১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, রবিবার, ৩:২২

সেপ্টেম্বরেও কঠোর প্রোগ্রাম দেয়নি অক্টোবরে কঠোর কর্মসূচির আভাস

আসিফ আরসালান

বাংলাদেশের রাজনীতিতে যারা সরাসরি সংশ্লিষ্ট নন, কিন্তু রাজনীতি সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন, তারাও বুঝতে পারছেন না, দেশ কোন পথে যাচ্ছে। তবে একটি বিষয়ে সবাই একমত। আর সেটি হলো, অমানিশার ঘন কালো অন্ধকার ক্রমান্বয়ে দেশকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলছে। দেশের পরিচালনায় আছে তিনটি অঙ্গ। সকলেই জানেন যে সেগুলো হলো এক্সিকিউটিভ বা নির্বাহী বিভাগ, লেজিসলেটিভ বা আইনসভা তথা পার্লামেন্ট এবং জুডিশিয়ারী তথা বিচার বিভাগ। এই তিন অঙ্গের প্রতিটি অঙ্গই এখন চরমভাবে বিতর্কিত। এখন পর্যন্ত একমাত্র একটি জায়গা আছে যেটিকে বিতর্ক এখনো স্পর্শ করতে পারেনি। সেটি হলো দেশের শসস্ত্র বাহিনী। অর্থাৎ সামরিক বাহিনী, নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনী। যে বিভাগটি জনগণের আশা আকাঙ্খা এবং ন্যায় বিচারের শেষ ভরসাস্থল, সেই বিচার বিভাগও এখন চরম বিতর্কিত। এগুলো আমাদের কোনো কথা নয়। এখন দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টের অঙ্গন এখন সুপ্রিম কোর্টের দুইজন বিচারপতির বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং শ্লোগানে মুখর। এই দুইজন বিচারপতি হলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক। তারা হলেন বিচারপতি এনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী। এই দুইজন বিচারপতি এখনো সিটিং। তারা সিটিং জাস্টিস হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের সপক্ষে এবং বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বিদেশীদের আনাগোনা এবং ঘন ঘন বৈঠক করার বিরুদ্ধে নাকি কথা বলেছেন। তারা নাকি নির্বাচন নিয়েও কথা বলেছেন। এর ফলে তাদেরকে শপথবদ্ধ রাজনীতিক বা পলিটিশিয়ান বলে অন্যেরা অভিযোগ তুলেছেন। হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে আওয়ামীপন্থী আইনজীবী যেমন রয়েছেন তেমনি রয়েছেন বিএনপি ও জামায়াতপন্থী আইনজীবীও। বরং বলা যায় যে বিএনপি ও জামায়াতপন্থী আইনজীবীদের সংখ্যাই বেশি। তারা দাবি করেছেন যে আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করার জন্য ঐ বিচারপতিদের এতই যদি আগ্রহ থাকে তাহলে বিচারপতির ঐ লেবাসটি খুলে বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে রাজনীতিতে নেমে পড়ুন। কেউ কিছু বলবে না।

এবার ড. ইউনূস প্রসঙ্গ। আমরা জানি না, কেন ড. ইউনূসকে নিয়ে এত ঘাঁটাঘাঁটি করা হচ্ছে। ড. ইউনূসের বিষয়টি এখন আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাকে হেনস্তা করা হচ্ছে বলে বিবৃতি দিয়েছেন পৃথিবীর ১০০ জন (মতান্তরে ১০৬ জন) নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ব্যক্তিত্ব। এই ১০০ জন ছাড়াও পৃথিবীর অন্তত ৮৬ জন ব্যক্তিও ঐ বিবৃতিতে শামিল হয়েছেন। এরা যে সে মানুষ নন। এরা বিশ^বরেণ্য। এদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আলগোরে সহ এই র‌্যাংক এবং স্টাটাসের ৮৬ জন বিশ^বরেণ্য ব্যক্তি। ভাবতে অবাক লাগে যে, এই ১৮০ জন বিশ^ বিখ্যাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাংলাদেশে বিবৃতি দিয়েছেন আনুমানিক ১৫০ ব্যক্তি এবং ৫০ জন সম্পাদক। কঠোর বাস্তব হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের এই ১৫০ ব্যক্তির অনেককেই বাংলাদেশের মানুষ চিনে না। আর ৫০ জন সম্পাদকের অধিকাংশের পত্রিকার নামও বাংলাদেশের অনেকে জানেন না। এসব করে সরকারের কী লাভ হচ্ছে?
সরকার বলছে যে, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে যা কিছু ঘটছে সেখানে সরকারের কিছু করার নেই। তার বিরুদ্ধে যারা সংক্ষুব্ধ তারা মামলা দিলে সরকার কী করবে? কিন্তু এই কথা বলে পার পাওয়া খুব সহজ নয়। কারণ ইউনূস বিরোধী কনসার্টের হুইসল ব্লোয়ার (Whistle Blower) তো সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়। সেই সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই তো বলা হয়েছে যে, ড. ইউনূস সুদখোর, গরীবের রক্ত শোষক ইত্যাদি। সর্বশেষ তাকে বলা হয়েছে কুলাঙ্গার। এই সর্বশেষ গালিটি, এটি ড. ইউনূস তো দূরের কথা, আমাদের মত সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধেও তো উচ্চারণ করাটা গর্হিত অপরাধ।

