সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় তলিয়ে যাওয়া শেষ সম্বল রক্ষায় ব্যস্ত কৃষকরা
৩০ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ১:১৮

চৈত্রের প্লাবণে বৈশাখে হাওরাঞ্চলে আর্তনাদ

মহসিন রেজা মানিক, সুনামগঞ্জ থেকে : বাংলা ষঢ় ঋতুুতে ‘মরা কার্তিক’ ও ‘চৈত্রের আকাল’ শব্দ দু’টির দুর্নাম থাকলেও বৈশাখকে ধরা হয় ঐশ্বর্য্য আর সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে। বৈশাখে কৃষকের শূন্য গোলা ভরে উঠে নতুন ধানে। মরা কার্তিক ও আকাল চৈত্রের নিদান কাটিয়ে নতুন অন্নের ঘ্রাণে কৃষাণ কৃষাণীর মাঝে প্রাণে সঞ্চার ঘটে। ফসলী মাঠে ধানের ছন্দ হিন্দোলে মন প্রাণ ভরে যায় কৃষাণ কৃষাণীর। আর ভুলে যায় অতীত দারিদ্র, জরা, দুঃখ কষ্টকে। কিন্তু এবার হাওরাঞ্চলে বৈশাখী নবান্নের দেখা মিলেনি। আকাল চৈত্রের নিদাণই রয়ে গেছে এক ফসলী হাওরের নবান্নের মাসে। মধ্য চৈত্রের প্লাবণে দেখা দিয়েছে বৈশাখের এই নিদাণ। ভারী বৃস্টিপাত ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে অসময়ে তলিয়ে যায় সুনামগঞ্জের প্রায় আড়াই লক্ষাধিক হেক্টর জমির বোরো ফসল। সপ্তাহান্তে মাছের মড়কের মহামারি। অত:পর গো-খাদ্যের সংকটে পানির দামে বিক্রি করতে হয়েছে গৃহ পালিত গবাদি পশুও। সবহারা কৃষকের চোখে এখন দু:স্বপ্নের হাতছানি। বৈশাখেই এত নিদান! বার মাস চলবে কি দিয়ে। আবহাওয়াবিদরা ঋতু চক্রের বিবর্তনের কথা বললেও স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগের তীর ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে নিয়োজিত কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও পিআইসিদের দিকে। তাদের দাবি সময়মত টেকসই বাঁধ নির্মাণে ফসলহানির পরিমাণ কমিয়ে আনা যেত।
সুনামগঞ্জ থেকে শনির হাওর পারের পুরান বারুংকা ৩০/৩৫ কি:মি: রাস্তা। সিএনজি করে অল্প সময়েই চলে এসেছি আমরা। যাওয়ার পথে নেই কোন কোলাহল, কোন ধানের আটি বা কৃষাণ কৃষাণীর আনাগোনা। যেন পিন পতন নিরবতাই বিরাজ করছে এখানে। অথচ বৈশাখী ধান শুকানো, ধান উড়ানো ও মাড়াইর কাজে অঘোষিতভাবে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল এই রাস্তাটিতে। গোলায় ধান তোলার ২০/২৫টি দিন হাওরাঞ্চলের পথ ঘাট, সড়কের পাশের পতিত জায়গা এমনকি জনবহুল পাকা সড়কগুলিও হাওরপারের কৃষকদের দখলে চলে যেত। যানবাহন চলাচল তো দূরের কথা পায়ে হেটে যাওয়াটাই ছিল দুষ্কর। কেননা রাস্তা দিয়ে চলাচলের মানুষ কই? সবাই তখন ব্যাতিব্যস্ত একমাত্র ফসল ঘরে তোলার কাজে। ফসল তোলার চিরাচরিত চিত্র এখানে অনুপস্থিত। হাওরের বাঁধ ভাঙ্গা পানি যেন এখানকার কৃষকদের ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। কাঙ্খিত সেই ফসল তোলার পরিবর্তে রিলিফের চালের দোকানে এখন কৃষকের দীর্ঘ লাইন। অভুক্ত বা আধাপেটা লোকজনকে ১০টাকা কেজিতে চাল পেতে কাকডাকা ভোরে লাইনে দাঁড়াতে হয়। প্রতিটি বিতরণ কেন্দ্রে দৈনিক ১টন চাল বিতরণ করা হবে। জনপ্রতি ৫কেজি চাল। ২০০জন সৌভাগ্যবানের কপালে জোটবে স্বল্পমূল্যের এই চাল। চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। ফলে প্রতিযোগিতায় নামতে হয় তাদেরকে।
আকলিমা বেগম। অসুস্থ স্বামী আর ৩সন্তানের সংসারে একদিনের খাবার সংগ্রহে ৩কি:মি: দূরের গ্রাম খামতিয়র থেকে এসেছেন। সকাল ১০টা থেকে লাইনে দাড়িয়ে আছেন। দুপুর গড়িয়ে গেল এখনও চালের পাশে ঘেষতে পারেননি। কারণ তার আগে এখনও ৩০/৪০জন দাঁড়ানো। যখন কাছাকাছি পৌঁছালেন তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তবে দুর্ভাগ্য: ততক্ষণে নির্ধারিত ২০০ জনের সিরিয়াল শেষ হয়ে গেছে। এই কেন্দ্রে বিক্রির জন্য আর কোন চাল নেই। আজ খালি হাতেই ফিরতে হবে তাকে। শুধু আকলিমা নয় তার মত আরও অনেকেই লাইনে দাড়াতে দেরী হওয়ায় চাল পাননি। আগামীকাল তাদেরকে আরও সকালে আসতে হবে। কারণ ১০টাকা কেজির চাল পেতে ২০০জনের লাইনে নাম লেখাতে হবে। তবে তা সহজ কাজ নয়, কাক ডাকা ভোরে যারা আসতে পারেন তারাই কেবল ৫০টাকায় ৫কেজি চাল নিয়ে ঘরে ফিরবেন। অন্যতায় শূন্য হাতেই ফিরতে হবে। জেলার প্রতিটি ওএমএস কেন্দ্রেই একই চিত্র। ভোক্তার চাইতে জোগান কম থাকায় কেন্দ্রে কেন্দ্রে দ্বিগুণ তিনগুণ লোক লাইন ধরে। কারণ দরিদ্র সংসারে এখন দারুন নিদান।

