৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ১১:১১

বিরোধী নেতাকর্মীদের দ্বিতীয় ঠিকানা এখন কোর্ট-কাচারি

গায়েবি মামলা। জামিন। নিয়মিত হাজিরা। একেকজনের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ চারশ’ পর্যন্ত মামলা। কারও বিরুদ্ধে ৫০, কারও বিরুদ্ধে ১০০ মামলা। ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধেও অর্ধশতাধিক মামলা। এমন পরিস্থিতিতে অনেক নেতাকর্মীকে মাসের কর্মদিবসের প্রায় সবদিনই থাকতে হচ্ছে আদালত প্রাঙ্গণে। তাদের ঠিকানাই যেন কোর্ট-কাচারি।

নিয়মিত আদালতে যাচ্ছেন। হাজিরা দিয়ে গভীর রাতে বাসায় ফিরছেন। কেউ কেউ আদালত থেকে কারাগারে যাচ্ছেন।
পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলে পাঠানো হচ্ছে। পরের দিন সকালেই অন্য মামলায় হাজিরার জন্য তাকে আদালতে আনা হচ্ছে। একদিনে একাধিক মামলার হাজিরার তারিখও পড়ছে কারও কারও।

শুধু নতুন মামলা নয়, পুরনো মামলার বিচারে গতি সঞ্চার হয়েছে সম্প্রতি। প্রতিনিয়ত তাদের দৌড়াতে হচ্ছে আদালতের বারান্দায়। প্রতিদিন ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন আদালতে এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের ভিড়। এদের মধ্যে কেউ কেউ দিনে একটি- দু’টি নয়, ৮ থেকে ১০ মামলার হাজিরা দিচ্ছেন।

আইনজীবীরা বলছেন, বিএনপি নেতাদের মাসে সব কর্মদিবসের প্রতিদিনই আদালতে আসতে হচ্ছে। কারও কারও প্রতিদিন ৮ থেকে ১০টি মামলার শুনানি থাকায় সকাল-সন্ধ্যা আদালতেই কাটাতে হচ্ছে। আদালতই এখন বিএনপি নেতাদের কর্মস্থল ও অফিসে পরিণত হয়েছে।

গতকাল সরজমিন দেখা গেছে, ঢাকার জজ কোর্টে বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ, বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, যুগ্ম মহাসচিব হাবীব- উন-নবী খান সোহেল, বিএনপি’র কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস ও ঢাকা জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নিপুণ রায় চৌধুরী আদালতে আসেন।

সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্র্রেট আদালতে যান বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব হাবীব-উন-নবী খান সোহেল। আদালতের নিচে আসার সঙ্গে সঙ্গেই নেতাকর্মীদের স্লোগান শুরু হয়। ২০১৯ সালে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার অভিযোগে শাহবাগ থানা মামলায় (নং ৩২/১১) হাজিরা দিতে আসেন। মামলাটি সিএমএম ৩নং আদালতে শুনানি হয়। তবে একই সময় সিএমএম ৩, ৫, নং কোর্ট ও ঢাকা জজ কোর্টে আরও তিনটি মামলার শুনানি শুরু হয়। একই সময় ৪টি মামলার শুনানি শুরু হওয়ায় অন্য আদালতগুলোতে আইনজীবীরা বিষয়টি অবহিত করার পরেও আদালত তা আমলে নেননি। পরে শুনানি স্থগিত করে আসামিকে এজলাসে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন।

হাবীব-উন-নবী খান সোহেলের আইনজীবী এডভোকেট জাকির হোসাইন জুয়েল বলেন, প্রতিদিন অন্তত ৮টি মামলায় তাকে হাজিরা দিতে হয়। মাসে এমন কোনো দিন নেই যে, আদালতে আসতে হয় না। প্রতিদিনই আদালতে এসে সকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত শুনানিতে থাকতে হয়। এমনকি একইসঙ্গে ৫ থেকে ৬টি আদালতে শুনানির সময় পড়ে। তখন একজন মানুষের কীভাবে সম্ভব একই সময়ে এতোগুলো আদালতে হাজির হওয়া। এতে আদালত থেকে আদালত ঘুরতে ঘুরতেই একজন মানুষ ক্লান্ত হয়ে যান। পুরো দুর্বিষহ একটা অবস্থার মধ্যে আছেন। এটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। সোহেলের নামে প্রায় ৪২১ টি মামলা রয়েছে।

জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের ঢাকা ইউনিটের সভাপতি এডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার মানবজমিনকে বলেন, শাহবাগ ও পল্টন থানায় দায়ের করা মামলায় বিএনপি’র নেতারা গতকাল হাজিরা দিতে এসে ছিলেন। এছাড়া মাঠ পর্যায়ের কয়েকশ’ নেতাকর্মী ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজিরা দিতে এসেছিলেন। সরকার এসব নেতার মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শেষ করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিচারকদের তাড়া দিচ্ছেন। আদালত নির্ধারিত সময়ের পর শুনানি করছেন। যাতে বিএনপি’র এসব নেতা নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন।

দুপুরের দিকে দু’টি মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে যান মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে আমার মামলার ট্রায়াল শুরু হয়েছে। আমার ধারণা, আগামী এক-দেড় মাসের মধ্যে আমাকেও কারাগারে চলে যেতে হবে। এ সময় বিচারব্যবস্থার সমালোচনা করে ফখরুল বলেন, এমন একটা বিচারব্যবস্থা এরা চালু করেছে যে, বিচারব্যবস্থায় হাইকোর্ট যদি আপনাকে জামিন দেন। সেটা নিয়ে যদি নিম্ন আদালতে যান, সেখানে নিম্নতম যিনি আছেন বিচারক, জামিন তিনি দেবেন কি দেবেন না সেটা নির্ধারণ করেন। আমাদের বহু নেতা কর্মীর জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। ফখরুল বলেন, ‘তাদের উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। যারা এই সরকারের বিরোধিতা করছে, যারা এই সরকারের পক্ষে নয়, যারা এই সরকারকে বলছে যে, তুমি অনেক খারাপ কাজ করেছ, সরে যাও তাদের সবাইকে তারা কারাগারে ঢোকাতে চায়।

সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রচলিত প্রথা ও রীতি ভঙ্গ করে সাক্ষ্য নেয়া হচ্ছে। সাধারণত ফৌজদারি মামলায় তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য নেয়া হয় সবার শেষে। অথচ ঢাকার সিএমএম কোর্টে বিচারের প্রচলিত প্রথা ও রীতি ভঙ্গ করে সবার আগে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার সাক্ষী নেয়া হচ্ছে। বাকি সাক্ষীদের খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। অন্য সাক্ষীদের উপস্থিতি ছাড়াই মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে। এবং রায়ের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এছাড়া মামলাগুলো বিরতিহীনভাবে শুনানির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।

প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী একদিন শুনানির পর দুই থেকে ৩ সপ্তাহ পর পরবর্তী শুনানি গ্রহণের জন্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু চিহ্নিত মামলাগুলো কখনো পরের দিনই অথবা ১ থেকে ২দিন সময় দিয়ে তারিখ নির্ধারণ করা হচ্ছে। এছাড়া একদিনে টানা ৮ জনের সাক্ষ্য নেয়ার ঘটনাও ঘটছে। এতে বিচারক, আইনজীবী এবং সাক্ষী ক্লান্ত হয়ে পড়লেও বিরতিহীন সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত তৎপরতার কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাক্ষীদের এনে সাক্ষ্য নেয়া হচ্ছে বলে তারা জানান।

ঢাকা কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট জয়নুল আবেদীন মেসবাহ জানান, ঢাকার সিএমএম কোর্টে একটি মামলায় ৮ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। বেলা দুইটা থেকে একটানা সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত আদালত এই সাক্ষীর জেরা এবং জবানবন্দি গ্রহণ করেন। এছাড়া অস্বাভাবিক গতিতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সভাপতি রফিকুল ইসলাম মজনুর মামলার সাক্ষ্য নেয়া হচ্ছে। তিনি আটকের পর দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে রয়েছেন। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমরা তাকে আদালতে হাজির না করতে আবেদন করেছি কিন্তু আদালত তা শোনেননি। তার একটি মামালায় জামিন ছিল। ওই জামিন বাতিল করেন সিএমএম কোর্টের চার নম্বর আদালতের বিচারক তোফাজ্জল হোসেন। জামিন বাতিলের পর একদিনে ৭ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। দ্রুততার সঙ্গে মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য তড়িঘড়ি করছেন পুলিশ ও আদালত।

বেলা ১১টায় হাজতখানা থেকে আদালতে তোলা হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনুকে। আদালতে নেয়ার পথে হাত নেড়ে নেতাকর্মীদের অভয় দেন মজনু। নেতাকর্মীদের বলেন, আমি শিগগিরই ফিরবো, তোমরা রাজপথ ছাড়বে না। পরে সাড়ে ১১টার দিকে আদালতে তোলা হলে বংশাল থানার একটি নাশকতার মামলায় আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান। রফিকুল আলম মজনুর আইনজীবী এডভোকেট মহিউদ্দিন খান বলেন, মজনু বেশ কয়েকদিন ধরে অসুস্থ। তাকে আদালতে না তুলতে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু আদালত তা আমলে নেয়নি। তার বিরুদ্ধে প্রায় ৩৫০টি মামলা রয়েছে। প্রতিদিন ১০টি মামলার শুনানি হয়। প্রতিটি মামলায় তাকে আদালতে হাজির হতে হয়। কোনো কোনো দিন সারাদিনই এ আদালত থেকে ও আদালতে ঘুরে দিন শেষ হয়। এভাবেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বহুবার তার জামিন চেয়েছি। কিন্তু আদালত কোনোভাবেই জামিন দিচ্ছে না।

