১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ৫:৪৮

দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের নৈতিক ভিত্তি নেই

ইকতেদার আহমেদ

দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য আইন মেনে চলা যেমন কর্তব্য অনুরূপ সরকারের দায়িত্ব আইন অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করা। সংবিধান দেশের অন্যান্য আইনের মতো একটি আইন; তবে অন্যান্য আইনের চেয়ে সংবিধানের অবস্থান ঊর্ধ্বে। প্রতিটি আইন প্রণয়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী আইনটি প্রতিপালিত হওয়ার পেছনেই নিহিত আছে এর নৈতিক ভিত্তি। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে একটি সংসদের মেয়াদ অবসানে কখন এবং কোন ধরনের সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সে বিষয়ে সংবিধানে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়। আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে যে বিধান ছিল তাতে উল্লেখ ছিল- মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে এবং মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

সংসদের মেয়াদ বিষয়ে আমাদের সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে- রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভেঙে না দিয়ে থাকলে প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে পাঁচ বছর অতিবাহিত হলে সংসদ ভেঙে যাবে।

উপরোক্ত বিধানাবলি অবলোকন করলে দেখা যায়, মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে দলীয় বা ক্ষমতাসীন সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তার কর্তৃত্বে প্রযুক্ত হয়।

বাহাত্তরের সংবিধানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা কার্যকর ছিল। এ ধরনের সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার পরিচালিত হয়। বাহাত্তরের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি স্বীয় পদে বহাল থাকবেন মর্মে উল্লেখ ছিল।
সংসদ নির্বাচনসংক্রান্ত উপরোক্ত বিধানটি ষষ্ঠ সংসদ কর্তৃক ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রহিত করে নতুন বিধান প্রবর্তন করে বলা হয়- মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে যে পাঁচটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এর প্রথমটি অনুষ্ঠানকালীন দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা বহাল ছিল। অপর দিকে, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থটি অনুষ্ঠানকালীন রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা বহাল ছিল। পঞ্চম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকার দেশের তিনটি পৃথক রাজনৈতিক জোটের রূপরেখা অনুযায়ী সাময়িক সময়ের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কাজটি সমাধা করে। প্রথম থেকে চতুর্থ- এ চারটি সংসদ নির্বাচন দলীয় বা ক্ষমতাসীন সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হয় এবং এ চারটি সংসদ নির্বাচনেই ক্ষমতাসীন দল বিজয়ী হয়।

অস্থায়ী সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে এবং তৎপরবর্তী তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতায় উপনীত হয়ে সংবিধানে দ্বাদশ সংশোধনী প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় ফিরে আসে। পঞ্চম সংসদ বহাল থাকাকালীন আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়, দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না আর তাই মেয়াদ অবসান বা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান করতে হবে। এ ধরনের বিধান কার্যকর করতে হলে সংবিধান সংশোধনের আবশ্যকতা রয়েছে। পঞ্চম সংসদে সংবিধান সংশোধন করার মতো বিএনপির দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। ওই সংসদের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান কার্যকর করতে হলে বিএনপির প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় আওয়ামী লীগের সহায়তা গ্রহণের আবশ্যকতা ছিল। সে সংসদে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টির যে আসন সংখ্যা ছিল তার সহায়তায় বিএনপির পক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না হওয়ায় সংবিধানে সংশোধনী কার্যকর করা সম্ভব ছিল না। পঞ্চম সংসদ থেকে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টি একযোগে পদত্যাগ করলে একদিকে ওই সংসদ কর্তৃক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের বিধান রুদ্ধ হয়, অপর দিকে মেয়াদ অবসানের আগেই বাধ্য হয়ে বিএনপিকে সংসদ ভেঙে দিয়ে আগাম নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হয়।
ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনটি দশম সংসদ নির্বাচনের মতো একদলীয় ও একতরফা ছিল। সে নির্বাচনটিতে অংশগ্রহণ থেকে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টি বিরত থাকে। এ তিনটি দলের সম্মিলিত বাধার মুখে সে নির্বাচনটিতে সন্ত্রাস, বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগ হয়। ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন পরবর্তী বিএনপি নেতৃত্ব যথার্থই উপলব্ধি করতে পারে যে, এ সংসদ বহাল রেখে সরকার পরিচালিত হলে তা দেশের স্থিতিশীলতা বিপন্ন করে উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করবে। আর তাই দেশকে অরাজকতা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সম্মুখীন না করে দলটি ষষ্ঠ সংসদের মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান প্রবর্তন সংক্রান্ত সংশোধনী কার্যকর করে সংসদের অবলুপ্তির মধ্য দিয়ে ওই সরকারের অধীন সপ্তম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ সুগম করে।