এদিকে ফসলহারা হাওরাঞ্চলের কৃষকগণ জীবনজীবিকার প্রয়োজনে গ্রাম ছাড়তে শুরু করেছেন। কারণ জীবন ধারণের আর কোন অবলম্বন নেই। মাছ ধরে বিক্রয় করবেন তারও সুযোগ নেই। অন্যের বাড়ি শ্রম বিক্রয় করবেন তাও প্রায় অসম্ভব, কেননা পাশের বাড়ির ধনী গৃহস্থ! তার গোলাতেও ধান নেই। ভিটে মাটি, হাওরের জমি বিক্রয় করবেন, তাও সম্ভব নয়, ক্রেতা নেই। কারো দুঃখে কেই শরীক হওয়ার বা সহযোগিতার সাধ্য নেই। কেননা বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের পানি ধনী গরীব সবাইকে এখন একই সমতলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এখানে কর্মস্ংস্থান নেই, বেঁচে থাকার কোন অবলম্বন নেই। তাই বাধ্য হয়েই হাওরাঞ্চলের পৈত্রিক ভিটে বা গ্রাম ছাড়তে হবে। সপরিবারে রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলো তাদের গন্তব্য। ধর্মপাশা উপজেলার ঝিংলিগড়া গ্রামের মধ্য বয়সী কৃষক কাশেম আলী। গতকাল সন্ধ্যায় দেখা সুনামগঞ্জ লঞ্চঘাটে। স্ত্রী জমিলা ৩ছেলে ১মেয়ে নিয়ে সব কিছু গুটিয়ে এসেছেন গ্রাম থেকে। ঢাকার আশুলিয়ায় কোন এক গার্মেন্টসে কাজে যাবেন তারা। গৃহস্থ পরিবার, তাই পরিচিত জায়গায় শ্রমিকের কাজ করা অসম্মানের, দূরে কোথাও যেকোন কাজ করে,পেটে ভাতে বেঁচে থাকবেন তারা।
এদিকে অসময়ে হাওরাঞ্চলের সকল ফসলী জমি অথৈ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় তালা ঝুলছে ধানের আড়তে। সুনামগঞ্জ হবিগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোণার হাওরাঞ্চলের বৃহৎ ধানের আড়ৎগুলিতে এখন শোনশান নিরবতা। এক মুটি ধানতো নেইই বরং বৈশাখের শুরু থেকেই তালা ঝুলছে সেখানে। হাওাঞ্চলের সাচনাবাজার, মধ্যনগর, বিশ্বম্ভরপুর, ঠাকুরাকোণা, বারহাট্টা, কলমাকান্দা, খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, দিরাইসহ প্রায় সহস্রাধিক ধানের বৃহৎ আড়ৎ যেখানে এখন ধানের কোন কেনা বেছ্া নেই।

http://www.dailysangram.com/post/281992