৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৬:২২

নানা ঘটনার ঘনঘটা

মুজতাহিদ ফারুকী

বাংলাদেশ এখন এক রঙ্গমঞ্চ। মঞ্চে একের পর এক ঘটে চলেছে নানা ঘটনার ঘনঘটা। মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ যখন দিশাহারা, রাজনৈতিক অস্থিরতা যখন মানুষের ক্রমবর্ধমান দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে তখন একের পর এক ঘটছে নাটকীয় সব ঘটনা।
ঘটনাগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা আমরা এক নজরে দেখে নিতে পারি। ১. ব্রিকস বিপর্যয়- সদস্য হতে না পারায় আশাভঙ্গ। ২. ড. ইউনূসকে নিয়ে তোলপাড়। ৩. দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক খবর। ৪. যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ নিরাপত্তা আলোচনা। ৫. দিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন। প্রধানমন্ত্রী যাচ্ছেন। ৬. ঢাকায় আসছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ৭. আদালতে মিছিল মিটিংয়ের ওপর বিধিনিষেধ জারি।

আমরা এটিকে সংক্ষিপ্ত তালিকা বলছি। কারণ, বিমানবন্দরের লকার থেকে ৫৫ কেজি সোনা চুরি, সাড়ে তিন বছরের উড়ালসড়ক প্রকল্প আট বছর পর অর্ধেক উদ্বোধন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি নিয়ে হলিউডে ‘বিলিয়ন ডলার হাইস্ট’ নামে চলচ্চিত্রের প্রকাশ, ডেঙ্গুর মহামারী রূপ, রেকর্ড মৃত্যু, বিরোধী দলের কর্মসূচিতে পুলিশ ও পেটোয়া বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণের পর হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, রিজার্ভের উদ্বেগজনক হ্রাস, মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণের নাভিশ^াসের মতো অসংখ্য বিষয়- যা আমাদের জীবনকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করছে সেগুলোর কোনোটিই তালিকায় রাখা হয়নি। যদিও প্রতিটিই আলাদা করে আলোচনার দাবি রাখে।
আমরা যে সাতটি বিষয় তালিকায় রেখেছি সেগুলো বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যাত্রা কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করবে।

গত ২২ থেকে ২৫ আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। এটা ভালোভাবে নেয়নি বন্ধু দেশ ভারত। তারা ব্রিকসে বাংলাদেশের সদস্যপদ ঠেকিয়ে দিয়েছে। ভারতের একাধিক শর্তের কারণেই যে বাংলাদেশ বঞ্চিত হয়, তা কারো জানতে বাকি থাকেনি। ফলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী সমর্থকরা বিস্মিত, হতভম্ব হয়ে পড়েন। কেউ কেউ গলা ফাটিয়ে প্রথমবারের মতো প্রশ্ন তোলেন, ভারত কি কোনোকালে আদৌ বাংলাদেশের বন্ধু ছিল? এমন কোনো জাতীয়, আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক ইস্যু কি খুঁজে পাওয়া যাবে যেটিতে ভারত সত্যিই বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে কাজ করেছে? সরকারের জন্য ঘটনাটি ছিল বিপর্যয়কর। ব্রিকস বিপর্যয়ের রেশ না মেলাতেই সামনে আসে বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, যার নামেই বিশে^র মানুষ বাংলাদেশকে জানে, ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে কেন্দ্র করে চাঞ্চল্যকর নাটক। শ্রম আইন লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১৮টি মামলা তাকে সাজা দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এটিকে হয়রানিমূলক বলে উল্লেখ করে নানা মহল থেকে প্রতিবাদ হতে থাকে। একপর্যায়ে শতাধিক নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্বসহ ১৬০ বা তারও বেশি সংখ্যক বিশ^নেতা ড. ইউনূসের মামলা তুলে নেয়া এবং দেশের নিরপেক্ষ আইনজীবীদের মাধ্যমে অভিযোগগুলো পরীক্ষা করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি লেখেন। সরকার এটিকে দৃশ্যত তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসাবে নেয়। সরকার এর বিরুদ্ধে তাদের সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে।

ড. ইউনূসকে নিয়ে যতই তোলপাড় করা হোক। এর ফল কোনোভাবেই সরকারের অনুকূলে যাবে না। কারণ বিশে^নেতাদের বিবৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশের সরকারের বিরুদ্ধে সুনামির মতো ভয়ানক শক্তিশালী একটি নেতিবাচক বার্তা বিশ^জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তারই প্রতিক্রিয়ায় কিনা বলা মুশকিল, কয়েক দিনের মধ্যে বিশে^র অন্যতম সেরা দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসও বাংলাদেশের সরকারের বিষয়ে একটি নেতিবাচক রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর সরকারের দমন-পীড়নের প্রামাণিক তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। এমনকি প্রতিবেশী দেশের একজন সাংবাদিকও সরকারের সমালোচনা করে নিবন্ধ লেখেন। অবশ্য সেটি আলোর মুখ দেখেনি। পোর্টালটি কারিগরি ত্রুটি বা অন্য কোনো কারণে আপাতত বন্ধ হয়ে যাবার কারণে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তাবিষয়ক আলোচনা শুরু হচ্ছে বাংলাদেশের। বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে, চলতি মাসের মধ্যেই এ বিষয়ে একাধিক বৈঠক হতে পারে। দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা সম্পর্ক নিয়ে বুধবার ঢাকায় দু’দিনের নিরাপত্তা সংলাপ শুরু হচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে সামরিক তথ্যচুক্তি (জিএসওএমআইএ) এবং অধিগ্রহণ এবং ক্রস-সার্ভিসিং চুক্তি (এসিএসএ) করতে চায়। জিএসওএমআইএ হলো একটি পারস্পরিক আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক চুক্তি যা নিশ্চিত করে যে সরকারগুলো শ্রেণীবদ্ধ সামরিক তথ্যগুলো বুঝতে এবং রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এসিএসএ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার অংশীদারদের সশস্ত্র বাহিনীকে সাধারণ সরঞ্জাম সরবরাহ এবং এর জন্য অর্থদানের অনুমতি দেয়। বিষয়টি ইতিবাচক হবে না বলাই যায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর এ কে আব্দুুল মোমেন এ ধরনের কোনো চুক্তির সম্ভাবনা আগেই নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে এ ধরনের চুক্তি করার মতো বিলাসিতার সুযোগ আছে বলে মনে করি না।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবও সবারই জানা। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশকে পাশে চায় দেশটি।

দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ হলো মার্কিন সহায়তার তৃতীয় বৃহত্তম সুবিধাভোগী। এ দেশের রফতানির অন্যতম গন্তব্যও যুক্তরাষ্ট্র। তার পরও দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক এই মুহূর্তে কিছুটা তিক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও নতুন ভিসানীতি সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশের অবস্থান। তারা বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে। কিন্তু সরকারের তাতে ঘোরতর আপত্তি। তারা ভারতকে দিয়ে এমন ব্যবস্থা করতে চায় যাতে নিজেদের পরিকল্পনা মতো নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকে যাওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু সেটি খুব সহজ হবে না। তবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে সরকার। সেই চেষ্টার সুযোগ আসবে আগামী ৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে।

আগামী ৭ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে হতে যাচ্ছে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর জোট জি-২০র শীর্ষ সম্মেলন। সেখানে ভারত জি-২০র সদস্য নয় বিশে^র এমন নয়টি দেশকে ‘অতিথি’ হিসাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, যার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া থেকে থাকছে বাংলাদেশ। ১০ তারিখে সম্মেলনের শেষ দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৈঠক করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। এটি হবে উভয় দেশের নির্বাচনের আগে দুই প্রধানমন্ত্রীর শেষ বৈঠক। আর এই বৈঠকের সুযোগ করে দিতেই বাংলাদেশকে বিশেষ বিবেচনায় ‘অতিথি’ হিসাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ভারত। সেটিও সম্ভব হয়েছে ঢাকায় ভারতের সাবেক এক রাষ্ট্রদূতের তদবিরে।

বাংলাদেশে সংবিধানের আওতায় নির্বাচন করার সরকারের যে আকাক্সক্ষা তার অনুকূলে ভারত সত্যিই যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের কাছে তদবির করবে কিনা সেটি বোঝা যাবে হাসিনা-মোদি বৈঠকের পর।

আমরা আগের কোনো কলামে বলেছি, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা হারাক এটা ভারত কখনো কোনোভাবেই চাইবে না। তারা জানে, বাংলাদেশে তাদের একমাত্র মিত্র আওয়ামী লীগ। তাই শেখ হাসিনা সরকারের তৃতীয় শক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ায় ভারত যতই বেজার হোক, তাদের হাতে বিকল্প নেই। এরকম সব উজাড় করে দেবার মতো কোনো সরকার বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি আসবে না।

জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন ইতোমধ্যে আকর্ষণ হারিয়েছে। কারণ রাশিয়ার পুতিন এবং চীনের শি জিনপিং আসছেন না। পুতিন আসতে পারবেন না যুদ্ধের কারণে। আর শি আসবেন না বলেও পিছুটান দিয়েছেন। মাত্র ক’দিন আগে প্রকাশিত চীনের নতুন মানচিত্রে ভারতের রাজ্য অরুনাচল এবং কাশ্মীরের অংশ আকসাই চীনকে চীনের অন্তর্ভুক্ত দেখানোর পর ভারতে আসতে তিনি কি একটু হলেও লজ্জা বোধ করছেন?

এদিকে জি-২০র আগেই ঢাকায় আসছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ। পরে আসছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন। কোনো ফরাসি প্রেসিডেন্টের এটি দ্বিতীয় বাংলাদেশ সফর। ক’দিন আগে বাংলাদেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দিয়েছে রাশিয়া। এ দেশে তার বিরাট অঙ্কের বিনিয়োগও আছে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে।

ম্যাক্রোর সফরে প্রধানমন্ত্রী হয়তো সুযোগ নেবেন ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সম্পর্কে আলোচনা করার। তবে কাজ হবার সম্ভাবনা কম। যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে যাওয়া ফ্রান্সের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে বিদেশে সরকারের মিত্র আছে সেটি জানান দেয়ার ভালো নমুনা হবে এই দুটি হাই প্রোফাইল সফর।

শেষ করার আগে বলি আদালতে মিছিল মিটিং করার ওপর নতুন করে নির্দেশনা এসেছে। ২০০৫ সালে হাইকোর্ট এ ধরনের একটি রায় দিয়েছিলেন। সেটি নতুন করে জারি করা হয়েছে। কখন এটি করা হলো? যখন একাধিক সিটিং বিচারপতি নিজেদেরকে ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিক’ বলে ঘোষণা করেছেন। না, কোনো মন্তব্য নেই।
mujta42@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/775102