৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৩:০৯

ফ্ল্যাট নদী ড্রেন ও ঝোপে পাওয়া যাচ্ছে লাশ

পুলিশের তথ্য: ঢাকার ৩ নদীতে এক বছরে অন্তত ১০৯ লাশ উদ্ধার

ফ্ল্যাটে, নদীতে, ড্রেনে ও ঝোপের মাঝে পড়ে থাকতে দেখা যায় লাশ। সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লাশ উদ্ধারের ঘটনা বেড়েছে। অজ্ঞাত যে সব লাশ উদ্ধার করা হয় তাদের পরিচয় অনেক সময় শনাক্ত করা যায় না। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের পরিচয় শনাক্ত করতে হয়।

গত কয়েকদিন ধরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খুনখারাবি ও সংঘর্ষের ঘটনা বেড়েছে। একের পর এক নৃশংস খুনের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে জনমনে। যদিও চাঞ্চল্যকর কয়েকটি ঘটনার ক্লু বের করতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু তাদের তৎপরতার মধ্যেও থেমে নেই নৃশংসতা।

তবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, সার্বিক দিক বিবেচনা করলে দেশে অপরাধ প্রবণতা অনেকটা কমেছে। এভাবে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্রমাগত বাড়ছে অপরাধ। পারিবারিক কলহ, পূর্বশত্রুতার জের, সম্পর্কের অবক্ষয়, পরকীয়া, ব্যাবসায়িক ও ব্যক্তিস্বার্থের দ্বন্দ্ব, ছোটখাট বিষয় নিয়ে কথা-কাটাকাটি, এমনকি ঝগড়া-বিবাদ থামাতে গিয়েও একের পর এক ঘটছে হত্যাকা-। সারা দেশেই অপ্রীতিকর ঘটনা বাড়ছে। ফলে ব্যক্তিগত ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে মানুষ।

জানা গেছে, গতকাল শুক্রবার চাঁদপুরে ঘর থেকে স্বামী-স্ত্রীর হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। একই দিন টাঙ্গাইলে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অডিও বার্তা দেয়ার দুই দিন পর ঝোপে মিলেছে শিশুর লাশ। এর একদিন আগে খুলনায় এক পুলিশ সদস্যের মায়ের নাকে-মুখে আঘাতের চিহ্ন অবস্থায় লাশ উদ্ধার করা হয়। ঢাকার কমলাপুর ও নটরডেম কলেজের সামনে থেকে দুই জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। কলাবাগানে বন্ধ ফ্ল্যাট থেকে গৃহকর্মীর লাশ উদ্ধার করা হয়। কুমিল্লায় পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে মাদরাসা উদ্ধার করা হয় শিক্ষার্থীর লাশ। ময়মনসিংহের তারাকান্দায় নিখোঁজের ১৩ দিন পর বাবুল মিয়া (৪৫) নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এছাড়াও পুলিশের তথ্যমতে গত এক বছরে ঢাকার ৩ নদীতে অন্তত ১০৯ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানী ও তার আশপাশের নদীগুলোতে গড়ে প্রতি ৪ থেকে ৭ দিনে মিলছে ১টি করে লাশ। যার অধিকাংশই বেওয়ারিশ। গত এক বছরে রাজধানীর বালুনদী, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ নদী থেকে প্রায় ১০৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। যার অধিকাংশই বেওয়ারিশ। লাশ পানিতে থাকায় পচেগলে বিকৃত হয়ে যায়। ফলে হাতের ফিঙ্গারপ্রিন্টের রেখাগুলো বিকৃত হওয়ায় অজ্ঞাত লাশের প্রকৃত পরিচয় খুঁজে বের করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। তথ্য প্রমাণের অভাবে নাগালের বাইরে থেকে যায় প্রকৃত অপরাধী। ডিএমপির নৌপুলিশ, সরকারি হাসপাতাল, একাধিক থানা সূত্র জানায়, ২০২২ সালে পুরো বছরজুড়ে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদী থেকে ৫০টি লাশ, শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ২০টি, বালুনদীসহ পাশর্^বর্তী নদী থেকে ২৫টি এবং তুরাগ থেকে ১৪টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এদিকে জনকল্যাণমূখী সংস্থা আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম গত বছরের প্রথম ৯ মাসে প্রায় তিনগুণ বেওয়ারিশ লাশ দাফনের কথা জানিয়েছে। সংস্থাটির সূত্র জানায়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৯ মাসে রাজধানীর জুরাইন এবং রায়েরবাজার কবরস্থানে মোট ৩৩৮টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে। এরমধ্যে ২৭২টি লাশ জুরাইন কবরস্থানে এবং ৫৫টি রায়েরবাজারে।

এ বিষয়ে ঢাকা জেলা নৌপুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, চলতি মাসে ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী দুই যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে একটি বালু নদীর রাজাখালী এলাকা থেকে অপরটি পোস্তগোলার হাসনাবাদ এলাকা থেকে। অধিকাংশ লাশ পানিতে থাকায় পচে বিকৃত হয়ে যায়। ফলে লাশের হাতের ফিঙ্গার প্রিন্ট এর মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত করা খুবই কষ্টসাধ্য একটি বিষয়। এসব ক্ষেত্রে লাশের ছবি তুলে, পোস্টারিং করে, ডিএমপির থানাগুলোতে ম্যাসেজ পাঠিয়ে, গণমাধ্যমের সহায়তায় লাশের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করা হয়। এই পুলিশ সুপার বলেন, ইতিমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তর এর পক্ষ থেকে বিশেষ নির্দেশনায় নদীকেন্দ্রিক এই অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোকে চিহ্নিত করে সেখানে পর্যাপ্ত লাইটিং এবং সিসিটিভি ভিডিও ক্যামেরার আওতায় আনার জন্য পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন। পর্যাপ্ত জলজান এবং জনবলের বিষয়ে ইতিমধ্যে সদরদপ্তরকে জানানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

