত তোলা যার ছিল অভ্যাস। পুলিশ, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, আইনজীবী, রাজনীতিক কেউই রেহাই পাননি তার হাত থেকে। নারীলিপ্সু এই কর্মকর্তার আচরণে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, এডিসি হারুন যতটুকু অন্যায় করেছেন, ততটুকু শাস্তি পাবেন। অপরাধের ছাড় দেয়া হবে না।

এডিসি হারুন গত ৯ সেপ্টেম্বর (শনিবার) রাতে এক নারী পুলিশ কর্মকর্তার সাথে বারডেম হাসপাতালের চারতলায় আড্ডা দিচ্ছিলেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের হাতে নাতে ধরেন ওই নারী পুলিশ কর্মকর্তার স্বামী সরকারি কর্মকর্তা (৩১তম বিসিএস) আজিজুল হক। এ সময় হারুনের সাথে আজিজুল হকের বাগি¦তণ্ডা হয়। আজিজুলের ফোন পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফজলুল হক হল ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাহবুবুর রহমান। এর একটু পর এডিসি হারুন শাহাবাগ থানার পুলিশ ডেকে এনে শরীফ আহমেদ ও মাহবুবুর রহমানকে (আনোয়ার হোসেন ছাড়া) আটক করে শাহবাগ থানায় নিয়ে যান। ওসির কক্ষে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে তাদের ওপর চালানো হয় মধ্যযুগীয় নির্মম নির্যাতন।

৯ সেপ্টেম্বর রাতের এ ঘটনাটি পুলিশের পক্ষ থেকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হলেও পরদিন তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গণ্যমাধ্যমে নিউজ হলে এবং ছাত্রলীগ নেতাদের ওপর নির্মম নির্যাতনের ছবি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে হারুনকে রমনা বিভাগ থেকে প্রত্যাহার করে পিওএম’এ সংযুক্ত করে। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ হেডকোয়ার্টার তাকে এপিবিএনে বদলি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। গতকাল সোমবার তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, শুরু থেকেই উচ্ছৃঙ্খল ছিলেন এডিসি হারুন। সহকর্মী পুলিশ সদস্য, সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনৈতিক নেতা এবং আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী কেউ বাদ যাননি তার নির্যাতনের হাত থেকে। পুলিশ কর্মকর্তা হারুনের এমন আক্রমণাত্মক ও উচ্ছৃঙ্খলতা অনেক জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাও পছন্দ করতেন না। পুলিশের ভেতরে তাকে নিয়ে বিভিন্ন সময় আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু কেউ ব্যবস্থা নেয়ার সাহস পাননি। কারণ হারুন ছাত্রলীগের সাবেক এক সভাপতির বন্ধু পরিচয় দিতেন। এমনকি ছাত্র জীবনে জিয়া হলে থাকাকালীন ওই ছাত্রনেতার দোহাই দিয়ে অনেক অপকর্ম করেছেন এই হারুন। নিজে সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত না থেকেও সব অবৈধ সুযোগ-সুবিধাই ভোগ করতেন হারুন। জিয়া হলের এক সাবেক ছাত্র জানিয়েছেন, হারুন হলে অনেকটা ভাব নিয়ে চলতেন বলে কেউ তাকে পাত্তাও দিতো না এবং অনেকে তার সাথে কথাও বলত না।

হারুনের অপকর্মের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে অবশ্যই এডিসি হারুনকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।’

ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব আজিজুল হক তার এলাকার বড় ভাই। তাদের বাড়ি গাজীপুরে। আজিজুল শনিবার সন্ধ্যায় ফোন করে তাকে ঢাকার শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে যেতে বলেন। রাত ৮টার দিকে আমি সেখানে যাই। পরে শুনি তিনি বারডেম জেনারেল হাসপাতালে আছেন। হাসপাতালের চারতলায় গিয়ে দেখি আজিজুল হক ও এডিসি হারুনের মধ্যে বাগি¦তণ্ডা হচ্ছে। আমিসহ ছাত্রলীগের আরো দুই নেতা মিলে তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করি।’