বিকাল ৪টায় সিএমএম ৫নং কোর্টে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিবের মামলার শুনানি হয়। হাবিব সকাল থেকে আরও ৫টা মামলায় আদালতে হাজিরা দিয়েছেন। বেলা ৩টায় তার শুনানির সময় নির্ধারণ থাকলেও ঢাকা জজ কোর্টে অন্য মামলায় হাজির হওয়ায় আদালত নির্ধারিত সময়ে শুনানি শুরু করতে পারেননি। পরে ৪টায় শুনানি হয়।

হাবিবের আইনজীবী এডভোকেট সাকিল আহমেদ রিপন বলেন, এমন কোনো দিন নেই তাকে আদালতে আসতে হয় না। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটার পর একটা মামলার শুনানি চলতে থাকে। চাকরির মতো হয়ে গেছে। হাবিরের অফিস হলো ঢাকা আদালত। এখানে প্রতিদিন আসতেই হবে। আসলে মামলাগুলোর গতি অনেক বাড়ানো হয়েছে। দ্রুত বিচার শেষ করার একটা তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে। এজন্যই সকাল-সন্ধ্যা সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।

হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে যুবদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোনায়েম মুন্নাকে রামপুরা থানার গায়েবি মামলায় ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন বলে অভিযোগ করেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের ঢাকা ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকী।

তিনি মানবজমিনকে বলেন, হাইকোর্ট আবদুল মোনায়েম মুন্নাকে এভাবে মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো কেন অবৈধ হবে না মর্মে রুল ইস্যু করে এবং রুল শুনানি না হওয়া পর্যন্ত কোনো মামলায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলে তাকে গ্রেপ্তার না দেখানোর নির্দেশ প্রদান করেন। একইসঙ্গে আপিল বিভাগের রায় ৬৯ ডি এল আর পেজ নম্বর ৬৩ অনুসরণ করতে বলা হয়। এরপরেও বুধবার রামপুরা থানার একটি গায়েবি মামলায় উচ্চ আদালতের এই আদেশ অগ্রাহ্য করে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়। একইসঙ্গে ওই মামলায় শুনানি করে ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বিচারক। এই মামলায় আবদুল মোনায়েম মুন্নার নাম এজাহারে নাই। আইনজীবী মেহেদী হাসান বলেন, গত ৮ই মার্চ বিনা পরোয়ানায় আবদুল মোনায়েম মুন্নাকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। পরবর্তীতে শাহজাহানপুর থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে পাঠানো হয় পরের দিন। এরপর থেকে এক মামলায় জামিন হলেও অন্য একটি মামলায় গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে পাঠায় পুলিশ এবং রিমান্ড মঞ্জুর করেন সিএমএম আদালত। এভাবে এখন পর্যন্ত ৮টি মামলায় তাকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়। যার একটি মামলায়ও তার নাম এজাহারে নাই।

খুলনা মহানগর বিএনপি অঙ্গ সংগঠনের ১০ নেতাকর্মীর জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে প্রেরণ করেছে মুখ্য মহানগর হাকিম। আসামিপক্ষের আইনজীবী এডভোকেট তৌহিদুর রহমান তুষার জানান, খুলনা থানার এসআই শরিফুল ইসলাম বাদী হয়ে গত ১৭ই জুলাই বেআইনিভাবে জনতাবদ্ধ হয়ে পুলিশের কাজে বাধাদান, পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ এনে ১৪ জনের নাম উল্লেখসহ ৯৪ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। মামলা দায়েরের পর আসামিরা গত ২৭শে জুলাই উচ্চ আদালত থেকে ৬ সপ্তাহের অন্তর্বর্তীকালীন জামিনপ্রাপ্ত হয়ে ৫ই সেপ্টেম্বর খুলনা সিএমএম কোর্টে আত্মসমর্পণ করে জামিন লাভ করেন এবং বেলবন্ড দাখিল করেন। বৃহস্পতিবার পুনরায় আদালতে আত্মসর্মপণ করলে দীর্ঘ শুনানি শেষে মুখ্য মহানগর হাকিম মমিনুন নেছা আসামিদের জামিন বাতিল করে কারাগারে প্রেরণের আদেশ দেন।

