৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ১১:১৩

কম দামে ফল নেই পুড়ছে ক্রেতার পকেট

দিন আনেন, দিন খান ইউসুফ। ঢাকায় সিএনজি চালান। তার পাঁচ বছরের সন্তান ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। চিকিৎসক তাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ রসালো ফল ও ডাবের পানি খেতে পরামর্শ দিয়েছেন। এজন্য শ্যামলীর একটি ফলের দোকানে মাল্টা, কমলা ও ডাব কিনতে এসেছেন তিনি। তবে ফল কিনতে এসে যে দাম শুনেছেন, একদিন কাজ করেও তিনি সেটির যোগান দিতে পারবেন না। এজন্য ১০০ টাকা দিয়ে দু’টি ছোট মাল্টা কিনেছেন, আর ১২০ টাকা দিয়ে একটি ডাব কিনেছেন। ইচ্ছে থাকলেও কমলা না কিনেই ফিরতে হয়েছে তাকে। ইউসুফ বলেন, চারদিন ধরে আমার ছেলেটা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। চিকিৎসক পরামর্শ দিয়েছেন প্রচুর পরিমাণে রসালো ফল ও তরল খাবার খাওয়াতে।

এজন্য এখানে ফল কিনতে এসেছিলাম। কিন্তু ফলের দাম আমাদের নাগালের মধ্যে নাই। এক কেজি মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ৩৮০ টাকায়। আর কমলার দাম ৩৫০ টাকা। দাম শুনে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। একদিন যা ইনকাম হয়, এক কেজি ফল কিনতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।
একই বাজারে আনার (ডালিম) কিনছিলেন আশরাফুল ইসলাম। তিনি আনারের দাম শুনে রাগান্বিত কণ্ঠে বিক্রেতার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘দু’দিন আগেও তো ৪০০ টাকা দিয়ে কিনলাম, হুট করেই ৫০ টাকা বাড়িয়ে দিলেন।’ তিনি ৩০০ টাকা দিয়ে ৩টি আনার কিনে বাসায় ফিরছিলেন। তিনি মানবজমিনকে বলেন, বাচ্চাদের পুষ্টির কথা চিন্তা করে মাঝে- মধ্যে ফল কিনতে হয়। কিন্তু ফল আমাদের ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেছে। সামনের দিনগুলোতে আর ফল কেনা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, ৩০০ টাকার নিচে কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এটা কোনো সিস্টেম হলো নাকি। দু’দিন আগে আনার কিনেছি ৪০০ টাকা দিয়ে। আজ সেই ফলের দাম কেজিতে ৫০ টাকা বেড়ে গেছে। প্রতি কেজি আপেল ও কমলার দামও ৩৫০ টাকা।

আরেক ক্রেতা জেসমিন বলেন, ফলের বাজারে আগুন জ্বলছে। কোনো ফলই কেনার উপায় নেই। এক কেজি গ্রীন আপেলের দাম ৪০০ টাকা। বিক্রেতাদের সেই একই কথা যে, তাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে এজন্য বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। এভাবে প্রতিটি জিনিসের দাম নাগালের বাইরে চলে গেলে আমরা কীভাবে চলবো। সরকার তো সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়াচ্ছে। কিন্তু বেসরকারি চাকরিজীবীদের কথা কি একটুও ভাবছে? আমাদের বেতন তো বাড়েনি।

এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন ফলের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ৩০০ টাকার নিচে কোনো বিদেশি ফল পাওয়া যাচ্ছে না। অধিকাংশ ফলের দামই ৩৫০ টাকার উপরে। গতকাল প্রতি কেজি মাল্টা ৩৮০, কমলা ৩৫০, ছোট কমলা ৩২০, গ্রীন আপেল ৪০০, গালা আপেল ৩৫০, সুজি আপেল ৩৩০ টাকা এবং আনার (ডালিম) ৪৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। ভ্যানে প্রতিটি ডাব বিক্রি হয়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায়। এছাড়া আঙ্গুর ৪৫০ টাকা, নাশপাতি ৩২০ টাকা, ড্রাগন ফল ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা, রম্বুটান ১০০০ ও কিউই ফল বিক্রি হচ্ছে ১০০০ টাকা কেজি দরে।

ওদিকে দেশি ফলের মধ্যে আকার ও মানভেদে প্রতি কেজি কালো তরমুজ ৭০ টাকা, পেঁপে ১০০ থেকে ১২০, বারি-৪ আম ২৮০, আশ্বিনা ১৩০, আমড়া ৭০ থেকে ৮০, আমলকী ১০০, পেয়ারা ৭০ থেকে ৮০ টাকা, আতা ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি পিস আনারস ৩০ থেকে ৬০ টাকা, জাম্বুরা ১০০ থেকে ১৫০, বেল ৫০ থেকে ৭০, তাল ৪০ থেকে ৫০, কাঁঠাল ৩০০ থেকে ৭০০, প্রতি ডজন সাগর কলা ১০০, বাংলা কলা ৯০, সবরি কলা ১২০, চিনি চম্পা কলা ৭৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

বিক্রেতারা জানান, গত এক মাসের মধ্যে বিদেশি ফলের দাম ২০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বিদেশি ফলের সিজন শেষ ও সরবরাহ কম থাকায় দাম বেশি। কারওয়ান বাজারের আল্লাহ্‌র দান ফল বিতানের বিক্রেতা বলেন, এখন বিদেশি ফলের সিজন শেষ, সরবরাহও কম। যারা আগে ফল মজুত করেছে, তারা তাদের ইচ্ছামতো দাম রাখছে। আমাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। তাহলে আমরা কম দামে কীভাবে বিক্রি করবো। দাম বাড়ার প্রকৃত কারণ আমদানিকারকরা বলতে পারবেন।

শ্যামলীতে ভ্যানে করে ফল বিক্রি করা মো. কাওসার বলেন, প্রতিদিনই কোনো না কোনো ফলের দাম বাড়ছে। দুইদিন আগেও ৪০০ টাকা দিয়ে আনার বিক্রি করেছি। কিন্তু সেই আনার আজ যদি ৪৫০ টাকায় বিক্রি না করি তাহলে লাভ করতে পারবো না। অন্যান্য ফলের দামও আগের চেয়ে বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এক কেজি গ্রীন আপেল বিক্রি করতে হচ্ছে ৪০০ টাকায়। এটিও এক সপ্তাহ আগে ৩৫০ টাকায় বিক্রি করেছি।

বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকায় ফলের বাজারে এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ব্যবসায়ীরা আমদানি মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ দামে ফল বিক্রি করছে বলেও জানান বিশেষজ্ঞরা। কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন মানবজমিনকে বলেন, ব্যবসায়ীরা আমদানি মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ মূল্যে বিভিন্ন ধরনের ফল বিক্রি করছে। তারা অতি মুনাফাকে জায়েজ করার জন্য ডলার সংকট, ইউক্রেন যুদ্ধের মতো অজুহাত সামনে আনছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কাস্টমস এর রিপোর্ট অনুযায়ী এসব অজুহাতের কোনো বাস্তবতা নাই। তিনি বলেন, যেহেতু বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বেশি নেয়ার সুবিধা ভোগ করছে, সেহেতু ফলের বাজারেও এই সুবিধাটা তারা হাতছাড়া করতে চাচ্ছে না। এজন্য বিভিন্ন ফলের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে।

https://mzamin.com/news.php?news=72993