১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, রবিবার, ৩:৪৫

বেসরকারি আইসিইউতে খরচ চার-পাঁচ গুণ বেশি

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজধানী ঢাকার ধানমণ্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে ছয় দিন ভর্তি ছিলেন গ্রিসপ্রবাসী পারভেজ খান। এতে তাঁর খরচ হয়েছে এক লাখ ৭৭ হাজার টাকা।

পারভেজ খানের ভাষ্য, মূল খরচ হয়েছে কেবিনের ভাড়া ও আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র)। ওই হাসপাতাল আইসিইউ শয্যার তিন দিনের ভাড়া নিয়েছে ৫৪ হাজার টাকা।

কেবিন ভাড়া ২১ হাজার টাকা। প্লাটিলেট নেওয়ার প্রক্রিয়ায় লেগেছে ২৪ হাজার টাকা। কনসালটেশন বাবদ ১৭ হাজার টাকা। পর্যবেক্ষণে ১৩ হাজার টাকা।

অন্যান্য পরীক্ষা ও ওষুধ কেনায় আরো বেশ কিছু টাকা খরচ হয়েছে। পারভেজ খানের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের চন্দনপুর এলাকায়। গত জুনে তিনি দেশে ছুটি কাটাতে আসেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার এক দিন পর কোনো কারণ না জানিয়ে বলা হলো, আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে।

কিন্তু তখন আমার আইসিইউতে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়নি। তবু গেলাম। সেখানে কোনো চিকিৎসা নয়, শুধু বিছানায় শুইয়ে রেখে স্যালাইন দেওয়া হলো। এভাবে তিন দিন থাকার পর বলা হলো, এখন অবস্থা ভালো। আপনি কেবিনে যেতে পারেন।

পারভেজ খানের মতো অনেক ডেঙ্গু রোগীকে বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে এমন বিপুল ব্যয়ের ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে। রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোগের মাত্রাভেদে এসব রোগীর খরচ ৩০ হাজার থেকে চার লাখ টাকা। আইসিইউ সুবিধা নেওয়া রোগীদের খরচ বেড়েছে চার-পাঁচ গুণ।

ধানমণ্ডির আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালে দুই দিন ভর্তি থাকার পর মারা যান জয়মিতা দাস (২৫)। রাজাবাজার এলাকার এই বাসিন্দার এক স্বজন জানায়, এক দিন আইসিইউতে থাকা ও প্লাটিলেট পরীক্ষার জন্য তাদের খরচ হয়েছে দুই লাখ ৬৫ হাজার টাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায়ও একই চিত্র দেখা যায়। ২০১৯ সালে বিভাগটির অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ ও তাঁর সহকর্মীদের পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার একটি সরকারি হাসপাতালে একজন ডেঙ্গু রোগীর গড় খরচ ১১ হাজার টাকা। আর ঢাকার বাইরে থেকে আসা রোগীর সরকারি হাসপাতালে খরচ ২০ হাজার টাকা।

এ ক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতালকে গবেষকরা তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেন। ক শ্রেণির হাসপাতালে একজন রোগীর গড় খরচ ছিল দুই লাখ টাকা। খ শ্রেণির হাসপাতালে গড় খরচ ৪১ হাজার টাকা। সর্বশেষ গ শ্রেণির হাসপাতালে খরচ ছিল ২৫-২৬ হাজার টাকা। এসব খরচ রোগীর ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, শয্যার ভাড়া, চিকিৎসকের ফি, যাতায়াত ভাড়া বাবদ হিসাব করা হয়েছিল। বর্তমান বাস্তবতায় এটা কয়েক গুণ বেড়েছে।

অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, রোগীর আইসিইউ খরচ হাসপাতালের মান অনুযায়ী সরকার থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে তদারকিও করা দরকার, যাতে কেউ অযথা আইসিইউতে রোগী ভর্তি করে বাড়তি খরচ না নিতে পারে।
সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এক আলোচনাসভায় বলেছেন, প্রত্যেক ডেঙ্গু রোগীর পেছনে গড়ে ৫০ হাজার টাকা করে খরচ হচ্ছে সরকারের। তিনি জানান, ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা বাবদ এরই মধ্যে সরকারের খরচ হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের ২০২০ সালে পরিচালিত গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৮.৫ শতাংশ ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যয়ের মাধ্যমে বা আউট অব পকেট খরচ হয়েছে। বর্তমানে ডেঙ্গু চিকিৎসার ক্ষেত্রেও একই ধরনের চিত্র দেখা যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রমণ রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকার উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত মানুষ পারতপক্ষে সরকারি হাসপাতালে যায় না। মধ্যবিত্তরা সামর্থ্য অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতালে যায়। এরপর নিম্নবিত্তের একটি অংশ বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়।

তিনি বলেন, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যেসব এলাকায় রোগী বেশি, সেখানকার সরকারি হাসপাতালে জায়গা নেই। এসব এলাকার রোগীরা তখন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর চিকিৎসায় প্যারাসিটামল আর স্যালাইনের ব্যবহার বেশি হওয়ায় খরচ নিতান্তই কম। কিছু ক্ষেত্রে রোগীর শারীরিক অবস্থার নিবিড় পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন হলেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধের ব্যয় লাখ টাকা ছাড়ানো কোনোভাবেই যৌক্তিক নয় বলে মনে করেন তাঁরা।

সোসাইটি অব মেডিসিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এইচ এ এম নাজমুল আহসান বলেন, রোগীর প্রথম দিকে খুব বেশি চিকিৎসা লাগে না। প্যারাসিটামল, ওরাল স্যালাইন, এর সঙ্গে রোগীর জন্য তরল খাবার লাগে। এর বাইরে প্রতিদিন একটি করে সিবিসি পরীক্ষা করাতে হয়।

তিনি বলেন, কর্তব্যরত চিকিৎসক কোন কোন পরীক্ষা করাবেন, কোনটি করাবেন না, এগুলোর ওপর খরচ নির্ভর করে। বেসরকারিতে চিকিৎসকরা এসব খরচের দিকে নজর দিলে ব্যয় আরো কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

এক দিনে মৃত্যু ১০, হাসপাতালে ভর্তি ২,৭৪৮
দেশে গত এক দিনে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দুই হাজার ৭৪৮ জন। গতকাল শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির এমন তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
গত এক দিনে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে এক হাজার ৫১ জন ঢাকার, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলার এক হাজার ৬৯৭ জন। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের পাঁচজন ঢাকার হাসপাতালে এবং পাঁচজন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় মারা গেছে। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৩৩৫, মৃতের সংখ্যা ৭১৬।

৪৫ শতাংশ রোগী ঢাকা মহানগরের
দেশে চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ৪৫ শতাংশ ঢাকা মহানগরের। এসব রোগীর মধ্যে ৫৮.৩২ শতাংশ চিকিৎসা নিয়েছে সরকারি হাসপাতালে। ৪১.৬৮ শতাংশ চিকিৎসা নিয়েছে বেসরকারি হাসপাতালে।
চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া রোগীর ৭২ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে। এর মধ্যে ৭৩ শতাংশ মারা গেছে সরকারি হাসপাতালে। ২৭ শতাংশের মৃত্যু বেসরকারি হাসপাতালে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুবিষয়ক তথ্য বিশ্লেষণে এই উপাত্ত পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত আগস্টে ৩১ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৩৪২ জন। হাসপাতালে ভর্তি হয় ৭১ হাজার ৯৭৬ জন। চলতি সেপ্টেম্বরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২১ হাজার ৫২৭ জন, মারা গেছে ১২৩ জন।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/09/10/1316647