॥দুই॥
সরকার বিষয়টিকে যতই বিচারিক বিষয় বলে প্রচার করার চেষ্টা করুন না কেন, বিশে^র গণতান্ত্রিক মহল এবং সংবাদ মাধ্যম সরকারের এই বক্তব্য খাচ্ছে না। বৃহস্পতিবার ৭ সেপ্টেম্বর আমেরিকার শীর্ষ সংবাদ মাধ্যম ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও (এনপিআর) এ প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশে যখন নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে ঠিক সেই মুহূর্তে সরকারের পক্ষে এমন দাবি করা কঠিন যে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের মামলার বিষয়টি কেবলই আইনী বিষয়। সমালোচকদের মতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামল ক্রমশই কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে।

এটি শুধুমাত্র ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওর রিপোর্টেই নয়, ড. ইউনূস ছাড়াও বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসন অর্থাৎ সরকার সম্পর্কেও অত্যন্ত কঠোর মনোভাব প্রকাশ করা হয়েছে বিদেশী মাধ্যমে। গত ২ সেপ্টেম্বর বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত ‘দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসে’ বাংলাদেশ সম্পর্কে অত্যন্ত কঠোর ও বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টটি লিখেছেন মুবিজ মাশাল নামক এই পত্রিকাটির একজন সিনিয়র রাজনৈতিক ভাষ্যকার। রিপোর্টের প্রথমেই বলা হয়েছে যে, এই রিপোর্টটি প্রণয়ন করতে গিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টারকে দুই দফায় বাংলাদেশে যেতে হয়েছে এবং লম্বা সময় থাকতে হয়েছে। এই সাংবাদিককে দুই দফায় কেন আসতে হলো সেটির কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে এখন বিদেশী সাংবাদিকদের প্রবেশ ক্রমান্বয়ে সংকুচিত করা হচ্ছে। এটি একটি বিশাল রিপোর্ট। এই রিপোর্টে অনেকগুলো ছবি ছাপা হয়েছে। এরমধ্যে একটি হলো লক্ষ লক্ষ জনতার (আনুমানিক ১০ লক্ষের) সমাবেশ। এটি হলো ২৮ জুলাই নয়াপল্টনে অনুষ্ঠিত বিএনপির সমাবেশ, যেটি ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের পর অনুষ্ঠিত বৃহত্তম জনসভা। রিপোর্টর শুরুতেই বলা হয়েছে যে, ১৭ কোটি লোকের বাংলাদেশের আদালত কক্ষে বহুদলীয় গণতন্ত্রকে সুপরিকল্পিতভাবে কন্ঠরোধ করা হচ্ছে। রিপোর্টে অনেক কথা রয়েছে। সেগুলো বিস্তারিত বলা যাবে না। শুধুমাত্র রিপোর্টটির দ্বিতীয় প্যারা পড়লেই মানুষ জেনে যাবেন যে, এখন বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ^বাসীর কাছে কী বার্তা যাচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার বিরোধী দলসমূহের নেতাকর্মী ও সমর্থককে আদালতের বিচারকের সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে সেসব অস্পষ্ট। যেসব প্রমাণ দেয়া হচ্ছে তার কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু যখন নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস অবশিষ্ট রয়েছে তখন হাজার হাজার মানুষকে অচল করে দেয়ার মধ্যে নিশ্চয়ই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে।