কয়েকটি ঘটনা: রাজধানীর কমলাপুর এলাকা ও নটরডেম কলেজের সামনে ফুটপাত থেকে দুইজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রাথমিকভাবে তাদের নাম পরিচয় জানা যায়নি। বুধবার দুপুর আড়াইটা ও সাড়ে ৩টার দিকে লাশ দুটি উদ্ধার করা হয়। মতিঝিল থানার এসআই অনিল চন্দ্র রায় বলেন, খবর পেয়ে নটরডেম কলেজের সামনের ফুটপাত থেকে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে আইনি প্রক্রিয়া শেষে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢামেক হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, নিহত ব্যক্তির নাম পরিচয় জানা যায়নি, বিস্তারিত জানার চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে, মতিঝিল থানার কমলাপুর ৬ রেলগেটের বিপরীত সাইডের ফুটপাত থেকে অজ্ঞাত পরিচয় (৭০) এক বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এরআগে রাজধানীর কলাবাগানের ভূতের গলি এলাকার একটি বাসা থেকে এক গৃহকর্মীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতের বয়স আনুমানিক আট বছর। বাড়ির কেয়ারটেকারের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কলাবাগান থানা-পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে।

এছাড়া গতকাল শুক্রবার (৮ সেপ্টেম্বর) চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের বড়কুল পূর্ব ইউনিয়নের রায়চৌ গ্রামে স্বামী-স্ত্রীর হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সকালে প্রতিবেশীরা তাদের লাশ দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেন। নিহতরা হলেন- বড়কুলের বৃদ্ধ উত্তম বর্মণ (৬২) ও তার স্ত্রী কাজলী রানি বর্মণ (৫৫)। উত্তম স্থানীয় নয়ারহাট বাজারের একজন মাছ বিক্রেতা। স্থানীয়রা জানান, যে বাড়ি থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে সেটির দেখাশোনা তারা করতেন। বাড়ির মালিক দুলাল থাকেন অন্যত্র। পাশেই তাদের নিজ বাড়ি। প্রতিদিন রাতে তারা এখানে এসে রাত্রীযাপন করেন। আর দিনে ওই বাড়ির ঘরে তালা দিয়ে নিজেদের বাড়িতে থাকতেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেন হাজীগঞ্জ থানার ওসি আব্দুর রশিদ। অন্যদিকে টাঙ্গাইলের সখীপুরে অপহরণের দুই দিন পর সামিয়া আক্তারের (৯) লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার দুপুরে উপজেলার দাড়িয়াপুর উত্তরপাড়ায় শিশুটির বাড়ির কাছের একটি ঝোপ থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। শিশুটির চাচা আমিনুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। গত বুধবার সকালে সামিয়াকে অপহরণের পর অডিও বার্তায় ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছিল। শিশু সামিয়া উপজেলার দাড়িয়াপুর গ্রামের উত্তরপাড়া এলাকার রঞ্জু মিয়া ও রুপা বেগম দম্পতির মেয়ে। সে ওই গ্রামের মাঝিরচালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।

অপরদিকে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙায় ফেনী নদী থেকে এক যুবকের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তবে ওই যুবকের পরিচয় জানা যায়নি।

গতকাল শুক্রবার (৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরের দিকে মাটিরাঙ্গার বেলছড়ি ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের নুরনবী পাড়ায় অযোধ্যা ছড়ার মুখে ফেনী নদী থেকে এ মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার দুপুরের দিকে ফেনী নদীতে লাশ ভাসতে দেখেন স্থানীয়রা। তারা বিষয়টি মাটিরাঙ্গা থানা পুলিশকে জানান। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে লাশটি উদ্ধার করে। অন্য কোথাও তাকে হত্যা করে লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে হত্যকারীরা নদীতে ফেলে দেয় বলে ধারণা করছে পুলিশ। গত বুধবার (৬ সেপ্টেম্বর) খুলনায় এক পুলিশ সদস্যের মায়ের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। দুপুরে অনিমা দাস নামের (৬৩) ঐ নারীর লাশ নগরীর পশ্চিম টুটপাড়ার ফরিদ মোল্লার মোড় এলাকার ভাড়া বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়। তার নাকে, মুখে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। নিহত অনিমা দাস বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার বেতাগা গ্রামের মৃত সুধাংশু দাসের স্ত্রী। তার ছেলে শুভেন্দ্র দাস নগরীর সোনাডাঙ্গা মডেল থানায় কনস্টেবল পদে কর্মরত। এরআগে কুষ্টিয়ায় একটি ফ্লাট থেকে নার্সিং ইন্সটিটিউটের এক ছাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ২২ আগস্ট রাতে শহরের মজমপুর এলাকার ফ্ল্যারেট তিন তলার একটি ইউনিট থেকে ওই ছাত্রীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি (২২) সদর উপজেলার মোল্লাতেঘরিয়া গ্রামের ওহিদুল ইসলামের মেয়ে ও স্থানীয় একটি বেসরকারি নার্সিং ইন্সটিটিউটের প্রথম বর্ষের ছাত্রী।

https://www.dailysangram.info/post/534959