৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৩:৫০

নির্মম নির্যাতন ওরা আমার পা ভেঙে দিয়েছে

শিবির আখ্যা দিয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার সরকারি বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থী হেদায়েতুল্লাহ আল হাদী এখন পঙ্গু। চরম আতঙ্কে পুলিশে অভিযোগ করতে যাননি। তবে পুলিশ বলছে, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আসলে কি ঘটেছিল মঙ্গলবার? হেতায়েতুল্লাহর জবানিতে শুনে নেয়া যাক সেদিনের বিভীষিকাময় কাহিনী। হেতায়েতুল্লাহ বলেন সেদিন বিকাল ৩টার দিকে কলেজে যাই। এক বন্ধুর ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষার ফরম পূরণে সহযোগিতা করি। কিছুক্ষণ কলেজের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের ২০১৮-১৯ বর্ষের শিক্ষার্থী সজীব ফরাজি আমাকে ডাক দেন। আমি কাছে যেতেই আমাকে টেনে কলেজের এক কর্নারে নিয়ে যায়। সজীবের সঙ্গে আরও ১৪ থেকে ১৫ জন ছাত্র ছিল। কেউ আমার মাথায় আঘাত করে, অগণিত কিল-ঘুষি, লাথি-থাপ্পর মারে।

এভাবে ১০-১২ মিনিট ধরে নির্যাতন চালায়। এ সময় ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের লাকি হালদার চ্যাটার্জি ম্যাম দেখে দৌড়ে আসেন। তখন আমার এক বন্ধুও আসে। আমার বন্ধুকে ওদের মধ্যে ৫-৬ জন গিয়ে মারা শুরু করে। কোনোমতে ছাড়া পেয়ে লাকি ম্যামের অফিস রুমের দিকে যাই। তখন ম্যাম আমাকে সাপোর্ট দেন এবং ওদের কাছে জানতে চান কেন মেরেছো ওকে। তখন সজীব ম্যামকে বলে, ও হলো উগ্রপন্থি, শিবির- এই জাতীয় কথা বলতে থাকে ম্যামের কাছে। ম্যামও তখন আতঙ্কে ছিলেন। কিছুক্ষণ পর সজীবের দলবলসহ আমাকে ম্যামের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আবার মাঠের ভেতরে নিয়ে মারতে থাকে। আমার হাত-পা ধরে মোচড় দেয়, লাথি মারে একটার পর একটা। এ সময় আমার বাম পা ভেঙে যায়। এভাবে বর্ণনা করছিলেন ভুক্তভোগী সরকারি বাঙলা কলেজের ইংরেজি বিভাগের ২০১৮-১৯ বর্ষের শিক্ষার্থী হেদায়েতুল্লাহ আল হাদী।

হেদায়েতুল্লাহ আল হাদী মানবজিমনকে বলেন, আমি আশঙ্কা করছি আবার যদি ক্যাম্পাসে যাই ওরা আবার আমাকে মারতে পারে। আমার খুব ভয় হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে জীবনের নিরাপত্তা দরকার। তবে আমি যদি এমন নিশ্চয়তা বা নির্ভয় পাই তাহলে আইনি সহায়তা নেবো। আমার গ্রাজুয়েশন শেষের দিকে। এখন তো দাঁড়াতে পারি না, পা ভেঙে দিয়েছে ওরা। সজীব আমাকে একদিন বলেছিল আমি তাকে যেন টাকা দিই, তাহলে এখানে ছাত্রলীগের যে নেতাকর্মীরা আছে তাদের কাছ থেকে প্রোটেক্ট করবে। আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত না। আমি ফেসবুকে প্রতিদিনের ঘটনা বা কিছু বাস্তবতা নিয়ে লেখালেখি করি। সেটা কারও পক্ষে-বিপক্ষে নয়। কিন্তু সজীব তার দলবল নিয়ে শিবির সন্দেহে আমাকে নির্যাতন করেছে।