আনোয়ার হোসেন আরো বলেন, এডিসি হারুন ঘটনার একপর্যায়ে শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহ আলমকে ফোন করে হাসপাতালে ডেকে নেন। পুলিশ গিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাহবুবুর রহমানকে মারধর করে। পরে হাসপাতাল থেকে পুলিশ জোর করে আজিজুলসহ চারজনকে গাড়িতে থানায় নিয়ে যায়।

আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি ফোনে রমনা বিভাগের উপকমিশনারকে (মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন) মারধরের ঘটনাটি জানিয়ে শাহবাগ থানায় যাই। গিয়ে দেখি ওসি তদন্তের কক্ষে সবাইকে আটকে রেখে এডিসি হারুন এবং ওসি মারধর করছেন। মারধর করতে দেখে আবারো ডিসি রমনাকে ফোন দিতে চেষ্টা করতেই এডিসি হারুন ও অন্য পুলিশ আমাকে ধরে মাটিতে ফেলে মারধর শুরু করেন। হারুনসহ প্রায় ১০ থেকে ১৫ জন পুলিশ মুখে কিলঘুষি মেরে আমাকে নিচে ফেলে পা দিয়ে লাথি মারতে থাকেন। তাদের অস্ত্র ও লাঠির আঘাতে ছাত্রলীগের এক নেতার সামনের বেশ কয়েকটি দাঁত ভেঙে যায়। আমাদের অবস্থা খারাপ হলে হাসপাতালে পাঠায়।’
হারুনের যত অপকর্ম : চলতি বছরের ১৫ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচনের দিন পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকদের ওপর লাঠিচার্জ করে পুলিশ। অন্তত ২০ জন সংবাদকর্মীকে সেখানে আটকে পিটান হারুন ও সহযোগী পুলিশ সদস্যরা।
গত বছরের ৭ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে শাহবাগে একটি সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামি আবদুল্লাহ। পুলিশের লাঠিচার্জে তার মাথা ফেটে যায়। দিতে হয় ১৪টি সেলাই। ওই শিক্ষার্থী জানান, সেদিন ‘শান্তিপূর্ণ’ প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ব্যাপক লাঠিপেটা করে পুলিশ। তিনিসহ অন্তত ১২ জন আহত হন। এই পেটানোর নেতৃত্বে ছিলেন হারুন।
নিউমার্কেটে ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের সময় নিজের সহকর্মীকেই চড় মেরে সমালোচিত হন এডিসি হারুন। সেসময় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের দিকে রাবার বুলেট ছুড়তে এক কনস্টেবলকে নির্দেশ দেন তিনি। ‘বুলেট শেষ হয়ে গেছে’ বলায় ওই কনস্টেবলকে চড় মারেন তিনি।

শাহবাগের একটি আন্দোলন কর্মসূচিতে এডিসি হারুন নিজে লাঠি দিয়ে বিক্ষোভকারীদের পেটাচ্ছেন, এমন ভিডিও ফেসবুকে বেশ কয়েকবার ভাইরাল হয়। ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, বিক্ষোভকারী সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা সমাবেশ শেষে মিছিল নিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন। এমন সময় এডিসি হারুন অর রশিদ ও তার অন্য সহকর্মীরা বিক্ষোভকারীদের পেটাতে শুরু করেন। পেটানো শুরুর আগে হারুনের গায়ে জ্যাকেট এবং মাথায় হেলমেট পরিয়ে দেন সহকর্মীরা। হেলমেট পরানোর সাথে সাথেই তিনি প্রচণ্ড মারমুখী হয়ে ওঠেন। সেদিন তিনি ও তার সহকর্মীরা বিক্ষোভকারীদের অমানুষিকভাবে লাঠিপেটা করেন। গত বছরের ৪ মার্চ গণ অধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ মিছিল বের করা হয়। ঢাকা ক্লাবের সামনে উপ-কমিশনার হারুন অর রশিদের নেতৃত্বে একদল পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর অতর্কিত লাঠিচার্জ করে। এ ছাড়া গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এডিসি হারুনের নেতৃত্বে পুলিশ ছাত্রদলের ‘শান্তিপূর্ণ’ সমাবেশে হামলা চালায় বলে অভিযোগ উঠেছিল। ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুতে বিচার চেয়ে শাহবাগে প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও অন্যান্য বাম সংগঠন আয়োজিত মশাল মিছিলেও তার নেতৃত্ব পুলিশ লাঠিপেটা করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/776695