ওয়াশিংটনের বিখ্যাত ম্যাগাজিন দি ডিপ্লোম্যাটে যে রাজনৈতিক ভাষ্য প্রকাশিত হয়েছে তার শিরোনাম বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘শেখ হাসিনার সরকারের জন্য নির্বাচন নিয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর মানে কী?’ গত ৭ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইনকিলাবে এবং ৬ সেপ্টেম্বর দৈনিক মানবজমিনে অত্যন্ত ফলাও করে ডিপ্লোম্যাটের আরেকটি রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। এই রিপোর্টের শিরোনাম, বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে ভারত, আমেরিকা এবং চীনের ভূমিকা কী হবে? ডিপ্লোম্যাটের এই রিপোর্টে এমন কিছু স্পর্শকাতর বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে যেটি আমরা বোধগম্য কারণে এখানে উল্লেখ করলাম না। তবে পাঠক ভাইদের কেউ যদি এ ব্যাপারে আগ্রহী হন তাহলে তাদেরকে অনুরোধ করবো, নিম্নোক্ত হেডিং দিয়ে গুগলে সার্চ করুন। হেডিংটি হলো, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে ভারত, আমেরিকা, চীনের ভূমিকা কী হবে’।

॥তিন॥
প্রিয় পাঠক, এই ধরনের উদাহরণ আর বাড়াতে চাই না। শুধুমাত্র একটি সংবাদের উল্লেখ না করে পারছি না। ৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর এই খবরটি দৈনিক মানবজমিনের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে কৌশলগত যোগাযোগ বিষয়ক সমন্বয়কারী জন কিরবি বলেছেন, বাংলাদেশ বিষেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কোনো নড়চড় হয়নি। শুধু তাই নয়, সর্বশেষ যে নিরাপত্তা বিষয়ক মার্কিন প্রতিনিধি ঢাকায় এসেছিলেন তার আলোচনা করার কথা ছিল বাংলা-মার্কিন সামরিক সহযোগিতা সম্পর্কে। কিন্তু তিনিও পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের কাছে তার নিজের বিষয়কে সাইড লাইনে রেখে বারবার জানতে চেয়েছেন যে, বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচন কেমন হবে?

আরেকটি বিষয় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মাইকেল কুগেলম্যান ওয়াশিংটন উইলসন সেন্টার নামক থিংক ট্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক। বাইডেন সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এমনকি হোয়াইট হাউজেও তার অবাধ যাতায়াত রয়েছে। সেই মাইকেল কুগেলম্যান গত ৭ সেপ্টেম্বর দৈনিক মানবজমিনকে প্রদত্ত একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমেরিকা বাংলাদেশকে তাদের পররাষ্ট্রনীতির একটি Example বা উদাহরণ হিসেবে বানাতে চায়’। এর থেকেই বুঝতে পারেন যে, এবার বাংলাদেশের ব্যাপারে আমেরিকা কতখানি কমিটেড।

এত কিছু বলার পরেও আমার কাছে কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো এই যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে আমেরিকা সেই উদ্ধারকৃত গণতন্ত্র বাংলাদেশের মানুষ বা রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে উপহার হিসেবে তুলে দেবে না। দিতে পারেও না। এই কাজটি করতে হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল তথা বাংলাদেশের জনগণকে। নির্বাচন কমিশন তো বলেই দিয়েছে যে, আগাামী জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেটি করতে হলে অন্তত দেড় মাস আগে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করতে হবে। অর্থাৎ ১৫ই নভেম্বরের মধ্যেই তফশিল ঘোষিত হবে। বিরোধী দল যদি তাদের দাবি আদায় করতে চায় তাহলে তাদেরকে তার আগেই সরকারের পদত্যাগ এবং সংসদ বাতিলের দাবি আদায় করতে হবে। এতদিন আমরা শুনে আসছিলাম যে, চলতি সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই বিরোধী দল একটি হেস্তনেস্ত করবে। কিন্তু আমার এ ব্যাপারে প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল। তাই আমি গত রবিবারের এই কলামের শিরোনাম দিয়েছিলাম, “এসে গেছে সেই সেপ্টেম্বর : বিএনপি কি চূড়ান্ত ধাক্কা (ফাইনাল পুশ) দিতে পারবে?” আমার শঙ্কা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে যে, চূড়ান্ত ধাক্কা দেওয়া হবে অক্টোবর মাসে। উল্লেখ্য, গত অক্টোবর মাস থেকে বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দল জনসভা ও মিছিল করে বেড়াচ্ছে। ঐ পর্যন্তই। তারপর থেকে ডিসেম্বর, মার্চ, জুন এবং সেপ্টেম্বর। অবশেষে এখন অক্টোবর।
আমরা নৈরাশ্যবাদী নই। তারপরেও জাতীয় কবি নজরুলের সেই বিখ্যাত গানটি মনে পড়ে গেল। গানটির প্রথম লাইন প্রথম লাইন, “শাওন আসিল ফিরে/সে ফিরে এলো না”।

https://www.dailysangram.info/post/535002