বিএনপি সমর্থক আইনজীবী নেতাদের অভিযোগ, ২০১৩-১৫ সালে যেসব গায়েবি মামলা হয়েছিলো, ওইসব মামলার কার্যক্রম দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। এরইমধ্যে কিছু মামলা শেষ প্রান্তে। রাজনৈতিক এসব মামলায় বিএনপি মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, মধ্যসারি ও তৃণমূলের অনেক নেতাই আসামি। সপ্তাহে দুই তিনদিন দলের মহাসচিবকে হাজিরা দিতে হচ্ছে। গত রোববার পুরোনো দুটি নাশকতার মামলায় মির্জা ফখরুল, রুহুল কবীর রিজভী, শিমুল বিশ্বাস, শামা ওবায়েদসহ ৬৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন ঢাকার আদালত। মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে মামলাটি ১১ বছর আগের ২০১২ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর পল্টন থানায় নাশকতার। অন্যটি আট বছর আগে রাজধানীর বাড্ডা থানা এলাকায় নাশকতার অভিযোগে।

ওদিকে আদালতপাড়ায় দৌড়ঝাঁপ করে জামিন পেলেও মুক্তি মিলছে না বিএনপি নেতাদের। একের পর এক পুরোনো মামলায় আটক করা হচ্ছে। উচ্চ আদালত থেকে ‘নো অ্যারেস্ট, নো হ্যারেজ’ নির্দেশনা থাকার পরও প্রতিকার মিলছে না বেশির ভাগ নেতার। পুরোনো মামলায় অজ্ঞাত আসামির তালিকায় জেলগেট থেকে আটক করা হচ্ছে কিংবা জামিন পাওয়ার পরই নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। নেতারা জানান, সক্রিয় নেতাদের টার্গেট করে একের পর এক পুরোনো মামলায় আটক দেখিয়ে চরম হয়রানি করা হচ্ছে।
এরমধ্যে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি’র সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু, ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিন, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্না, সাবেক সহ-সভাপতি এসএম জাহাঙ্গীর, যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক গোলাম মাওলা শাহীন, ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান মোসাব্বিরসহ অনেকে রয়েছেন। দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফের বিরুদ্ধে সাতটি, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে চারটি, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৪৮টি, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে ৩৬টি, নজরুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে ছয়টি, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ছয়টি, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর বিরুদ্ধে ৯টি, সেলিমা রহমানের বিরুদ্ধে চারটি ও সালাহউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা রয়েছে। যুবদল সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুর বিরুদ্ধে ৩১৩টি, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরবের নামে ৩০৫টি, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে ২৫৪টি, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলুর বিরুদ্ধে ২০৪টি, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে ১৮০টি, নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম রবির বিরুদ্ধে ১৮৪টি, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসানের বিরুদ্ধে ১৪৭টি, যুবদলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইসাহাক সরকারের বিরুদ্ধে ৩২৭টি মামলা, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে ১০৬টি, নির্বাহী কমিটির সদস্য আকরামুল হাসানের বিরুদ্ধে ১০৩টি মামলা রয়েছে। আরও অনেক নেতার নামে মামলার সংখ্যা সেঞ্চুরি, হাফ সেঞ্চুরি পার হয়েছে অনেক আগেই। এখনো নিত্যনতুন মামলা যোগ হচ্ছে।

মামলায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে ঢাকা মহানগর। এখানে ১৭ হাজার ৫৮৩টি মামলায় আসামি ২ লাখ ৯১ হাজার ৯৩৫ জন। সিরাজগঞ্জে ২ হাজার ২৭০টি, নোয়াখালীতে ২ হাজার ৫৮৩টি, চট্টগ্রামে ২ হাজার ৩০১টি, ফেনীতে ২ হাজার ১৯৯টি, নারায়ণগঞ্জে ২ হাজার ৯১৩টি, ঢাকা জেলায় ২ হাজার ৩২৫টি, সাতক্ষীরায় ২ হাজার ৫৭৭টি, রাজশাহী মহানগরে ২ হাজার ৫৯৬টি, খুলনা মহানগরে ২ হাজার ৯১০টি, চট্টগ্রাম মহানগরে ৪ হাজার ৫৭টি, বরিশাল মহানগরে ২ হাজার ৪৮৪টি, সিলেট মহানগরে ২ হাজার ৪৬৭টি মামলা রয়েছে।
বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, বিএনপি’র আইনজীবী নেতাদের অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। কোর্ট আওয়ারের পরে কোনো মামলার শুনানি হয় না।

https://mzamin.com/news.php?news=73023