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন পরবর্তী সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচন এ সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হয়। উভয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন দল বিজয় অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে দলীয় বা ক্ষমতাসীন দলের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দল যে দলই বিজয় অর্জন করুক না কেন, দেখা যায় বিজিত দলের প্রধান পরাজয়ের ব্যর্থতা নিজের কাঁধে নিয়ে বিজয়ী দলের প্রধানকে অভিনন্দন জানান এবং সহযোগিতার আশ্বাস দেন। আমাদের ষষ্ঠ ও সপ্তম সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও বিজিত দলের প্রধান বিজয়ী দলের প্রধানকে অভিনন্দন জানানো দূরের কথা; বরং নির্বাচনে কারচুপি ও কলুষতার অভিযোগ আনেন। উল্লেখ্য, সপ্তম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হয়।

এ কথাটি সত্য, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন কমিশন নিজেকে সব প্রকার বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখে দক্ষতা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সাথে নির্বাচন পরিচালনা করে কিন্তু আমাদের দেশের উপরোক্ত দু’টি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও তাদের অধীনস্থ নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষতা, দক্ষতা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা বিষয়ে সে মানের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারেনি।

অষ্টম সংসদের মেয়াদ অবসান-পরবর্তী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে প্রথমত যে সরকারটি গঠিত হয়েছিল সেটি এ সরকার গঠনসংক্রান্ত সাংবিধানিক বিধান অবজ্ঞা ও উপেক্ষাপূর্বক দলীয় রাষ্ট্রপতির অধীন গঠিত হয়েছিল। যাই হোক, সে সময়কার বিরোধী দলের আন্দোলনকে উপলক্ষ করে সেনা হস্তক্ষেপে সে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদত্যাগে বাধ্য হলে অসাংবিধানিকভাবে একটি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। সে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দীর্ঘ প্রায় দু’বছর ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় যে নির্বাচনের আয়োজন করে তাতে অষ্টম সংসদে বিরোধীদলের ভূমিকায় অবতীর্ণ আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয় লাভ করে। এ নির্বাচনটি ত্রুটিপূর্ণ ও কালিমায্ক্তু ছিল মর্মে বিএনপির পক্ষ থেকে প্রথম থেকেই এটির নিরপেক্ষতা বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল।

নবম সংসদ বহাল থাকাকালীন আওয়ামী লীগ তার দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে পুঁজি করে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির দাবি ও জনমতকে উপেক্ষা করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে নিজ দলের আগেকার অবস্থান ও মতাদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিমিত্ত সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী কার্যকর করে। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস যে, বিএনপি সামগ্রিকভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধী ছিল সে বিএনপির হাতেই সংবিধান সংশোধনের মধ্য দিয়ে এ বিধানটি প্রবর্তিত হয়। আর যে আওয়ামী লীগ একনিষ্ঠভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সমর্থক ছিল সে আওয়ামী লীগ দ্বারাই এ ব্যবস্থাটির বিলোপ সাধন করা হয়।

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত বিধানের বিলোপ-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সংসদ নির্বাচন বিষয়ে বাহাত্তরের সংবিধানে যে বিধান ছিল তা পুনঃপ্রবর্তন করে। এর ফলে দশম সংসদ নির্বাচনটি সংসদ বহাল থাকাবস্থায় দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হয়। নবম সংসদের প্রধান বিরোধী দল ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক উদ্দেশ্যমূলকভাবে নির্বাচনে তাদের বিজয় নস্যাৎ করার প্রয়াসে একতরফাভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলোপ সাধন করায় সে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। এ নির্বাচনটিতে ব্যাপক সহিংসতা হয় এবং সামগ্রিকভাবে এ নির্বাচনটি অস্বচ্ছ ও কলুষতায় ভরপুর ছিল। এ নির্বাচনটির প্রধান যে নেতিবাচক দিক তা হলো- একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের জন্য উন্মুক্ত ৩০০টি আসনের অর্ধেকেরও বেশি আসনের প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। এভাবে নির্বাচিত হওয়া সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৫(২)-এর বিধানের পরিপন্থী।

দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালীন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়েছিল- নেহায়েত সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে এ নির্বাচনটি অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং অচিরেই সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাস্তব অর্থেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান-পরবর্তী সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের অবস্থান থেকে ফিরে আসে এবং দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়- সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত বিধান অনুযায়ী একাদশ সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হবে।

দশম সংসদ নির্বাচনটি ব্যাপক সহিংসতার মধ্যে অস্বচ্ছ ও কলুষতাপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ায় এ দেশের সাধারণ জনমানুষের কাছে ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি; তবে আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত একতরফাভাবে এ নির্বাচনটি আয়োজনে সরকারকে সব ধরনের সমর্থন দিয়েছিল।

বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী দীর্ঘকাল ধরে স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হতো। দশম সংসদে আওয়ামী লীগের বিজয়-পরবর্তী এ দলটি স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচন দলীয় মনোনয়নে দলীয় প্রতীকের ভিত্তিতে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এ ব্যবস্থাটি প্রবর্তন-পরবর্তী দেখা গেল, দশম সংসদ নির্বাচন যে মাত্রায় অস্বচ্ছ ও কলুষতায় ভরপুর ছিল স্থানীয় সরকারের প্রতিটি নির্বাচনও একই মাত্রায় অস্বচ্ছ ও কলুষতায় ভরপুর।

দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালীন নির্বাচন পরিচালনার জন্য যে নির্বাচন কমিশনটি ছিল বিভিন্ন অনিয়ম ও বেআইনি কার্যকলাপকে প্রশ্রয় দেয়ায় এটি এতই বিতর্কিত হয়েছিল যে, এর গ্রহণযোগ্যতা ক্ষমতাসীন দল ব্যতীত অপর সবার কাছে শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছিল এবং এর কার্যকলাপ দেশবাসীর কাছে হাস্যস্পদ ও বালখিল্য স্বরূপ ছিল।

দশম সংসদ নির্বাচনের ন্যায় একাদশ সংসদ নির্বাচনটিও সংসদ বহাল থাকাবস্থায় দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হয়। একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান পূর্ববর্তী দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে আশ্বস্ত করা হয় যে, সমসুযোগ সংবলিত মাঠে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু দেশবাসীসহ বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে, নজিরবিহীনভাবে আনুষ্ঠানিক ভোটগ্রহণের পূর্ববর্তী রাতে প্রশাসন, পুলিশ ও দলীয় নেতাকর্মীদের সহায়তায় ব্যালটবাক্স পূর্ণ করে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের বিজয় নিশ্চিত করা হয়। একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালীন নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনটিও পূর্বসূরি নির্বাচন কমিশনের মতো ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করে।

যেকোনো সরকার সংবিধান ও আইন অনুযায়ী পরিচালিত হলে সে সরকারের পক্ষে জনসমর্থন অটুট থাকে কিন্তু যখন কোনো সরকার জনমতের উপেক্ষায় স্বীয় উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সংবিধান ও আইনকে নিজ স্বার্থে ব্যবহারের প্রয়াস নেয় তখন তা সাময়িক তাদের স্বস্তি দিলেও পরিণামে এর ফল কখনো শুভ হয় না। এ দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা একটি সরকারের মেয়াদ অবসানে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পরবর্তী সরকার গঠিত হবে। আমাদের দেশে আমরা এখন পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীন সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়- সাধারণ জনগণের মধ্যে এমন আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টি করতে পারিনি। একটি সরকার কর্তৃক সাধারণ মানুষের মধ্যে তার কার্যকলাপ বিষয়ে আস্থা ও বিশ্বাসের সৃষ্টিই সে সরকারটির নৈতিক ভিত্তি। সাম্প্রতিক সময়ের সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচনগুলো প্রত্যক্ষ করার পর দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের নৈতিক ভিত্তি আর যে অবশিষ্ট নেই- এ দেশের মানুষের সে বিশ্বাস দৃঢ়তর হয়েছে, এ বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। হ
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail : iktederahmed@yahoo.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/776593