তিনি বলেন, প্রথমে ১০-১২ মিনিট ধরে নির্যাতন চালায়। এরপর মাঠের মধ্যে আবার নিয়ে মারধর করে। দ্বিতীয়বার মারধরের আগে যখন আমি লাকি ম্যামের রুমের দিকে দৌড়ে যাই তখন ম্যাম ওদেরকে বলে ও যদি কোনো অন্যায় করে থাকে তার জন্য আমাদের আইন আছে, কলেজ প্রশাসন আছে তাদেরকে জানাও। এরপর ম্যামের কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে মাঠের ভেতরে রেখে আবার আমাকে মারতে থাকে। তখন আমার বাম পা ভেঙে দেয়। তখন আমি হাঁটতে পারছিলাম না। এক্স-রে করে দেখি পায়ের পাতা, আঙ্গুল এবং ভেতরের সফট টিস্যু সরে গেছে এবং আঙ্গুলে হাড় উঁচু হয়ে আছে। ওরা মারার জন্য কোনো লাঠিসোঁটা নিয়ে আসেনি। সবাই পা দিয়ে লাথি মেরেছে অনেক। এরপর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় মাটিতে। পরে ওই অবস্থায় আমার হাত-পা ধরে মোচড়াতে থাকে। তখন ক্যাম্পাসে তেমন কোনো লোক ছিল না। হাঁটতে না পেরে আমি মাঠের মধ্যে পড়ে যাই। তখন কিছু বয়স্ক লোক এসে ওদেরকে বলে তোমরা ছেলেটাকে এভাবে মারছো কেন। এরপর ওই অপরিচিত লোকগুলো এবং এক ছোট ভাই আমাকে বাঙলা কলেজের গেটের বাইরে নিয়ে রাখে। এরপর আমাকে একটি রিকশায় তুলে দেয়। মিরপুরে একটি ফার্মেসিতে যাই। তারা বলেছেন, আপনার পা মনে হয় ভেঙে গিয়েছে হাসপাতালে যান এক্স-রে করেন। এরপর একটি ক্লিনিকে গিয়ে এক্স-রে করে দেখা যায় পায়ের অবস্থা খুব খারাপ। এরপর একটি সিএনজি করে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ইমার্জেন্সিতে গিয়ে পায়ে প্লাস্টার করিয়ে দেন চিকিৎসক। ওদের শরীরের সব শক্তি দিয়ে আমার মাথায়ও অনেক আঘাত করেছে। সজীবকে সব সময় রাজনৈতিক মিটিং মিছিলে দেখা যায় এবং ওর সঙ্গে যে ছেলেগুলো এসেছিল তারা অধিকাংশ প্রথম বর্ষের এবং সবাই ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী। বাকিরা সিনিয়র তারা অনেক আগে থেকে ছাত্রলীগের মিটিং-মিছিল করে এবং কলেজে দলবল নিয়ে রাউন্ড দেয়। ওইদিনের পরে ডিপার্টমেন্ট বা কলেজ প্রশাসন থেকে কোনো খোঁজখবর নেয়নি আমার। আর আমি অনেক অসুস্থ, কলেজে গিয়ে যে জানাবো বা সমস্যা ও নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করবো তেমন পরিস্থিতি নেই। হাঁটতে পারছি না একটুও।

হেদায়েতুল্লাহ আল হাদী বলেন, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলায় আমাদের বাড়ি। পাঁচ ভাই এক বোনের মধ্যে তৃতীয় আমি। আমার বাবা দুলাল মিয়ার বয়স হয়েছে। এখন কিছুই করতে পারে না। বাড়িতেই থাকে। আগে ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। বর্তমানে মিরপুর-১৩ নম্বরে ভাইয়ের বাসায় থাকি। ঘটনার পর প্রথম দুইদিন আমার পরিবারকে কিছুই জানাইনি তারা টেনশন করবে সেজন্য। বাসায় এসে ভাইয়াকে বলেছি। ঘটনা শুনে আমার পড়াশোনা নিয়ে হতাশায় আছে পরিবার এবং আমি নিজেও শঙ্কিত। আবার যদি ক্যাম্পাসে যাই তাহলে তারা আমাকে যদি আবার মারধর করে। এখন তো আমার পা ভেঙেছে পড়ে যদি আমার জীবন চলে যায়।

সরকারি বাঙলা কলেজের ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক সাবরিনা ইশরাত মানবজমিনকে বলেন, এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। যেটা টুকটাক হয়ে থাকে, সে রকম হয়েছে। সেটি তাৎক্ষণিকভাবে মিটে গেছে। হঠাৎ করে হয়েছে আবার হঠাৎ করে মিটে গেছে। পরে আর কোনো সমস্যা হয়নি। ঘটনাটি যখন ঘটে তখন আমরা সেটি মিটানোর চেষ্টা করি। যাতে পরবর্তীতে এ রকম ঘটনা না ঘটে।

ঘটনাটির পেছনের কারণ আমার জানা নেই। ভুক্তভোগী ছাত্রের নিরাপত্তার কোনো বিষয়ে আমাদের কাছে কিছু বলেনি। ওই ঘটনার পরে শিক্ষার্থী আর কোনো ধরনের যোগাযোগ করেনি। যারা ঘটনাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারবো না। হয়তো বাইরের কোনো বিষয় নিয়ে ঘটনাটি ঘটেছে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের সামনে। হেদায়েতুল্লাহ আল হাদী আমাদেরই স্টুডেন্ট। সে ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। ওইদিন মনে হয়, কোনো ফরম পূরণের জন্য এসেছিল কলেজে। তারপর এই ঘটনাটি ঘটে।

এই বিষয়ে দারুসসালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিনুল বাশার মানবজমিনকে বলেন, ঘটনাটি সম্পর্কে আমরা এখনো অবগত নই। কেউ এখনো আমাদের কাছে আসেননি। যদি কেউ অভিযোগ করেন অবশ্যই আমরা সেটি আমলে নিয়ে তদন্তসাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবো। ভয় বা হতাশ হওয়ার কিছু নেই, আইন সবার জন্য সমান।

https://mzamin.com/news.php?news=73160